জীবনানন্দ দাশ

220px-Jibanananda_Das_(1899–1954)

Bangla Kobita of Jibanananda Das #1

 

– জীবনানন্দ দাশ

তোমার শরীর —
তাই নিয়ে এসেছিলে একবার — তারপর — মানুষের ভিড়
রাত্রি আর দিন
তোমারে নিয়েছে ডেকে কোন্‌ দিকে জানি নি তা — মানুষের ভিড়
রাত্রি আর দিন
তোমারে নিয়েছে ডেকে কোনদিকে জানি নি তা — হয়েছে মলিন
চক্ষু এই — ছিঁড়ে গেছি — ফেঁড়ে গেছি — পৃথিবীর পথে হেঁটে হেঁটে
কত দিন — রাত্রি গেছে কেটে!
কত দেহ এল, গেল, হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে
দিয়েছি ফিরায়ে সব — সমুদ্রের জলে দেহ ধুয়ে
নক্ষত্রের তলে
বসে আছি — সমুদ্রের জলে
দেহ ধুয়ে নিয়া
তুমি কি আসিবে কাছে প্রিয়া!
তোমার শরীর —
তাই নিয়ে এসেছিলে একবার — তারপর — মানুষের ভিড়
রাত্রি আর দিন
তোমারে নিয়েছে ডেকে কোন্‌দিকে — ফলে গেছে কতবার,
ঝরে গেছে তৃণ!

*
আমারে চাও না তুমি আজ আর, জানি;
তোমার শরীর ছানি
মিটায় পিপাসা
কে সে আজ! — তোমার রক্তের ভালোবাসা
দিয়েছ কাহারে!
কে বা সেই! — আমি এই সমুদ্রের পারে
বসে আছি একা আজ — ঐ দূর নক্ষত্রের কাছে
আজ আর প্রশ্ন নাই — মাঝরাতে ঘুম লেগে আছে
চক্ষে তার — এলোমেলো রয়েছে আকাশ!
উচ্ছৃঙ্খল বিশৃঙ্খলা! — তারই তলে পৃথিবীর ঘাস
ফলে ওঠে — পৃথিবীর তৃণ
ঝড়ে পড়ে — পৃথিবীর রাত্রি আর দিন
কেটে যায়!
উচ্ছৃঙ্খল বিশৃঙ্খলা — তারই তলে হায়!

*
জানি আমি — আমি যাব চলে
তোমার অনেক আগে;
তারপর, সমুদ্র গাহিবে গান বহুদিন —
আকাশে আকাশে যাবে জ্বলে
নক্ষত্র অনেক রাত আরো,
নক্ষত্র অনেক রাত আরো,
(যদিও তোমারও
রাত্রি আর দিন শেষ হবে
একদিন কবে!)
আমি চলে যাব, তবু, সমুদ্রের ভাষা
রয়ে যাবে — তোমার পিপাসা
ফুরাবে না পৃথিবীর ধুলো মাটি তৃণ
রহিবে তোমার তরে — রাত্রি আর দিন
রয়ে যাবে রয়ে যাবে তোমার শরীর,
আর এই পৃথিবীর মানুষের ভিড়।

*
আমারে খুজিয়াছিলে তুমি একদিন —
কখন হারায়ে যাই — এই ভয়ে নয়ন মলিন
করেছিলে তুমি! —
জানি আমি; তবু, এই পৃথিবীর ফসলের ভূমি
আকাশের তারার মতন
ফলিয়া ওঠে না রোজ — দেহ ঝরে — ঝরে যায় মন
তার আগে!
এই বর্তমান — তার দু — পায়ের দাগে
মুছে যায় পৃথিবীর পর,
একদিন হয়েছে যা তার রেখা, ধূলার অক্ষর!
আমারে হারায়ে আজ চোখ ম্লান করিবে না তুমি —
জানি আমি; পৃথিবীর ফসলের ভূমি
আকাশের তারার মতন
ফলিয়া ওঠে না রোজ —
দেহ ঝরে, তার আগে আমাদের ঝরে যায় মন!

*
আমার পায়ের তলে ঝরে যায় তৃণ —
তার আগে এই রাত্রি — দিন
পড়িতেছে ঝরে!
এই রাত্রি, এই দিন রেখেছিলে ভরে
তোমার পায়ের শব্দে, শুনেছি তা আমি!
কখন গিয়েছে তবু থামি
সেই শব্দে! — গেছ তুমি চলে
সেই দিন সেই রাত্রি ফুরায়েছে বলে!
আমার পায়ের তলে ঝরে নাই তৃণ —
তবু সেই রাত্রি আর দিন
পড়ে গেল ঝ’রে।
সেই রাত্রি — সেই দিন — তোমার পায়ের শব্দে রেখেছিলে ভরে!

*
জানি আমি, খুঁজিবে না আজিকে আমারে
তুমি আর; নক্ষত্রের পারে
যদি আমি চলে যাই,
পৃথিবীর ধুলো মাটি কাঁকরে হারাই
যদি আমি —
আমারে খুঁজিতে তবু আসিবে না আজ;
তোমার পায়ের শব্দ গেল কবে থামি
আমার এ নক্ষত্রের তলে! —
জানি তবু, নদীর জলের মতো পা তোমার চলে —
তোমার শরীর আজ ঝরে
রাত্রির ঢেউয়ের মতো কোনো এক ঢেউয়ের উপরে!
যদি আজ পৃথিবীর ধুলো মাটি কাঁকরে হারাই
যদি আমি চলে যাই
নক্ষত্রের পারে —
জানি আমি, তুমি আর আসিবে না খুঁজিতে আমারে!

*
তুমি যদি রহিতে দাঁড়ায়ে!
নক্ষত্র সরিয়া যায়, তবু যদি তোমার দু — পায়ে
হারায়ে ফেলিতে পথ — চলার পিপাসা! —
একবারে ভালোবেসে — যদি ভালোবাসিতে চাহিতে তুমি সেই ভালোবাসা।
আমার এখানে এসে যেতে যদি থামি! —
কিন্তু তুমি চলে গেছ, তবু কেন আমি
রয়েছি দাঁড়ায়ে!
নক্ষত্র সরিয়া যায় — তবু কেন আমার এ পায়ে
হারায়ে ফেলেছি পথ চলার পিপাসা!
একবার ভালোবেসে কেন আমি ভালোবাসি সেই ভালোবাসা!

*
চলিতে চাহিয়াছিলে তুমি একদিন
আমার এ পথে — কারণ, তখন তুমি ছিলে বন্ধুহীন।
জানি আমি, আমার নিকটে তুমি এসেছিলে তাই।
তারপর, কখন খুঁজিয়া পেলে কারে তুমি! — তাই আস নাই
আমার এখানে তুমি আর!
একদিন কত কথা বলেছিলে, তবু বলিবার
সেইদিনও ছিল না তো কিছু — তবু বলিবার
আমার এ পথে তুমি এসেছিলে — বলেছিলে কত কথা —
কারণ, তখন তুমি ছিলে বন্ধুহীন;
আমার নিকটে তুমি এসেছিলে তাই;
তারপর, কখন খুঁজিয়া পেলে কারে তুমি — তাই আস নাই!

*
তোমার দু চোখ দিয়ে একদিন কতবার চেয়েছ আমারে।
আলো অন্ধকারে
তোমার পায়ের শব্দ কতবার শুনিয়াছি আমি!
নিকটে নিকটে আমি ছিলাম তোমার তবু সেইদিন —
আজ রাত্রে আসিয়াছি নামি
এই দূর সমুদ্রের জলে!
যে নক্ষত্র দেখ নাই কোনোদিন, দাঁড়ায়েছি আজ তার তলে!
সারাদিন হাঁটিয়াছি আমি পায়ে পায়ে
বালকের মতো এক — তারপর, গিয়েছি হারায়ে
সমুদ্রের জলে,
নক্ষত্রের তলে!
রাত্রে, অন্ধকারে!
তোমার পায়ের শব্দ শুনিব না তবু আজ — জানি আমি,
আজ তবু আসিবে না খুঁজিতে আমারে!

*
তোমার শরীর —
তাই নিয়ে এসেছিলে একবার — তারপর, মানুষের ভিড়
রাত্রি আর দিন।
তোমারে নিয়েছে ডেকে কোন্‌দিকে জানি নি তা — হয়েছে মলিন
চক্ষু এই — ছিঁড়ে গেছি — ফেঁড়ে গেছি — পৃথিবীর পথে হেঁটে হেঁটে
কত দিন — রাত্রি গেছে কেটে
কত দেহ এল, গেল — হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে
দিয়েছি ফিরায়ে সব — সমুদ্রের জলে দেহ ধুয়ে
নক্ষত্রের তলে
বসে আছি — সমুদ্রের জলে
দেহ ধুয়ে নিয়া
তুমি কি আসিবে কাছে প্রিয়া!

Bangla Kobita of Jibanananda Das #2

 

– জীবনানন্দ দাশ

ঐখানে সারা দিন উঁচু ঝাউবন খেলা করে
হলদে সবুজ নীল রঙ্গ তার বুকে;
পাখি মেঘ রৌদ্রের;
তবু আজও হদয়ের গভীর অসুখে
মানবেরা পড়ে আছে কেন।

আজ অন্ধ শতাব্দীর শতচ্ছিদ্রতার
ভিতর আলোর খোঁজে যদি চলে যায়
তবুও শাশ্বত হয়ে থাকে অন্ধকার।

নতুন যুগের জন্য তবুও প্রয়ান করা ভালো।
চিতল হরিণ ঐ শিঙ তুলে ফিকে জোছনায়
হরিণী কে খোঁজে তবু পাবে না কখনও;
ব্যাঘ্র যুগে শুধু মৃত হরিণীর মাংস পাওয়া যায়।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #3

 

– জীবনানন্দ দাশ

আমি এই অঘ্রাণেরে ভালোবাসি- বিকেলের এই রঙ- রঙের শূন্যতা
রোদের নরম রোম- ঢালু মাঠ- বিবর্ণ বাদামি পাখি- হলুদ বিচালি
পাতা কুড়াবার দিন ঘাসে-ঘাসে- কুড়ুনির মুখে তাই নাই কোনো কথা,

ধানের সোনার কাজ ফুরায়েছে- জীবনেরে জেনেছে সে- কুয়াশায় খালি
তাই তার ঘুম পায়- খেত ছেড়ে দিয়ে যাবে এখনি সে- খেতের ভিতর
এখনি সে নেই যেন- ঝ’রে পড়ে অঘ্রাণের এই শেষ বিষণ্ণ সোনালি

তুলিটুকু;- মুছে যায়;- কেউ ছবি আঁকিবে না মাঠে-মাঠে যেন তারপর,
আঁকিতে চায় না কেউ,- এখন অঘ্রাণ এসে পৃথিবীর ধরেছে হৃদয়;
একদিন নীল ডিম দেখিনি কি?- দুটো পাখি তাদের নীড়ের মৃদু খড়

সেইখানে চুপে চুপে বিছায়েছে;- তবু নীড়- তবু ডিম,- ভালোবাসা
সাধ শেষ হয়
তারপর কেউ তাহা চায় নাকো- জীবনের অনেক দেয়- তবুও জীবন
আমাদের ছুটি দেয় তারপর- একখানা আধখানা লুকানো বিস্ময়

অথবা বিস্ময় নয়- শুধু শান্তি- শুধু হিম কোথায় যে রয়েছে গোপন
অঘ্রাণ খুলেছে তারে- আমার মনের থেকে কুড়ায়ে করেছে আহরণ।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #4

 

– জীবনানন্দ দাশ

‘জানি আমি তোমার দু’চোখ আজ আমাকে খোঁজে না আর পৃথিবীর’ পরে-
বলে চুপে থামলাম, কেবলি অশত্থ পাতা পড়ে আছে ঘাসের ভিতরে
শুকনো মিয়োনো ছেঁড়া;- অঘ্রান এসেছে আজ পৃথিবীর বনে;
সে সবের ঢের আগে আমাদের দুজনের মনে
হেমন্ত এসেছে তবু; বললে সে, ‘ঘাসের ওপরে সব বিছানো পাতার
মুখে এই নিস্তব্ধতা কেমন যে-সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার
ছড়িয়ে পড়েছে জলে; কিছুক্ষণ অঘ্রাণের অস্পষ্ট জগতে
হাঁটলাম, চিল উড়ে চলে গেছে-কুয়াশার প্রান্তরের পথে
দু-একটা সজারুর আসা-যাওয়া; উচ্ছল কলার ঝড়ে উড়ে চুপে সন্ধ্যার বাতাসে
লক্ষ্মীপেঁচা হিজলের ফাঁক দিয়ে বাবলার আঁধার গলিতে নেমে আসে;
আমাদের জীবনের অনেক অতীত ব্যাপ্তি আজো যেন লেগে আছে বহতা পাখায়
ঐ সব পাখিদের ঐ সব দূর দূর ধানক্ষেতে, ছাতকুড়োমাখা ক্লান্ত জামের শাখায়;
নীলচে ঘাসের ফুলে ফড়িঙের হৃদয়ের মতো নীরবতা
ছড়িয়ে রয়েছে এই প্রান্তরে বুকে আজ …… হেঁটে চলি….. আজ কোনো কথা
নেই আর আমাদের; মাঠের কিনারে ঢের ঝরা ঝাউফল
পড়ে আছে; খড়কুটো উড়ে এসে লেগে আছে শড়ির ভিতরে,
সজনে পাতার গুঁড়ি চুলে বেঁধে গিয়ে নড়ে-চড়ে;
পতঙ্গ পালক্‌ জল-চারি দিকে সূর্যের উজ্জ্বলতা নাশ;
আলোয়ার মতো ওই ধানগুলো নড়ে শূন্যে কী রকম অবাধ আকাশ
হয়ে যায়; সময়ও অপার-তাকে প্রেম আশা চেতনার কণা
ধরে আছে বলে সে-ও সনাতন;-কিন্তু এই ব্যর্থ ধারণা
সরিয়ে মেয়েটি তাঁর আঁচলের চোরাকাঁটা বেছে
প্রান্তর নক্ষত্র নদী আকাশের থেকে সরে গেছে
যেই স্পষ্ট নির্লিপ্তিতে-তাই-ই ঠিক;-ওখানে সিগ্ধ হয় সব।
অপ্রেমে বা প্রেমে নয়- নিখিলের বৃক্ষ নিজ বিকাশে নীরব।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #5

 

– জীবনানন্দ দাশ

অদ্ভুত আঁধার এক আসিয়াছে পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই-প্রীতি নেই-করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি,
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #6

 

– জীবনানন্দ দাশ

অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই – প্রীতি নেই – করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব’লে মনে হয়
মহত্‍‌ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #8

 

পৃথিবীর পথে আমি ফিরি যদি দেখিব সবুজ ঘাস

ফুটে উঠে—দেখিব হলুদ ঘাস ঝরে যায়—দেখিব আকাশ
শাদা হয়ে উঠে ভোরে—ছেঁড়া মুনিয়ার মত রাঙা রক্ত—রেখা
লেগে থাকে বুকে তার সন্ধ্যায়—বারবার নক্ষত্রের দেখা
পাব আমি; দেখিব অচেনা নারী আলগা খোঁপার ফাঁস
খুলে ফেলে চলে যায়—মুখে তার নাই আহা গোধূলির নরম আভাস।

অনন্ত জীবন যদি পাই আমি—তাহ’লে অসীমকাল একা
পৃথিবীর পথে যদি ফিরি আমি—ট্রাম বাস ধুলো
দেখিব অনেক আমি—দেখিব অনেকগুলো
বস্তি, হাট—এঁদো গলি, ভাঙ্গা কলকী হাড়ী
মারামারি, গালাগালি, ট্যারা চোখ, পচা চিংড়ি—কত কি দেখিব নাহি লেখা
তবুও তোমার সাথে অনন্তকালেও আর হবে নাকো’ দেখা।

অনিবার
– জীবনানন্দ দাশ
যেখানে রয়েছে আলো পাহাড় জলের সমবায়-
তবুও সেখানে যদি আবিষ্কার করি প্যারাফিন
অনেক মাটির নীচে,- অথবা সেখানে যদি সংগ্রাম-বিলীন
অজস্র অস্পষ্ট মুণ্ড অনুকম্পা হৃদয়ে জাগায়,
তাহ’লে প্রভাত এলে মনিয়া পাখিরা পিছে কি করে’ বালক
ভেসে যাবে উজ্জ্বল জলবিম্বের মত হেসে?
কি ক’রে বা নাগরিক নিজের নারীকে ভালোবেসে
জেনে নেবে হেমন্তের সন্ধ্যার আলোকে
গ্যাস আর নক্ষত্রের লিপ্সা থেকে জেগে
যারা চায় তাহাদের কাছে তবু স্মিত সমন্বয়?
মৃথেদ উপেক্ষিত পীত দেহ- বলো,- ক্ষমাময়।
বৃত্তের মতন- এসো,- ঘুরি মোরা বঙ্কিম আবেগে।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #9

 

– জীবনানন্দ দাশ

সর্বদাই এরকম নয়, তবু
মাঝে মাঝে মনে হয় কোন দূর উত্তরসাগরে কোনো ঢেউ
নেই;
তুমি আর আমি ছাড়া কেউ
সেখানে ঢোকার পথ হারিয়ে ফেলেছে

নেই
নীলকণ্ঠ পাখিদের ডানা গুঞ্জরণ
ভালোবেসে আমাদের পৃথিবীর এই রৌদ্র;
কলকাতার আকাশে চৈত্রের ভোরে যেই
নীলিমা হঠাৎ এসে দেখা দেয় মিলাবার আগে
এইখানে সে আকাশ নেই;
রাতে নক্ষত্রেরা সে রকম আলোর গুঁড়ির মতো অন্ধকার অন্তহীন নয়।

তবুও আকাশ আছেঃ
অনেক দূরের থেকে নির্নিমেষ হয়ে
নক্ষত্র দু’-একজন চেয়ে থাকে
চেয়ে থাকে আমাদের দিকে-
যেন টের পায়

পৃথিবীর কাছে আমাদের সব কথা -সব কথা বলা
ডাভেন্ট্রিডোমেই টাসে স্টেফানিতে
যুদ্ধ শান্তি বিরতি নিয়তির ফাঁদে চিরদিন
বেধে গিয়ে ব্যহত রণনে
শব্দের অপরিমেয় অচল বালির
মরুভূমি সৃষ্টি করে গেছে;
-কোনো কথা কোনো গান

কাউকেই বলে নাই;
কোন গান
পাখিরাও গায় নাই।তাই
এই পাখিহীন নীলিমাবিহীন শাদা স্তব্ধতার দেশে
তুমি আর আমি দুই বিভিন্ন রাত্রির দিক থেকে
যাত্রা করে উত্তরের সাগরের দীপ্তির ভিতরে
এখন মিশেছি

এখন বাতাসে শব্দ নেই-তবু
শুধু বাতাসের শব্দ হয়
বাতাসের মত সময়ের
কোনো রৌদ্র নেই, তবু আছে
কোনো পাখি নেই, তবু রৌদ্রে সারাদিন
হংসের আলোর কণ্ঠ র’য়ে গেছে;
কোন রাণী নেই-তবু হংসীর আশার কণ্ঠ
এইখানে সাগরের রৌদ্রে সারা দিন।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #10

 

– জীবনানন্দ দাশ

কোনো এক বিপদের গভীর বিস্ময়
আমাদের ডাকে।
পিছে-পিছে ঢের লোক আসে।
আমরা সবের সাথে ভিড়ে চাপা প’ড়ে- তবু-
বেঁচে নিতে গিয়ে
জেনে বা না-জেনে ঢের জনতাকে পিষে- ভিড় ক’রে,
করুণার ছোট বড় উপকন্ঠে- সাহসিক নগরে বন্দরে
সর্বদাই কোনো এক সমুদ্রের দিকে
সাগরের প্রয়াণে চলেছি।
সে-সমুদ্র-
জীবন বা মরণের;
হয়তো না আশার দহনে উদ্বেল।
যারা বড়ো, মহীয়ান- কোনো এক উৎকন্ঠার পথে
তবু স্থির হ’য়ে চ’লে গেছে;
একদিন নচিকেতা ব’লে মনে হ’তো তাহাদের;
একদিন আত্তিলার মতো তবু;
আজ তারা জনতার মতো।
জীবনের অবিরাম বিশৃঙ্খলা স্থির ক’রে দিতে গিয়ে তবু
সময়ের অনিবার উদ্ভাবনা এসে
যে-সব শিশুকে যুবা- প্রবীণ করেছে তারপর
তাদের চোখের আলো
অনাদির উত্তরাধিকার থেকে, নিরবচ্ছিন্ন কাজ ক’রে
তাদের প্রায়ান্ধ চোখে আজ রাত লেন্‌স,
চেয়ে দেখে চারিদিকে অগণন মৃতদের চোক্ষের ফস্‌ফোরেসেন্‌স্‌।
তাদের সম্মুখে আলো
দীনাত্মা তারার
জ্যোৎস্নার মতন।
জীবনের শুভ অর্থ ভালো ক’রে জীবনধারণ
অনুভব ক’রে তবু তাহাদের কেউ-কেউ আজ রাতে যদি
অই জীবনের সব নিঃশেষ সীমা
সমুজ্জ্বল, স্বাভাবিক হ’য়ে যাবে মনে ভেবে-
স্মরণীয় অঙ্কে কথা বলে,
তাহ’লে সে কবিতা কালিমা
মনে হবে আজ?
আজকে সমাজ
সকলের কাছ থেকে চেয়েছে কি নিরন্তর
তিমিরবিদারী অনুসূর্যের কাজ।

কাব্যগ্রন্থ – সাতটি তারার তিমির

Bangla Kobita of Jibanananda Das #11

 

– জীবনানন্দ দাশ

গানের সুরের মতো বিকালের দিকের বাতাসে
পৃথিবীর পথ ছেড়ে — সন্ধ্যার মেঘের রঙ খুঁজে
হৃদয় ভাসিয়া যায় — সেখানে সে কারে ভালোবাসে! —
পাখির মতন কেঁপে — ডানা মেলে — হিম চোখ বুজে
অধীর পাতার মতো পৃথিবীর মাঠের সবুজে
উড়ে উড়ে ঘর ছেড়ে কত দিকে গিয়েছে সে ভেসে —
নীড়ের মতন বুকে একবার তার মুখ গুঁজে
ঘুমাতে চেয়েছে, তবু — ব্যথা পেয়ে গেছে ফেঁসেঁ —
তখন ভোরের রোদে আকাশে মেঘের ঠোঁট উঠেছিল হেসে!

আলোর চুমায় এই পৃথিবীর হৃদয়ের জ্বর
কমে যায়; তাই নীল আকাশের স্বাদ–সচ্ছলতা–
পূর্ণ করে দিয়ে যায় পৃথিবীর ক্ষুধিত গহ্বর;
মানুষের অন্তরের অবসাদ — মৃত্যুর জড়তা
সমুদ্র ভাঙিয়া যায় — নক্ষত্রের সাথে কয় কথা
যখন নক্ষত্র তবু আকাশের অন্ধকার রাতে —
তখন হৃদয়ে জাগে নতুন যে — এক অধীরতা,
তাই লয়ে সেই উষ্ণ আকাশের চাই যে জড়াতে
গোধূলির মেঘে মেঘে, নক্ষত্রের মতো রব নক্ষত্রের সাথে!

আমারে দিয়েছ তুমি হৃদয়ের যে — এক ক্ষমতা
ওগো শক্তি, তার বেগে পৃথিবীর পিপাসার ভার
বাধা পায়, জেনে লয় লক্ষত্রের মতন স্বচ্ছতা!
আমারে করেছ তুমি অসহিষ্ণু — ব্যর্থ — চমৎকার!
জীবনের পারে থেকে যে দেখেছে মৃত্যুর ওপার,
কবর খুলেছে মুখ বার বার যার ইশারায়,
বীণার তারের মতো পৃথিবীর আকাঙক্ষার তার
তাহার আঘাত পেয়ে কেঁপে কেঁপে ছিড়ে শুধু যায়!
একাকী মেঘের মতো ভেসেছে সে — বৈকালের আলোয় — সন্ধ্যায়!

সে এসে পাখির মতো স্থির হয়ে বাঁধে নাই নীড় —
তাহার পাখায় শুধু লেগে আছে তীর — অস্থিরতা!
অধীর অন্তর তারে করিয়াছে অস্থির — অধীর!
তাহারই হৃদয় তারে দিয়েছে ব্যাধের মতো ব্যথা!
একবার তাই নীল আকাশের আলোর গাঢ়তা
তাহারে করেছে মুগ্ধ — অন্ধকার নক্ষত্র আবার
তাহারে নিয়েছে ডেকে — জেনেছে সে এই চঞ্চলতা
জীবনের; উড়ে উড়ে দেখেছে সে মরণের পার
এই উদ্বেলতা লয়ে নিশীথের সমুদ্রের মতো চমৎকার!

গোধূলির আলো লয়ে দুপুরে সে করিয়াছে খেলা,
স্বপ্ন দিয়ে দুই চোখ একা একা রেখেছে ঢাকি;
আকাশে আঁধার কেটে গিয়েছে যখন ভোরবেলা
সবাই এসেছে পথে, আসে নাই তবু সেই পাখি! —
নদীর কিনারে দূরে ডানা মেলে উড়েছে একাকী,
ছায়ার উপরে তার নিজের পাখায় ছায়া ফেলে
সাজায়েছে স্বপ্নের পরে তার হৃদয়ের ফাঁকি!
সূর্যের আলোর পরে নক্ষত্রের মতো আলো জ্বেলে
সন্ধ্যার আঁধার দিয়ে দিন তার ফেলেছে সে মুছে অবহেলে!

কেউ তারে দেখে নাই; মানুষের পথ ছেড়ে দূরে
হাড়ের মতন শাখা ছায়ার মতন পাতা লয়ে
যেইখানে পৃথিবীর মানুষের মতো ক্ষব্ধ হয়ে
কথা কয়, আকাঙক্ষার আলোড়নে চলিতেছে বয়ে
হেমন্তের নদী, ঢেউ ক্ষুধিতের মতো এক সুরে
হতাশ প্রাণের মতো অন্ধকারে ফেলিছে নিশ্বাস
তাহাদের মতো হয়ে তাহাদের সাথে গেছি রয়ে;
দূরে প’ড়ে পৃথিবীর ধূলা — মাটি — নদী — মাঠ — ঘাস —
পৃথিবীর সিন্ধু দূরে — আরো দূরে পৃথিবীর মেঘের আকাশ!

এখানে দেখেছি আমি জাগিয়াছ হে তুমি ক্ষমতা,
সুন্দর মুখের চেয়ে তুমি আরো ভীষণ, সুন্দর!
ঝড়ের হাওয়ার চেয়ে আরো শক্তি, আরো ভীষণতা
আমারে দিয়েছে ভয়! এইখানে পাহাড়ের পর
তুমি এসে বসিয়াছ — এই খানে অশান্ত সাগর
তোমারে এনেছি ডেকে — হে ক্ষমতা, তোমার বেদনা
পাহাড়ের বনে বনে তুলিতেছে বিদ্যুতের ফণা
তোমার স্ফুলিঙ্গ আমি, ওগো শক্তি — উল্লাসের মতন যন্ত্রণা!

আমার সকল ইচ্ছা প্রার্থনার ভাষার মতন
প্রেমিকের হৃদয়ের গানের মতন কেঁপে উঠে
তোমার প্রাণের কাছে একদিন পেয়েছে কখন!
সন্ধ্যার আলোর মতো পশ্চিম মেঘের বুকে ফুটে,
আঁধার রাতের মতো তারার আলোর দিকে ছুটে,
সিন্ধুর ঢেউয়ের মতো ঝড়ের হাওয়ার কোলে জেগে
সব আকাঙক্ষার বাঁধ একবার গেছে তার টুটে!
বিদ্যুতের পিছে পিছে ছুটে গেছি বিদ্যুতের বেগে!
নক্ষত্রের মতো আমি আকাশের নক্ষত্রের বুকে গেছি লেগে!

যে মুহূর্ত চলে গেছে — জীবনের যেই দিনগুলি
ফুরায়ে গিয়েছে সব, একবার আসে তারা ফিরে;
তোমার পায়ের চাপে তাদের করেছ তুমি ধূলি!
তোমার আঘাত দিয়ে তাদের গিয়েছ তুমি ছিঁড়ে!
হে ক্ষমতা, মনের ব্যথার মতো তাদের শরীরে
নিমেষে নিমেষে তুমি কতবার উঠেছিলে জেগে!
তারা সব ছলে গেছে — ভূতুড়ে পাতার মতো ভিড়ে
উত্তর — হাওয়ার মতো তুমি আজও রহিয়াছ লেগে!
যে সময় চলে গেছে তাও কাপে ক্ষমতার বিষ্ময়ে — আবেগে!

তুমি কাজ করে যাও, ওগো শক্তি, তোমার মতন!
আমারে তোমার হাতে একাকী দিয়েছি আমি ছেড়ে;
বেদনা — উল্লাসে তাই সমুদ্রের মতো ভরে মন! —
তাই কৌতুহল — তাই ক্ষুধা এসে হৃদয়েরে ঘেরে,
জোনাকির পথ ধরে তাই আকাশের নক্ষত্রেরে
দেখিতে চেয়েছি আমি, নিরাশার কোলে বসে একা
চেয়েছি আশারে আমি, বাঁধনের হাতে হেরে হেরে
চাহিয়াছি আকাশের মতো এক অগাধের দেখা! —
ভোরের মেঘের ঢেউয়ে মুছে দিয়ে রাতের মেঘের কালো রেখা!

আমিপ্রণয়িনী, তুমি হে অধীর, আমার প্রণয়ী!
আমার সকল প্রেম উঠেছে চোখের জলে ভেসে! —
প্রতিধ্বনির মতো হে ধ্বনি, তোমার কথা কহি
কেঁপে উঠে — হৃদয়ের সে যে কত আবেগে আবেশে!
সব ছেড়ে দিয়ে আমি তোমারে একাকী ভালোবেসে
তোমার ছায়ার মতো ফিরিয়াছি তোমার পিছনে!
তবুও হারায়ে গেছ, হঠাৎ কখন কাছে এসে
প্রেমিকের মতো তুমি মিশেছ আমার মনে মনে
বিদ্যুৎ জ্বালায়ে গেছ, আগুন নিভায়ে গেছ হঠাৎ গোপনে!

কেন তুমি আস যাও? — হে অস্থির, হবে নাকি ধীর!
কোনোদিন? — রৌদ্রের মতন তুমি সাগরের পরে
একবার — দুইবার জ্বলে উঠে হতেছ অস্থির! —
তারপর, চলে যাও কোন দূরে পশ্চিমে — উত্তরে —
ইন্দ্রধনুকের মতো তুমি সেইখানে উঠিতেছ জ্বলে,
চাঁদের আলোর মতো একবার রাত্রির সাগরে
খেলা কর — জোছনা চলে যায়, তবু তুমি যাও চলে
তার আগে; যা বলেছ একবার, যাবে নাকি আবার তা বলে!

যা পেয়েছি একবার, পাব নাকি আবার তা খুঁজে!
যেই রাত্রি যেই দিন একবার কয়ে গেল কথা
আমি চোখ বুজিবার আগে তারা গেল চোখ বুজে,
ক্ষীণ হয়ে নিভে গেল সলিতার আলোর স্পষ্টতা!
ব্যথার বুকের’ পরে আর এক ব্যথা — বিহ্বলতা
নেমে এল উল্লাস ফুরায়ে গেল নতুন উৎসবে;
আলো অন্ধকার দিয়ে বুনিতেছে শুধু এই ব্যথা,
দুলিতেছি এই ব্যথা — উল্লাসের সিন্ধুর বিপ্লবে!
সব শেষ হবে — তবু আলোড়ন, তা কি শেষ হবে!

সকল যেতেছে চলে — সব যায় নিভে — মুছে — ভেসে —
যে সুর থেমেছে তার স্মৃতি তবু বুকে জেগে রয়!
যে নদী হারায়ে যায় অন্ধকারে — রাতে — নিরুদ্দেশে,
তাহার চঞ্চল জল স্তব্ধ হয়ে কাঁপায় হৃদয়!
যে মুখ মিলায়ে যায় আবার ফিরিতে তারে হয়
গোপনে চোখের’ পরে — ব্যথিতের স্বপ্নের মতন!
ঘুমন্তের এই অশ্রু — কোন্‌ পীড়া — সে কোন্‌ বিস্ময়
জানায়ে দিতেছে এসে! — রাত্রি — দিন আমাদের মন
বর্তমান অতীতের গুহা ধরে একা একা ফিরিছে এমন!

আমরা মেঘের মতো হঠাৎ চাঁদের বুকে এসে
অনেক গভীর রাতে — একবার পৃথিবীর পানে
চেয়ে দেখি, আবার মেঘের মতো চুপে চুপে ভেসে
চলে যাই এক ক্ষীণ বাতাসের দুর্বল আহ্বানে
কোন্‌ দিকে পথ বেয়ে! — আমাদের কেউ কি তা জানে।
ফ্যাকাশে মেঘের মতো চাঁদের আকাশ পিছে রেখে
চলে যাই; কোন্‌ — এক রুগ্ন হাত আমাদের টানে?
পাখির মায়ের মতো আমাদের নিতেছে সে ডেকে
আরো আকাশের দিকে — অন্ধকারে, অন্য কারো আকাশের থেকে!

একদিন বুজিবে কি চারি দিকে রাত্রির গহ্বর!
নিবন্ত বাতির বুকে চুপে চুপে যেমন আঁধার
চলে আসে, ভালোবেসে — নুয়ে তার চোখের উপর
চুমো খায়, তারপর তারে কোলে টেনে লয় তার —
মাথার সকল স্বপ্ন, হৃদয়ের সকল সঞ্চার
একদিন সেই শূন্য সেই শীত — নদীর উপরে
ফুরাবে কি? দুলে দুলে অন্ধকারে তবুও আবার
আমার রক্তের ক্ষুধা নদীর ঢেউয়ের মতো স্বরে
গান গাবে, আকাশ উঠিবে কেঁপে আবার সে সংগীতের ঝড়ে!

পৃথিবীর — আকাশের পুরানো কে আত্মার মতন,
জেগে আছি; বাতাসের সাথে সাথে আমি চলি ভেসে,
পাহাড়ে হাওয়ার মতো ফিরিতেছে একা একা মন,
সিন্ধুর ঢেউয়ের মতো দুপুরের সমুদ্রের শেষে
চলিতেছে; কোন্‌ — এক দূর দেশ — কোন্‌ নিরুদ্দেশে
জন্ম তার হয়েছিল — সেইখানে উঠেছে সে বেড়ে;
দেহের ছায়ার মতো আমার মনের সাথে মেশে
কোন্‌ স্বপ্ন? — এ আকাশ ছেড়ে দিয়ে কোন্‌ আকাশেরে
খুঁজে ফিরি! — গুহার হাওয়ার মতো বন্দি হয়ে মন তব ফেরে!

গাছের শাখার জালে এলোমেলো আঁধারের মতো
হৃদয় খুঁজিছে পথ, ভেসে ভেসে — সে যে কারে চায়!
হিমেল হাওয়ার হাত তার হাড় করিছে আহত,
সেও কি শাখার মতো — পাতার মতন ঝরে যায়!
বনের বুকের গান তার মতো শব্দ করে গায়!
হৃদয়ের সুর তার সে যে কবে ফেলেছে হারায়ে!
অন্তরের আকাঙ্ক্ষারে — স্বপনেরে বিদায় জানায়
জীবন মৃত্যুর মাঝে চোখ বুজে একাকী দাঁড়ায়ে;
ঢেউয়ের ফেনার মতো ক্লান্ত হয়ে মিশিবে কি সে — ঢেউয়ের গায়ে!

হয়তো সে মিশে গেছে — তারে খুঁজে পাবে নাকো কেউ!
কেন যে সে এসেছিল পৃথিবীর কেহ কি তা জানে!
শীতের নদীর বুকে অস্থির হয়েছে যেই ঢেউ
শুনেছে সে উষ্ণ গান সমুদ্রের জলের আহ্বানে!
বিদ্যুতের মতো অল্প আয়ু তবু ছিল তার প্রাণে,
যে ঝড় ফুরায়ে যায় তাহার মতন বেগ লয়ে
যে প্রেম হয়েছে ক্ষুব্ধ সেই ব্যর্থ প্রেমিকের গানে
মিলায়েছে গান তার, তারপর চলে গেছে রয়ে।
সন্ধ্যার মেঘের রঙ কখন গিয়েছে তার অন্ধকার হয়ে!

তবুও নক্ষত্র এক জেগে আছে, সে যে তারে ডাকে!
পৃথিবী চায় নি যারে, মানুষ করেছে যারে ভয়
অনেক গভীর রাতে তারায় তারায় মুখ ঢাকে
তবুও সে! কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ চোখে ছবি দেখে একা জেগে রয়!
মানুষীর মতো? কিংবা আকাশের তারাটির মতো —
সেই দূর — প্রণয়িনী আমাদের পৃথিবীর নয়!
তার দৃষ্টি — তাড়নায় করেছে যে আমারে ব্যাহত —
ঘুমন্ত বাঘের বুকে বিষের বাণের মতো বিষম সে ক্ষত!

আলো আর অন্ধকারে তার ব্যথা — বিহ্বলতা লেগে,
তাহার বুকের রক্তে পৃথিবী হতেছে শুধু লাল! —
মেঘের চিলের মতো — দুরন্ত চিতার মতো বেগে
ছুটে যাই — পিছে ছুটে আসিতেছে বৈকাল — সকাল
পৃথিবীর — যেন কোন্‌ মায়াবীর নষ্ট ইন্দ্রজাল
কাঁদিতেছে ছিঁড়ে গিয়ে! কেঁপে কেঁপে পড়িতেছে ঝরে!
আরো কাছে আসিয়াছি তবু আজ — আরো কাছে কাল
আসিব তবুও আমি — দিন রাত্রি রয় পিছে পড়ে —
তারপর একদিন কুয়াশার মতো সব বাধা যাবে সরে!

সিন্ধুর ঢেউয়ের তলে অন্ধকার রাতের মতন
হৃদয় উঠিতে আছে কোলাহলে কেঁপে বারবার!
কোথায় রয়েছে আলো জেনেছে তা, বুঝেছে তা মন —
চারি দিকে ঘিরে তারে রহিয়াছে যদিও আঁধার!
একদিন এই গুহা ব্যথা পেয়ে আহত হিয়ার
বাঁধন খুলিয়া দেবে! অধীর ঢেউয়ের মতো ছুটে
সেদিন সে খুঁজে লবে অই দুরে নক্ষত্রের পার!
সমুদ্রের অন্ধকারে গহ্বরের ঘুম থেকে উঠে
দেখিবে জীবন তার খুলে গেছে পাখির ডিমের মতো ফুটে!

Bangla Kobita of Jibanananda Das #12

 

– জীবনানন্দ দাশ

অনেক নদীর জল উবে গেছে —
ঘরবাড়ি সাকো ভেঙে গেল;
সে সব সময় ভেদ করে ফেলে আজ
কারা তবু কাছে চলে এল
যে সুর্য অয়নে নেই কোনো দিন,
— মনে তাকে দেকা যেত যদি —
যে নারী দেখে নি কেউ — ছ-সাতটি তারার তিমিরে
হৃদয়ে এসেছে সেই নদী।
তুমি কথা বল — আমি জীবন-মৃত্যুর শব্দ শুনি:
সকালে শিশির কণা যে-রকম ঘাসে
অচিরে মরণশীল হয়ে তবু সূর্যে আবার
মৃত্যু মুখে নিয়ে পরদিন ফিরে আসে।
জন্মতারকার ডাকে বার বার পৃথিবীতে ফিরে এসে আমি
দেখেছি তোমার চোখে একই ছায়া পড়ে:
সে কি প্রেম? অন্ধকার? — ঘাস ঘুম মৃত্যু প্রকৃতির
অন্ধ চলাচলের ভিতরে।
স্থির হয়ে আছে মন; মনে হয় তবু
সে ধ্রুব গতির বেগে চলে,
মহা-মহা রজনীর ব্রহ্মান্ডকে ধরে;
সৃষ্টির গভীর গভীর হংসী প্রেম
নেমেছে — এসেছে আজ রক্তের ভিতরে।

‘এখানে পৃথিবী আর নেই–‘
ব’লে তারা পৃথিবরি জনকল্যাণেই
বিদায় নিয়েছে হিংসা ক্লান্তির পানে;
কল্যাণ, কল্যাণ; এই রাত্রির গবীরতর মানে।
শান্তি এই আজ;
এইখানে স্মৃতি;
এখানে বিস্মৃতি তবু; প্রেম
ক্রমায়াত আঁধারকে আলোকিত করার প্রমিতি।

কাব্যগ্রন্থ – বেলা অবেলা কালবেলা

Bangla Kobita of Jibanananda Das #13

 

– জীবনানন্দ দাশ

অনেক মুহূর্ত আমি করেছি ক্ষয়
করে ফেলে বুঝছি সময়
যদিও অনন্ত, তবু প্রেম যেন অনন্ত নিয়ে নয়।

তবু তোমাকে ভালোবেসে
মুহূর্তের মধ্যে ফিরে এসে
বুঝেছি অকূলে জেগে রয়
ঘড়ির সময়ে আর মহাকালে যেখানেই রাখি এ হৃদয় ।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #14

 

– জীবনানন্দ দাশ

গভীর অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠলাম আবার;
তাকিয়ে দেখলাম পান্ডুর চাঁদ বৈতরণীর থেকে তার অর্ধেক ছায়া
গুটিয়ে নিয়েছে যেন
কীর্তিনাশার দিকে ।

ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়েছিলাম- পউষের রাতে-
কোনদিন আর জাগবো না জেনে
কোনদিন জাগবো না আমি- কোনোদিন জাগবো না আর-
হে নীল কস্তুরী আভার চাঁদ,
তুমি দিনের আলো নও, উদম্য নও, স্বপ্ন নও,
হৃদয়ে যে মৃত্যুর শান্তি ও স্থিরতা রয়েছে,
রয়েছে যে অগাধ ঘুম,
সে-আস্বাদ নষ্ট করবার মতো শেলতীব্রতা তোমার নেই,
তুমি প্রদাহ প্রবহমান যন্ত্রণা নও–

জানো না কি চাঁদ,
নীল কস্তুরী আভার চাঁদ,
জানো না কি নিশীথ,
আমি অনেক দিন– অনেক অনেক দিন
অন্ধকারের সারাতসারে অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থেকে
হঠাত ভোরের আলোর মুর্খ উচ্ছাসে নিজেকে পৃথিবীর জীব ব’লে
বুঝতে পেরেছি আবার,
ভয় পেয়েছি,
পেয়েছি অসীম দুনির্বার বেদনা;
দেখেছি রক্তিম আকাশে সূর্য জেগে উঠে
মানুষিক সৈনিক সেজে পৃথিবীর মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্য
আমাকে নির্দেশ দিয়েছে;

আমার সমস্ত হৃদয় ঘৃণায়- বেদনায়- আক্রোশে ভরে গিয়েছে ;
সূর্যের রৌদ্রে আক্রান্ত এই পৃথিবী যেন কোটি কোটি শুয়োরের আর্তনাদে
উৎসব শুরু করেছে।
হায়, উৎসব!

হৃদয়ের অবিরল অন্ধকারের ভিতর সূর্যকে ডুবিয়ে ফেলে
আবার ঘুমোতে চেয়েছি আমি, অন্ধকারের স্তনের ভিতর যোনির ভিতর অনন্ত মৃত্যুর
মতো মিশে থাকতে চেয়েছি।

কোনোদিন মানুষ ছিলাম না আমি।
হে নর, হে নারী ,
তোমাদের পৃথিবীকে চিনিনি কোনোদিন ;
আমি অন্য কোন নক্ষত্রের জীব নই।

যেখানে স্পন্দন, সংঘর্ষ, গীত, যেখানে উদ্যম, চিন্তা, কাজ,
সেখানেই সূর্য , পৃথিবী, বৃহস্প্রতি, কালপুরুষ, অনন্ত আকাশগ্রন্থি,
শত শত শুকরীর প্রসব বেদনার আড়ম্বর ;
এইসব ভয়াবহ আরতী!

গভীর অন্ধকারের ঘুমের আস্বাদে আমার আত্মা লালিত;
আমাকে জাগাতে চাও কেন?
অরব অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠবো না আর ;
তাকিয়ে দেখবো না নির্জন বিমিশ্র চাঁদ বৈতরণীর থেকে
অর্ধেক ছায়া গুটিয়ে নিয়েছে
কীর্তিনাশার দিকে ।

ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়ে থাকবো- ধীরে- পউষের রাতে
কোনোদিন জাগব না জেনে-
কোনদিন জাগব না আমি- কোনদিন আর।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #15

 

– জীবনানন্দ দাশ

গাঢ় অন্ধকার থেকে আমরা এ-পৃথিবীর আজকের মুহূর্তে এসেছি।
বীজের ভেতর থেকে কী ক’রে অরণ্য জন্ম নেয়,-
জলের কণার থেকে জেগে ওঠে নভোনীল মহান সাগর,
কী ক’রে এ-প্রকৃতিতে—পৃথিবীতে, আহা,
ছায়াচ্ছন্ন দৃষ্টি নিয়ে মানব প্রথম এসেছিল,
আমরা জেনেছি সব,—অনুভব করেছি সকলই।
সূর্য জেলে,—কল্লোল সাগর জল কোথাও দিগন্তে আছে, তাই
শুভ্র অপলক সব শঙ্খের মতন
আমাদের শরীরের সিন্ধু-তীর।

এই সব ব্যাপ্ত অনুভব থেকে মানুষের স্মরণীয় মন
জেগে ব্যথা বাধা ভয় রক্তফেনশীর্ষ ঘিরে প্রাণে
সঞ্চারিত ক’রে গেছে আশা আর আশা;
সকল অজ্ঞান কবে জ্ঞান আলো হবে,
সকল লোভের চেয়ে সৎ হবে না কি
সব মানুষের তরে সব মানুষের ভালোবাসা।

আমরা অনেক যুগ ইতিহাসে সচকিত চোখ মেলে থেকে
দেখেছি আসন্ন সূর্য আপনাকে বলয়িত ক’রে নিতে জানে
নব নব মৃত সূর্যে শীতে;
দেখেছি নির্ঝর নদী বালিয়াড়ি মরুর উঠানে
মরণের-ই নামরূপ অবিরল কী যে।

তবু শ্মশান থেকে দেখেছি চকিত রৌদ্রে কেমন জেগেছে শালিধান;
ইতিহাস-ধূলো-বিষ উৎসারিত ক’রে নব নবতর মানুষের প্রাণ
প্রতিটি মৃত্যুর স্তর ভেদ ক’রে এক তিল বেশি
চেতনার আভা নিয়ে তবু
খাঁচার পাখির কাছে কী নীলাভ আকাশ-নির্দেশী!
হয়তো এখনো তাই;—তবু
রাত্রি শেষ হলে রোজ পতঙ্গ-পালক-পাতা
শিশির-নিঃসৃত শুভ্র ভোরে
আমরা এসেছি আজ অনেক হিংসার খেলা অবসান ক’রে;
অনেক দ্বেসের ক্লান্তি মৃত্যু দেখে গেছি।
আজো তবু
আজো ঢের গ্লানি-কলঙ্কিত হয়ে ভাবিঃ
রক্তনদীদের পারে পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির
শোকাবহ অঙ্ক কঙ্কালে কি মাছি তোমাদের মৌমাছির নীড়
অল্পায়ু সোনালি রৌদ্রে;
প্রেমের প্রেরণা নেই—শুধু নির্ঝ্রিত শ্বাস
পণ্যজাত শরীরের মৃত্যু-ম্লান পণ্য ভালোবেসে;
তবুও হয়তো আজ তোমার উড্ডীন নব সূর্যের উদ্দেশ্য।

ইতিহাসে-সঞ্চারিত হে বিভিন্ন জাতি, মন, মানব-জীবন,
এই পৃথিবীর মুখ যত বেশি চেনা যায়—চলা যায় সময়ের পথে,
তত বেশি উওরণ সত্য নয়;—জানি; তবু জ্ঞানের বিষণ্ণলোকী আলো
অধিক নির্মল হলে নটীর প্রেমের চেয়ে ভালো
সফল মানব প্রেমে উৎসারিত হয় যদি, তবে
নব নদী নব নীড় নগরী নীলিমা সৃষ্টি হবে।
আমরা চলেছি সেই উজ্জ্বল সূর্যের অনুভবে।

কাব্যগ্রন্থ – বেলা অবেলা কালবেলা

Bangla Kobita of Jibanananda Das #16

 

– জীবনানন্দ দাশ

বিকেলবেলা গড়িয়ে গেলে অনেক মেঘের ভিড়
কয়েক ফলা দীর্ঘতম সূর্যকিরণ বুকে
জাগিয়ে তুলে হলুদ নীল কমলা রঙের আলোয়
জ্বলে উঠে ঝরে গেল অন্ধকারের মুখে।
যুবারা সব যে যার ঢেউয়ে-
মেয়েরা সব যে যার প্রিয়ের সাথে
কোথায় আছে জানি না তোঃ
কোথায় সমাজ, অর্থনীতি?- স্বর্গগামী সিঁড়ি
ভেঙ্গে গিয়ে পায়ের নিচে রক্তনদীর মতো
মানব ক্রমপরিণতির পথে লিঙ্গশরীরী
হয়ে কি আজ চারি দিকে গণনাহীন ধূসর দেয়ালে
ছড়িয়ে আছে যে যার দ্বৈপসাগর দখল করে’?
পুরাণপুরুষ, গনমানুষ, নারীপুরুষ,্মানবতা, অসংখ্য বিপ্লব
অর্থবিহীন হয়ে গেলে-তবুও আরেক নবীনতর ভোরে
সার্থকতা পাওয়া যাবে, ভেবে মানুষ সঞ্চারিত হয়ে
পথে পথে সবের শুভ নিকেতনের সমাজ বানিয়ে
তবুও কেবল দ্বীপ বানালো যে যার অবক্ষয়ের জলে।
প্রাচীন কথা নতুন করে’ এই পৃথিবীর বোন-ভায়ে
ভাবছে একাএকা বসে’
যুদ্ধ রক্ত রিরংসা ভয় কলরোলের ফাঁকেঃ
আমাদের এই আকাশ সাগর আধাঁর আলোয় আজ
যে দৌড় কঠিন; নেই মনে হয়- সে দ্বার খুলে দিয়ে যেতে হবে
আবার আলোয়, অসাড় আলোর ব্যাসন ছাড়িয়ে।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #17

 

– জীবনানন্দ দাশ

মাছরাঙা চ’লে গেছে — আজ নয় কবেকার কথা;
তারপর বারবার ফিরে এসে দৃশ্যে উজ্জল।
দিতে চেয়ে মানুষের অবহেলা উপেক্ষায় হ’য়ে গেছে ক্ষয়;
বেদনা পেয়েছে তবু মানুষের নিজেরও হৃদয়
প্রকৃতির অনির্বচনীয় সব চিহ্ন থেকে দু’ চোখ ফিরিয়ে;
বুদ্ধি আর লালসার সাধনাকে সব চেয়ে বড় ভেবে নিয়ে।

মাছরাঙা চ’লে গেছে — আজ নয় কবেকার কথা;
তারপর বারবার ফিরে এসে ডানাপালকের উজ্জলতা
ক্ষয় ক’রে তারপর হয়ে গেছে ক্ষয়।
মাছরাঙা মানুষের মতো সূর্য নয়?
কাজ করে কথা ব’লে চিন্তা করে চলেছে মানব;
যদিও সে শ্রেষ্ঠ চিন্তা সারাদিন চিন্তানাশা সাগরের জলে
ডুবে গিয়ে নিঃশব্দতা ছাড়া আর অন্য কিছু বলে?

Bangla Kobita of Jibanananda Das #18

 

– জীবনানন্দ দাশ

বহুদিন আমার এ-হৃদয়কে অবরোধ ক’রে র’য়ে গেছে;
হেমন্তের স্তব্ধতায় পুনরায় ক’রে অধিকার।
কোথায় বিদেশে যেন
এক তিল অধিক প্রবীণ এক নীলিমায় পারে
তাহাকে দেখিনি আমি ভালো ক’রে,- তবু মহিলার
মনন-নিবিড় প্রাণ কখন আমার চোখঠারে
চোখ রেখে ব’লে গিয়েছিলোঃ
‘সময়ের গ্রন্থি সনাতন, তবু সময়ও তা বে’ধে দিতে পারে?’
বিবর্ণ জড়িত এক ঘর;
কি ক’রে প্রাসাদ তাকে বলি আমি?
অনেক ফাটল নোনা আরসোলা কৃকলাস দেয়ালের ‘পর
ফ্রেমের ভিতরে ছবি খেয়ে ফেলে অনুরাধাপুর- ইলোরার;
মাতিসের- সেজানের- পিকাসোর,
অথবা কিসের ছবি? কিসের ছবির হাড়গোড়?
কেবল আধেক ছায়া-
ছায়ায় আশ্চর্য সব বৃত্তের পরিধির র’য়ে গেছে।
কেউ দেখে- কেউ তাহা দেখে নাকো- আমি দেখি নাই।
তবু তার অবলঙ কালো টেবিলের পাশে আধাআধি চাঁদনীর রাতে
মনে পড়ে আমিও বসেছি একদিন।
কোথাকার মহিলা সে? কবেকার?- ভারতী নর্ডিক গ্রীক মুশ্লিন মার্কিন?
অথবা সময় তাকে সনাক্ত করে না আর;
সর্বদাই তাকে ঘিরে আধো অন্ধকার;
চেয়ে থাকি,- তবুও সে পৃথিবীর ভাষা ছেড়ে পরিভাষাহীন।
মনে পড়ে সেখানে উঠোনে এক দেবদারু গাছ ছিলো।
তারপর সূর্যালোকে ফিরে এসে মনে হয় এইসব দেবদারু নয়।
সেইখানে তম্বুরার শব্দ ছিলো।
পৃথিবীতে দুন্দুভি বেজে ওঠে- বেজে ওঠে; সুর তান লয়
গান আছে পৃথিবীতে জানি, তবু গানের হৃদয় নেই।
একদিন রাত্রি এসে সকলের ঘুমের ভিতরে
আমাকে একাকী জেনে ডেকে নিলো- অন্য-এক ব্যবহারে
মাইলটাক দূরে পুরোপুরি।
সবই আছে- খুব কাছে; গোলকধাঁধার পথে ঘুরি
তবুও অনন্ত মাইল তারপর- কোথাও কিছুই নেই ব’লে।
অনেক আগের কথা এই সব- এই
সময় বৃত্তের মতো গোল ভেবে চুরুটের আস্ফোট জানুহীন, মলিন সমাজ
সেই দিকে অগ্রসর হয় রোজ- একদিন সেই দেশ পাবে।
সেই নারী নেই আর ভুলে তারা শতাব্দীর অন্ধকার ব্যসনে ফুরাবে।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #19

 

– জীবনানন্দ দাশ

এখানে প্রশান্ত মনে খেলা করে উঁচু উঁচু গাছ।
সবুজ পাতার ‘পরে যখন নেমেছে এসে দুপুরের সূর্যের আঁচ
নদীতে স্মরণ করে একবার পৃথিবীর সকালবেলাকে।
আবার বিকলে হলে অতিকায় হরিণের মতো শান্ত থাকে
এই সব গাছগুলো, -যেন কোনো দূর থেকে অস্পষ্ট বাাতস
বাঘের ঘ্রাণের মোত হৃদয়ে জাগায়ে যায় ত্রাস;
চেয়ে দেখ- ইহাদের পরস্পর নীলিম বিন্যাস
নড়ে উঠে ত্রস্ততায়, – আধো নীল আকাশের বুকে
হরিণের মতো দ্রুত ঠ্যাঙের তুরুকে
অন্তর্হিত হয়ে যেতে পারে তারা বটে;
একজোট হেয় কাজ করে মানুষেরা যে- রকম ভোটের ব্যালটে :
তবুও বাঘিনী হয়ে বাতাসকে আলিঙ্গন করে –
সাগরের বালি আর রাত্রির নক্ষত্রের তরে।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #20

 

– জীবনানন্দ দাশ

শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপরে মাথা পেতে
অলস গেঁয়োর মতো এইখানে কার্তিকের ক্ষেতে
মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার — চোখে তার শিশিরের ঘ্রাণ,
তাহার আস্বাদ পেয়ে অবসাদে পেকে ওঠে ধান,
দেহের স্বাদের কথা কয় –
বিকালের আলো এসে (হয়তো বা) নষ্ট করে দেবে তার সাধের সময়!
চারি দিকে এখন সকাল –
রোদের নরম রঙ শিশুর গালের মতো লাল!
মাঠের ঘাসের পরে শৈশবের ঘ্রাণ –
পাড়াগাঁর পথে ক্ষান্ত উৎসবের পড়েছে আহ্বান!

চারি দিকে নুয়ে প’ড়ে ফলেছে ফসল,
তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল!
প্রচুর শস্যের গন্ধ থেকে থেকে আসিতেছে ভেসে
পেঁচা আর ইঁদুরের ঘ্রাণে ভরা আমাদের ভাঁড়ারের দেশে!
শরীর এলায়ে আসে এই খানে ফলন্ত ধানের মতো করে
যেই রোদ একবার এসে শুধু চলে যায় তাহার ঠোটের চুমো ধ’রে
আহ্লাদের অবসাদে ভরে আসে আমার শরীর,
চারি দিকে ছায়া — রোদ — ক্ষুদ — কুঁড়া — কার্তিকের ভিড়:
চোখের সকল ক্ষুধা মিটে যায় এই খানে, এখানে হতেছে স্নিগ্ধ কান,
পাড়াগাঁর গায় আজ লেগে আছে রূপাশালি ধান ভানা রূপসীর শরীরের ঘ্রাণ!
আমি সেই সুন্দরীরে দেখে লই — নুয়ে আছে নদীর এপারে
বিয়োবার দেরি না — রূপ ঝরে পড়ে তার –
শীত এসে নষ্ট করে দিয়ে যাবে তারে!

আজও তবুও ফুরায় নি বৎসরের নতুন বয়স,
মাঠে মাঠে ঝ’রে পড়ে কাঁচা রোদ, ভাড়ারের রস!

মাছির গানের মতো অনেক অলস শব্দ হয়
সকালবেলা রৌদ্রে; কুঁড়িমির আজিকে সময়।

গাছের ছায়ার তলে মদ লয়ে কোন্‌ ভাঁড় বেঁধেছিল ছড়া!
তার সব কবিতার শেষ পাতা হবে আজ পড়া;
ভুলে গিয়ে রাজ্য — জয় — সাম্রাজ্যের কথা
অনেক মাটির তলে যেই মদ ঢাকা ছিল তুলে লব তার শীতলতা;
ডেকে লব আইবুড় পাড়াগাঁর মেয়েদের সব –
মাঠের নিস্তেজ রোদের নাচ হবে –
শুরু হবে হেমন্তের নরম উৎসব।

হাতে হাত ধরে ধরে গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে ঘুরে
কার্তিকের মিঠা রোদে আমাদের মুখ যাবে পুড়ে;
ফলন্ত ধানের গন্ধে — রঙে তার — স্বাদে তার ভরে যাবে আমাদের সকলের দেহ;
রাগ কেহ করিবে না — আমাদের দেখে হিংসা করিবে না কেহ।
আমাদের অবসর বেশি নয — ভালোবাসা আহ্লাদের অলস সময়
আমাদের সকলের আগে শেষ হয়
দূরের নদীর মতো সুর তুলে অন্য এক ঘ্রাণ — অবসাদ –
আমাদের ডেকে লয় — তুলে লয় আমাদের ক্লান্ত মাথা — অবসন্ন হাত।

তখন শস্যের গন্ধ ফুরায়ে গিয়েছে ক্ষেতে — রোদ গেছে পড়ে,
এসেছে বিকালবেলা তার শান্ত শাদা পথ ধরে;
তখন গিয়েছে থেমে অই কুঁড়ে গেঁয়োদের মাঠের রগড়
হেমন্ত বিয়ায়ে গেছে শেষ ঝরা মেয়ে তার শাদা মরা শেফালির
বিছানার পর;
মদের ফোঁটার শেষ হয়ে গেছে এ মাঠের মাটির ভিতর!
তখন সবুজ ঘাস হয়ে গেছে শাদা সব, হয়ে গেছে আকাশ ধবল,
চলে গেছে পাড়াগাঁর আইবুড়ো মেয়েদের দল!

০২.
পুরনো পেঁচারা সব কোটারের থেকে
এসেছে বাহির হয়ে অন্ধকার দেখে
মাঠের মুখের পরে
সবুজ ধানের নিচে — মাটির ভিতরে
ইঁদুরেরা চলে গেছে — আঁটির ভিতর থেকে চলে গেছে চাষা;
শস্যের ক্ষেতের পাশে আজ রাতে আমাদের জেগেছে পিপাসা!

ফলন্ত মঠের’ পরে আমরা খুঁজি না আজ মরণের স্থান,
প্রেম আর পিপাসার গান
আমরা গাহিয়া যাই পাড়াগাঁর ভাঁড়ের মতন!
ফসল — ধানের ফলে যাহাদের মন
ভরে উঠে উপেক্ষা করিয়া গেছে সাম্রাজ্যেরে, অবহেলা করে গেছে –
পৃথিবীর সব সিংহাসন –
আমাদের পাড়াগাঁর সেই সব ভাঁড় –
যুবরাজ রাজাদের হাড়ে আজ তাহাদের হাড়
মিশে গেছে অন্ধকারে অনেক মাটির নীচে পৃথিবীর তলে
কোটালের মতো তারা নিশ্বাসের জলে
ফুরায় নি তাদের সময়;
পৃথিবীর পুরোহিতদের মতো তারা করে নাই ভয়!
প্রণয়ীর মতো তারা ছেড়ে নি হৃদয়
ছড়া বেঁধে শহরের মেয়েদের নামে!
চাষাদের মতো তারা ক্লান্ত হয়ে কপালের ঘামে
কাটায় নি — কাটায় কি কাল।
অনেক মাটির নিচে তাদের কপাল
কোনো এক সম্রাটের সাথে
মিশিয়া রয়েছে আজ অন্ধকার রাতে!
যোদ্ধা — জয়ী — বিজয়ীর পাঁচ ফুট জমিনের কাছে –
পাশাপাশি –
জিতিয়া রয়েছে আজ তাদের খুলির অট্টহাসি!

অনেক রাতের আগে এসে তারা চলে গেছে — তাদের দিনের আলো
হয়েছে আঁধার,
সেই সব গেঁয়ো কবি — পাড়াগাঁর ভাঁড়
আজ এই অন্ধকারে আসিবে কি আর?
তাদের ফলন্ত দেহ শুষে ল’য়ে জন্মিয়াছে আজ এই খেতের ফসল;
অনেক দিনের গন্ধে ভরা ঐ ইদুরের জানে তাহা — জানে তাহ
নরম রাতের হাতে ঝরা এই শিশিরের জল!
সে সব পেঁচারা আজ বিকালের নিশ্চলতা দেখে
তাহাদের নাম ধরে যায় ডেকে ডেকে।
মাটির নিচের থেকে তারা
মৃতের মাথার স্বপ্নে নড়ে উঠে জানায় কী অদ্ভুত ইশারা!

আঁধারের মশা আর নক্ষত্র তা জানে –
আমরাও আসিয়াছি ফসলের মাঠের আহ্বানে।
সূর্যের আলোর দিন ছেড়ে দিয়ে, পৃথিবীর যশ পিছে ফেলে
শহর — বন্দর — বস্তি — কারখানা দেশলাইয়ে জ্বেলে
আসিয়াছি নেমে এই ক্ষেতে;
শরীরের অবসাদ — হৃদয়ের জ্বর ভুলে যেতে।

শীতল চাঁদের মতো শিশিরের ভিজা পথ ধরে
আমরা চলিতে চাই, তারপর যেতে চাই মরে
দিনের আলোয় লাল আগুনের মুখে পুড়ে মাছির মতন;
অগাধ ধানের রসে আমাদের মন
আমরা ভরিতে চাই গেয়ো কবি — পাড়াগার ভাঁড়ের মতন!

– জমি উপড়ায়ে ফেলে চলে গেছে চাষা
নতুন লাঙল তার পড়ে আছে — পুরনো পিপাসা
জেগে আছে মাঠের উপরে;
সময় হাঁকিয়া যায় পেঁচা অই আমাদের তরে!
হেমন্তের ধান ওঠে ফলে –
দুই পা ছড়ায়ে বস এইখানে পৃথিবীর কোলে।
আকাশের মেঠো পথে থেমে ভেসে চলে চাঁদ
অবসর আছে তার — অবোধের মতন আহ্লাদ
আমাদের শেষ হবে যখন সে চলে যাবে পশ্চিমের পানে –
এটুকু সময় তাই কেটে যাক রূপ আর কামনার গানে!

০৩.
ফুরোনো ক্ষেতের গন্ধে এইখানে ভরেছে ভাঁড়ার;
পৃথিবীর পথে গিয়ে কাজ নাই — কোনো কৃষকের মতো দরকার নাই
দূরে মাঠে গিয়ে আর!
রোধ — অবরোধ — ক্লেশ — কোলাহল শুনিবার নাহিকো সময় –
জানিতে চাই না আর সম্রাট সেজেছে ভাঁড় কোন্‌খানে
কোথায় নতুন করে বেবিলন ভেঙে গুঁড়ো হয়!
আমার চোখের পাশে আনিয়ো না সৈন্যদের মশালের আগুনের রঙ
দামামা থামায়ে ফেল — পেঁচার পাখার মতো অন্ধকারে ডুবে যাক
রাজ্য আর সাম্রাজ্যের সঙ!

এখানে নাহিকো কাজ — উৎসাহের ব্যথা নাই, উদ্যমের নাহিকো ভাবনা;
এখানে ফুরায়ে গেছে মাথার অনেক উত্তেজনা।
অলস মাছির শব্দে ভরে থাকে সকালের বিষন্ন সময়,
পৃথিবীরে মায়াবীর নদীর পারের দেশ বলে মনে হয়!
সকল পড়ন্ত রোদ চারি দিকে ছুটি পেয়ে জমিতেছে এইখানে এসে
গ্রীষ্মের সমুদ্র থেকে চোখের ঘুমের গান আসিতেছে ভেসে,
এখানে পালঙ্কে শুয়ে কাটিবে অনেক দিন –
জেগে থেকে ঘুমবার সাধ ভালোবেসে।

এখানে চকিত হতে হবে নাকো — ত্রস্ত হয়ে পড়িবার নাহিকো সময়;
উদ্যমের ব্যথা নাই — এইখানে নাই আর উৎসাহের ভয়!
এই খানে কাজ এসে জমে নাকো হাতে,
মাথায় চিন্তার ব্যথা হয় না জমাতে!
এখানে সৌন্দর্য এসে ধরিবে না হাত আর –
রাখিবে না চোখ আর নয়নের পর;
ভালোবাসা আসিবে না –
জীবন্ত কৃমির কাজ এখানে ফুরায়ে গেছে মাথার ভিতর!

অলস মাছির শব্দে ভরে থাকে সকালের বিষন্ন সময়
পৃথিবীর মায়াবীর নদীর পারের দেশ বলে মনে হয়;
সকল পড়ন্ত রোদ চারি দিকে ছুটি পেয়ে জমিতেছে এইখানে এসে,
গ্রীষ্মের সমুদ্র থেকে চোখের ঘুমের গান আসিতেছে ভেসে,
এখানে পালঙ্কে শুয়ে কাটিবে অনেক দিন জেগে থেকে ঘুমাবার
সাধ ভালোবেসে!

Bangla Kobita of Jibanananda Das #21

 

– জীবনানন্দ দাশ

তবুও যখন মৃত্যু হবে উপস্থিত
আর-একটি প্রভাতের হয়তো বা অন্যতর বিস্তীর্ণতায়,-
মনে হবে
অনেক প্রতীক্ষা মোরা ক’রে গেছি পৃথিবীতে
চোয়ালের মাংস ক্রমে ক্ষীণ ক’রে
কোনো এক বিশীর্ণ কাকের অক্ষি-গোলকের সাথে
আঁখি-তারকার সব সমাহার এক দেখে;
তবু লঘু হাস্যে- সন্তানের জন্ম দিয়ে-
তারা আমাদের মতো হবে- সেই কথা জেনে- ভুলে গিয়ে-
লোল হাস্যে জলের তরঙ্গ মোরা শুনে গেছি আমাদের প্রাণের ভিতর,
নব শিকড়ের স্বাদ অনুভব ক’রে গেছি- ভোরের স্ফটিক রৌদ্রে।
অনেক গন্ধর্ব, নাগ, কুকুর, কিন্নর, পঙ্গপাল
বহুবিধ জন্তুর কপাল।
উন্মোচিত হ’য়ে বিরুদ্ধে দাঁড়ায়ে থাকে পথ- পথান্তরে,
তবু ওই নীলিমাকে প্রিয় অভিভাবিকার মতো মনে হয়,
হাতে তার তুলাদণ্ড;
শান্ত- স্থির;
মুখের প্রতিজ্ঞাপাশে নির্জন, নীলাভ বৃত্তি ছাড়া কিছু নেই।
যেন তার কাছে জীবনের অভ্যুদয়
মধ্য সমুদ্রের ‘পরে অনুকূল বাতাসের প্ররোচনাময়
কোনো এক ক্রীড়া- ক্রীড়া;-
বেরিলমণির মতো তরঙ্গের উজ্জ্বল আঘাতে মৃত্যু।
স্থির- শুভ্র- নৈসর্গিক কথা বলিবার অবসর।

কাব্যগ্রন্থ – সাতটি তারার তিমির

Bangla Kobita of Jibanananda Das #22

 

– জীবনানন্দ দাশ

অশ্বত্থ বটের পথে অনেক হয়েছি আমি তোমাদের সাথী;
ছড়ায়েছি খই ধান বহুদিন উঠানের শালিখের তরে;
সন্ধ্যায় পুকুর থেকে হাঁসটিরে নিয়ে আমি তোমাদের ঘরে
গিয়েছি অনেক দিন, — দেখিয়াছি ধূপ জ্বালো, ধরো সন্ধ্যাবাতি
থোড়ের মতন শাদা ভিজে হাতে, — এখুনি আসিবে কিনা রাতি
বিনুনি বেঁধেছ তাই — কাঁচপোকাটিপ তুমি কপারে পরে
পড়িয়াছ… তারপর ঘুমায়েছ: কল্কাপাড় আঁচলটি ঝরে
পানের বাটার পরে; নোনার মতন নম্র শরীরটি পাতি

নির্জন পালঙ্কে তুমি ঘুমায়েছ, — বউকথাকওটির ছানা
নীল জামরুল নীড়ে — জ্যোৎস্নায় — ঘুমায়ে রয়েছে যেন, হায়,
আর রাত্রি মাতা পাখিটির মতো ছড়ায়ে রয়েছে তার ডানা।
আজ আমি ক্লান্ত চোখে ব্যবহৃত জীবনের ধুলোয় কাঁটায়
চলে গেছে বহু দূরে; — দেখোনিকে, বোঝানিকো, করনিকো মানা
রূপসী শঙ্খের কৌটা তুমি যে গো প্রাণহীন — পানের বাটায়।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #23

 

– জীবনানন্দ দাশ

অশ্বত্থে সন্ধ্যার হাওয়া যখন লেগেছে নীল বাংলার বনে
মাঠে মাঠে ফিরি একা: মনে হয় বাংলার জীবনে সঙ্কট
শেষ হয়ে গেছে আজ; — চেয়ে দেখ কতো শত শতাব্দীর বট
হাজার সবুজ পাতা লাল ফল বুকে লয়ে শাখার ব্যজনে
আকাঙ্খার গান গায় — অশ্বত্থেরও কি যেন কামনা জাগে মনে :
সতীর শীতল শব বহু দিন কোলে লয়ে যেন অকপট
উমার প্রেমের গল্প পেয়েছে সে, চন্দ্রশেখরের মতো তার জট
উজ্জ্বল হতেছে তাই সপ্তমীর চাঁদের আজ পুনরাগমনে;

মধুকূপী ঘাস-ছাওয়া ধলেশ্বরীটির পাড়ে গৌরী বাংলার
এবার বল্লাল সেন আসিবে না জানি আমি — রায়গুণাকর
আসিবে না — দেশবন্ধু আসিয়াছে ক্ষুরধার পদ্মায় এবার,
কালীগহে ক্লান্ত গাঙশালিখের ভিড়ে যেন আসিয়াছে ঝড়,
আসিয়াছে চন্ডীদাস — রামপ্রসাদের শ্যামা সাথে সাথে তার;
শঙ্খমালা, চন্দ্রমালা : মৃত শত কিশোরীর কঙ্কণের স্বর।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #24

 

– জীবনানন্দ দাশ

ভালোবাসিয়াছি আমি অস্তচাঁদ, -ক্লান্ত শেষপ্রহরের শশী!
-অঘোর ঘুমের ঘোরে ঢলে যবে কালো নদী-ঢেউয়ের কলসী,
নিঝ্ঝুম বিছানার পরে
মেঘবৌ’র খোঁপাখসা জোছনাফুল চুপে চুপে ঝরে,-
চেয়ে থাকি চোখ তুলে’-যেন মোর পলাতকা প্রিয়া
মেঘের ঘোমটা তুলে’ প্রেত-চাঁদে সচকিতে ওঠে শিহরিয়া!
সে যেন দেখেছে মোরে জন্মে জন্মে ফিরে’ ফিরে’ ফিরে’
মাঠে ঘাটে একা একা, -বুনোহাঁস-জোনাকির ভিড়ে!
দুশ্চর দেউলে কোন্-কোন্ যক্ষ-প্রাসাদের তটে,
দূর উর-ব্যাবিলোন-মিশরের মরুভূ-সঙ্কটে,
কোথা পিরামিড তলে, ঈসিসের বেদিকার মূলে,
কেউটের মতো নীলা যেইখানে ফণা তুলে উঠিয়াছে ফুলে,
কোন্ মনভুলানিয়া পথচাওয়া দুলালীর মনে
আমারে দেখেছে জোছনা-চোর চোখে-অলস নয়নে!
আমারে দেখেছে সে যে আসরীয় সম্রাটের বেশে
প্রাসাদ-অলিন্দে যবে মহিমায় দাঁড়ায়েছি এসে-
হাতে তার হাত, পায়ে হাতিয়ার রাখি
কুমারীর পানে আমি তুলিয়াছি আনন্দের আরক্তিম আঁখি!
ভোরগেলাসের সুরা-তহুরা, ক’রেছি মোরা চুপে চুপে পান,
চকোরজুড়ির মতো কুহরিয়া গাহিয়াছি চাঁদিনীর গান!
পেয়ালায়-পায়েলায় সেই নিশি হয় নি উতলা,
নীল নিচোলের কোলে নাচে নাই আকাশের তলা!
নটীরা ঘুমায়েছিল পুরে পুরে, ঘুমের রাজবধূ-
চুরি করে পিয়েছিনু ক্রীতদাসী বালিকার যৌবনের মধু!
সম্রাজ্ঞীর নির্দয় আঁখির দর্প বিদ্রূপ ভুলিয়া
কৃষ্ণাতিথি-চাঁদিনীর তলে আমি ষোড়শীর উরু পরশিয়া
লভেছিনু উল্লাস-উতরোল!-আজ পড়ে মনে
সাধ-বিষাদের খেদ কত জন্মজন্মান্তের, রাতের নির্জনে!

আমি ছিনু ‘ক্রবেদুর’ কোন্ দূর ‘প্রভেন্স্’-প্রান্তরে!
-দেউলিয়া পায়দল্-অগোচর মনচোর-মানিনীর তরে
সারেঙের সুর মোর এমনি উদাস রাত্রে উঠিত ঝঙ্কারি!
আঙুরতলায় ঘেরা ঘুমঘোর ঘরখানা ছাড়ি
ঘুঘুর পাখনা মেলি মোর পানে আসিল পিয়ারা;
মেঘের ময়ূরপাখে জেগেছিল এলোমেলো তারা!
-‘অলিভ’ পাতার ফাঁকে চুন চোখে চেয়েছিল চাঁদ,
মিলননিশার শেষে-বৃশ্চিক, গোক্ষুরাফণা, বিষের বিস্বাদ!

স্পেইনের ‘সিয়েরা’য় ছিনু আমি দস্যু-অশ্বারোহী-
নির্মম-কৃতান্ত-কাল-তবু কী যে কাতর, বিরহী!
কোন্ রাজনন্দিনীর ঠোঁটে আমি এঁকেছিনু বর্বর চুম্বন!
অন্দরে পশিয়াছিনু অবেলার ঝড়ের মতন!
তখন রতনশেজে গিয়েছিল নিভে মধুরাতি,
নীল জানালার পাশে-ভাঙা হাটে-চাঁদের বেসাতি।
চুপে চুপে মুখে কার পড়েছিনু ঝুঁকে!
ব্যাধের মতন আমি টেনেছিনু বুকে
কোন্ ভীরু কপোতীর উড়ু-উড়ু ডানা!
-কালো মেঘে কেঁদেছিল অস্তচাঁদ-আলোর মোহানা!

বাংলার মাঠে ঘাটে ফিরেছিনু বেণু হাতে একা,
গঙ্গার তীরে কবে কার সাথে হয়েছিল দেখা!
‘ফুলটি ফুটিলে চাঁদিনী উঠিলে’ এমনই রূপালি রাতে
কদমতলায় দাঁড়াতাম গিয়ে বাঁশের বাঁশিটি হাতে!
অপরাজিতার ঝাড়ে- নদীপারে কিশোরী লুকায়ে বুঝি!-
মদনমোহন নয়ন আমার পেয়েছিল তারে খুঁজি!
তারই লাগি বেঁধেছিনু বাঁকা চুলে ময়ূরপাখার চূড়া,
তাহারই লাগিয়া শুঁড়ি সেজেছিনু-ঢেলে দিয়েছিনু সুরা!
তাহারই নধর অধর নিঙাড়ি উথলিল বুকে মধু,
জোনাকির সাথে ভেসে শেষরাতে দাঁড়াতাম দোরে বঁধু!
মনে পড়ে কি তা!-চাঁদ জানে যাহা, জানে যা কৃষ্ণাতিথির শশী,
বুকের আগুনে খুন চড়ে-মুখ চুন হয়ে যায় একেলা বসি!

Bangla Kobita of Jibanananda Das #25

 

– জীবনানন্দ দাশ

সুরঞ্জনা, অইখানে যেয়োনাকো তুমি,
বোলোনাকো কথা অই যুবকের সাথে;
ফিরে এসো সুরঞ্জনা :
নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে;

ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;
দূর থেকে দূরে – আরও দূরে
যুবকের সাথে তুমি যেয়োনাকো আর।

কী কথা তাহার সাথে? – তার সাথে!
আকাশের আড়ালে আকাশে
মৃত্তিকার মতো তুমি আজ :
তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে।

সুরঞ্জনা,
তোমার হৃদয় আজ ঘাস :
বাতাসের ওপারে বাতাস –
আকাশের ওপারে আকাশ।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #26

 

– জীবনানন্দ দাশ


আকাশে চাঁদের আলো—উঠোনে চাঁদের আলো—নীলাভ চাঁদের আলো—এমন চাঁদের আলো আজ
বাতাসে ঘুঘুর ডাক—অশত্থে ঘুঘুর ডাক—হৃদয়ে ঘুঘু যে ডাকে—নরম ঘুঘুর ডাক আজ
তুমি যে রয়েছ কাছে—ঘাসে যে তোমার ছায়া—তোমার হাতের ছায়া—তোমার শাড়ির ছায়া ঘাসে
আকাশে চাঁদের আলো—উঠোনে চাঁদের আলো—নীলাভ চাঁদের আলো—এমন চাঁদের আলো আজ


কেউ যে কোথাও নেই—সকলে গিয়েছে মরে—সকলে গিয়েছে চলে—উঠান রয়েছে শুধু একা
শিশুরা কাঁদে না কেউ—রুগিরা হাঁপায় না তো—বুড়োরা কয় না কথা : থুবড়ো ব্যথার কথা যত
এখানে সকাল নাই—এখানে দুপুর নাই—এখানে জনতা নাই—এখানে সমাজ নাই—নাইকো মূর্খ ধাঁধা কিছু
আকাশে চাঁদের আলো—উঠোনে চাঁদের আলো—নীলাভ চাঁদের আলো—এমন চাঁদের আলো আজ


আর তো ক্লান্তি নাই—নাইকো চেষতা আজ—নাইকো রক্ত ব্যথা—বিমূঢ় ভিড়ের থেকে নিয়েছি জীবন ভরে ছুটি
হেঁটেছি অনেক পথ—আমার ফুরালো পথ—এখানে সকল পথ তোমার পায়ের পথে গিয়েছে নীলাভ ঘাসে মুছে
তুমি যে রয়েছ কাছে—ঘাসে যে তোমার ছায়া—তোমার হাতের ছায়া—তোমার শাড়ির ছায়া ঘাসে
আকাশে চাঁদের আলো—উঠোনে চাঁদের আলো—নীলাভ চাঁদের আলো—এমন চাঁদের আলো আজ

কাব্যগ্রন্থ – রুপসী বাংলা

Bangla Kobita of Jibanananda Das #27

 

– জীবনানন্দ দাশ

আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি এই ঘাসে
বসে থাকি; কামরাঙা লাল মেঘ যেন মৃত মনিয়ার মতো
গঙ্গাসাগরের ঢেউয়ে ডুবে গেছে-আসিয়াছে শান- অনুগত
বাংলার নীল সন্ধ্যা-কেশবতী কন্যা যেন এসেছে আকাশে;
আমার চোখের পরে আমার মুখের পরে চুল তার ভাসে;
পৃথিবীর কোনো পথ এ কন্যারে দেখেনিকো দেখি নাই অত
অজস্র চুলের চুমা হিজলে কাঁঠালে জামে ঝরে অবিরত,
জানি নাই এত স্নিগ্ধ গন্ধ ঝরে রূপসীর চুলের বিন্যাসে

পৃথিবীর কোনো পথে; নরম ধানের গন্ধ-কলমীর ঘ্রাণ,
হাঁসের পালক, শর, পুকুরের জল, চাঁদা সরপুটিদের
মৃদু ঘ্রাণ, কিশোরীর চাল ধোয়া ভিজে হাত-শীত হাতখান,
কিশোরের পায়ে- দলা মুথাঘাস,-লাল লাল বটের ফলের
ব্যথিত গন্ধের ক্লান- নীরবতা-এরি মাঝে বাংলার প্রাণ;
আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি পাই টের।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #28

 

– জীবনানন্দ দাশ

অন্ধ সাগরের বেগে উৎসারিত রাত্রির মতন
আলোড়ন মানুষের প্রিয়তর দিক নির্ণয়ের
পথ আজ প্রতিহত; তবুও কোথাও
নির্মল সন্ততি দেশ সময়ের নব নব তীর-
পেতে পায়ে হয়তো বা মানব হৃদয়;

মহাপতনের দিনে আজ অবহিত হয়ে নিতে হয়।
যদিও অধীর লক্ষ্যে অন্ধকারে মানুষ চলেছে
ধ্বংস আশা বেদনায়

বন্য মরালের মত চেতনায় নীল কুয়াশায়,-
কুহেলি সরিয়ে তবু মানুষের কাহিনীর পথে
ভাস্বরতা এসে পড়ে মাঝে মাঝে-
স্বচ্ছ ক্রান্তিবলয়ের মতন জগতে।

মনে হয় মহানিশীথের স্তন্যপায়ী
মানুষ তবুও শিশুসূর্যের সন্তান,
স্থিরতর বিষয়ী সে,-
যদিও হৃদয়ে রক্তে আজো ভুল অকূলের গান।

কাব্যগ্রন্থ – আলোপৃথিবী

Bangla Kobita of Jibanananda Das #29

 

– জীবনানন্দ দাশ

আজ তারা কই সব? ওখানে হিজল গাছ ছিল এক — পুকুরের জলে
বহুদিন মুখ দেখে গেছে তার; তারপর কি যে তার মনে হল কবে
কখন সে ঝরে গেল, কখন ফুরাল, আহা, — চলে গেল কবে যে নীরবে,
তাও আর জানি নাকো; ঠোট ভাঙা দাঁড়কাক ঐ বেলগাছটির তলে
রোজ ভোরে দেখা দিত — অন্য সব কাক আর শালিখের হৃষ্ট কোলাহলে
তারে আর দেখি নাকো — কতদিন দেখি নাই; সে আমার ছেলেবেলা হবে,
জানালার কাছে এক বোলতার চাক ছিল — হৃদয়ের গভীর উৎসবে
খেলা করে গেছে তারা কত দিন — ফড়িঙ কীটের দিন যত দিন চলে

তাহারা নিকটে ছিলো — রোদের আনন্দে মেতে — অন্ধকারে শান্ত ঘুম খুঁজে
বহুদিন কাছে ছিলো; — অনেক কুকুর আজ পথে ঘাটে নড়াচড়া করে
তবুও আঁধারে ঢের মৃত কুকুরের মুখ — মৃত বিড়ালের ছায়া ভাসে;
কোথায় গিয়েছে তারা? ওই দূর আকাশেল নীল লাল তারার ভিতরে
অথবা মাটির বুকে মাটি হয়ে আছে শুধু — ঘাস হয়ে আছে শুধু ঘাসে?
শুধালাম — উত্তর দিল না কেউ উদাসীন অসীম আকাশে।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #30

 

– জীবনানন্দ দাশ

আজকে রাতে তোমায় কাছে আমার কাছে পেলে কথা
বলা যেত; চারিদিকে হিজল শিরীষ নক্ষত্র ঘাস হাওয়ার প্রান্তর।
কিন্তু যেই নীট নিয়মে ভাবনা আবেগ ভাব
বিশুদ্ধ হয় বিষয় ও তার যুক্তির ভিতর;
আমিও সেই ফলাফলের ভিতরে থেকে গিয়ে
দেখেছি ভারত লন্ডন রোম নিউইয়র্ক চীন
আজকে রাতের ইতিহাস ও মৃত ম্যামথ সব
নিবিড় নিয়মাধীন।
কোথায় তুমি রয়েছ কোন পাশার দান হাতে;
কী কাজ খুঁজে; সকল অনুশীলন ভালো নয়;
গভীরভাবে জেনেছি যে-সব সকাল বিকাল নদী নক্ষত্রকে
তারই ভিতর প্রবীণ গল্প নিহিত হয়ে রয়।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #31

 

– জীবনানন্দ দাশ

হে মৃত্যু,
তুমি আমাকে ছেড়ে চলেছো ব’লে আমি খুব গভীর খুশি?
কিন্তু আরো-খানিকটা চেয়েছিলাম;
চারিদিকে তুমি হাড়ের পাহাড় বানিয়ে রেখেছো;-
যে-ঘোড়ায় চ’ড়ে আমি
অতীত-ঋষিদের সঙ্গে আকাশে নক্ষত্রে উড়ে যাবো
এইখানে মৃতবৎসা, মাতাল, ভিখারি ও কুকুরদের ভিড়ে
কোথায় তাকে রেখে দিলে তুমি?
এতদিন ব’সে পুরোনো বীজগণিতের শেষ পাতা শেষ করতে-না-করতেই
সমস্ত মিথ্যা প্রমাণিত হ’য়ে গেলো;
কোন-এক গভীর নতুন বীজগণিত যেন
পরিহাসের চোখ নিয়ে অপেক্ষা করছে;-
আবার মিথ্যা প্রমাণিত হবে ব’লে?
সে-ই শেষ সত্য ব’লে?
জীবনঃ ভারতের, চীনের, আফ্রিকার নদীপাহাড়ে বিচরণের
মূঢ় আনন্দ নয় আর
বরং নির্ভীক বীরদের রচিত পৃথিবীর ছিদ্রে-ছিদ্রে
ইস্ক্রপের মতো আটকে থাকবার শৌর্য ও আমোদঃ
তারপর চুম্বক পাহাড়ে গিয়ে নিস্তব্ধ হবার মতো আস্বাদ?
জীবনঃ নির্ভীক নাদীদের সৌন্দর্যের আঘাতে
নিগ্রো সঙ্গীতের বেদনার ধূলোরাশি?
কিন্তু এ-বেদনা আত্মিক, তার ঝাপ্সা;- একাকীঃ তাই কিছু নয়ঃ-
কিন্তু তিলে-তিলে আঁটকে থাকবার বেদনাঃ
পৃথিবীর সমস্ত কুকুর ফুটপাতে বোধ করছে আজ।
যেন এত দিনের বীজগণিত কিছু নয়,
যেন নতুন বীজগণিত নিয়ে এসেছে আকাশ!
বাংলার পাড়াগাঁয়ে শীতের জ্যোৎস্না আমি কত বার দেখলাম
কত বালিকাকে নিয়ে গেলো বাঘ- জঙ্গলের অন্ধকারে;
কতবার হটেনটট-জুলু দম্পতির প্রেমের কথাবার্তার ভিতর
আফ্রিকার সিংহকে লাফিয়ে পড়তে দেখলাম;
কিন্তু সেই সব মূঢ়তার দিন নেই আর সিংহদের;
নীলিমার থেকে সমুদ্রের থেকে উঠে এসে
পরিস্ফুট রোদের ভিতর
উজ্জ্বল দেহ অদৃশ্য রাখে তারা;
শাদা, হলদে, লাল কালো মানুষদের
আর-কোনো শেষ বক্তব্য আছে কি না জিজ্ঞাসা করে।
যে-ঘোড়ায় চ’ড়ে আমরা অতীত-ঋষিদের সঙ্গে আকাশে নক্ষত্রে উড়ে যাবে
সেই সব শাদা-শাদা ঘোড়ার ভিড়
যেন কোন জ্যোৎস্নার নদীতে ঘিরে
নিস্তব্ধ হ’য়ে অপেক্ষা করছে কোথাও;
আমার হৃদয়ের ভিতর
সেই সুপক্ক রাত্রির গন্ধ পাই আমি।

কাব্যগ্রন্থ – মহাপৃথিবী

Bangla Kobita of Jibanananda Das #32

 

– জীবনানন্দ দাশ

শোনা গেল লাশকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে;
কাল রাতে – ফাল্গুনের রাতের আধাঁরে

যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হল তার সাধ। বধূ শুয়ে ছিল পাশে – শিশুটিও ছিল;
প্রেম ছিল,আশা ছিল-জোৎসনায়,-তবে সে দেখিল
কোন ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেলো তার?
অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল – লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার।
এই ঘুম চেয়েছিলো বুঝি!

রক্তফেনা-মাখা মুখে মড়কের ইদুঁরের মত ঘাড় গুজি
আধার ঘুজির বুকে ঘুমায় এবার;
কোনোদিন জাগিবেনা আর।

কোনোদিন জাগিবেনা আর।
জাগিবার গাঢ় বেদনার
অবিরাম – অবিরাম ভার
সহিবেনা আর –
এই কথা বলেছিলো তারে
চাঁদডুবে চ’লে গেলে – অদ্ভুদ আঁধারে
যেন তার জানালার ধারে
উটের গ্রীবার মতো কোন এক নিস্তব্ধতা এসে।

তবুও তো পেঁচা জাগে;
গলিত স্থবির ব্যাঙ আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে।
আরেকটি প্রভাতের ইশারায় – অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে
টের পাই যুথচারী আঁধারের গাঢ় নিরুদ্দেশে
চারদিকে মশারির ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতা
মশা তার অন্ধকার সংগ্রামে জেগে থেকে জীবনের স্রোত ভালোবাসে

রক্ত ক্লেদ বসা থেকে রোদ্রে ফের উড়ে যায় মাছি;
সোনালি রোদের ঢেউয়ে উড়ন্ত কীটের খেলা কতো দেখিয়াছি।
ঘনিষ্ঠ আকাশ যেন – যেন কোন বির্কীন জীবন
অধিকার ক’রে আছে ইহাদের মন;
চাঁদ ডুবে গেলে পর প্রধান আঁধারে তুমি অশ্বথের কাছে
একগাছা দড়ি হাতে গিয়েছিলে তবু একা – একা,
যে জীবন ফড়িঙের,দোয়েলের-মানুষের সাথে তার হয়নাকো দেখা
এই জেনে।

অশ্বথের শাখা
করেনি কি প্রতিবাদ ? জোনাকির ভিড় এসে
সোনালী ফুলের স্নিগ্ধ ঝাঁকে
করেনি কি মাখামাখি?
থুরথুরে অন্ধ পেঁচা এসে
বলেনি কি; ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে
চমৎকার !
ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার!’
জানায়নি পেঁচা এসে এ-তুমুল গাড় সমাচার ?

জীবনের এই স্বাদ-সুপক্ক যবের ঘ্রান হেমন্তের বিকেলের-
তোমার অসহ্য বোধ হ’লো;
মর্গে কি হৃদয় জুড়ালো
মর্গে – গুমোটে-
থ্যাঁতা ইঁদুরের মতো রক্তমাখা ঠোঁটে।
শোনো
তবু এ মৃতের গল্প; কোনো
নারীর প্রণয়ে ব্যর্থ হয় নাই;
বিবাহিত জীবনের সাধ
কোথাও রাখেনি কোন খাদ,
সময়ের উদ্বর্তনে উঠে এসে বধু
মধু-আর মননের মধু
দিয়েছে জানিতে;
হাড়হাবাতের গ্লানি বেদনার শীতে
এ-জীবন কোনদিন কেঁপে ওঠে নাই;
তাই
লাশকাটা ঘরে
চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের পরে।

জানি – তবু জানি
নারীর হৃদয়-প্রেম-শিশু-গৃহ-নয় সবখানি;
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয় –
আর এক বিপন্ন বিষ্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে,
ক্লান্ত – ক্লান্ত করে;
লাশকাটা ঘরে
সেই ক্লান্তি নাই;
তাই
লাশকাটা ঘরে
চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের পরে।

তবু রোজ রাতে আমি চেয়ে দেখি,আহা,
থুরথুরে অন্ধ পেঁচা অশ্বত্থের ডালে বসে এসে,
চোখ পাল্টায়ে কয়: ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে ?’
চমৎকার !
ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার-

হে প্রগাঢ় পিতামহী,আজো চমৎকার ?
আমিও তোমার মতো বুড়ো হবো-বুড়ি চাঁদটারে আমি
ক’রে দিবো কালীদহে বেনোজলে পার;
আমরা দুজনে মিলে শূন্য ক’রে চ’লে যাবো জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #33

 

– জীবনানন্দ দাশ

আগুন বাতাস জল : আদিম দেবতারা তাদের সর্পিল পরিহাসে
তোমাকে দিলো রূপ-
কী ভয়াবহ নির্জন রূপ তোমাকে দিলো তারা;
তোমার সংস্পর্শের মানুষদের রক্তে দিলো মাছির মতো কামনা৷

আগুন বাতাস জল : আদিম দেবতারা তাদের বঙ্কিম পরিহাসে
আমাকে দিলো লিপি রচনা করবার আবেগঃ
যেন আমিও আগুন বাতাস জল
যেন তোমাকেও সৃষ্টি করছি।

তোমার মুখের রূপ যেন রক্ত নয়, মাংস নয়, কামনা নয়,
নিশীথ-দেবদারু-দ্বীপ;
কোনো দূর নির্জন নীলাভ দ্বীপ

স্থুল হাতে ব্যবহৃত হ’য়ে তবু
তুমি মাটির পৃথিবীতে হারিয়ে যাচ্ছো;
আমি হারিয়ে যাচ্ছি সুদূর দ্বীপের নক্ষত্রের ছায়ার ভিতর।

আগুন বাতাস জল : আদিম দেবতারা তাদের বঙ্কিম পরিহাসে
রূপের বীজ ছড়িয়ে চলে পৃথিবীতে
ছড়িয়ে চলে স্বপ্নের বীজ।
অবাক হয়ে ভাবি
আজ রাতে কোথায় তুমি?
রূপ কেন নির্জন দেবদারু-দ্বীপের নক্ষত্রের ছায়া চেনে না-
পৃথিবীর সেই মানুষীর রূপ?
স্থুল হাতে ব্যবহৃত হ’য়ে- ব্যবহৃত –ব্যবহৃত –ব্যবহৃত –ব্যবহৃত –হয়ে
ব্যবহৃত –ব্যবহৃত –
আগুন বাতাস জল : আদিম দেবতারা হো_ হো ক’রে হেসে উঠলোঃ
‘ব্যবহৃত – ব্যবহৃত হ’য়ে শুয়োরের মাংস হয়ে যায়?’

হো হো করে হেসে উঠলাম আমি!-
চারিদিককার অট্টহাসির ভিতর একটা বিরাট তিমির মৃতদেহ নিয়ে
অন্ধকার সমুদ্র স্ফীত হ’য়ে উঠলো যেন;
পৃথিবীর সমস্ত রূপ অমেয় তিমির মৃতহেদের দূর্গন্ধের মতো,
যেখানেই যাই আমি সেই সব সমুদ্রের উল্কায় – উল্কায়
কেমন স্বাভাবিক, কী স্বাভাবিক!

Bangla Kobita of Jibanananda Das #34

 

– জীবনানন্দ দাশ

পৃথিবী এখন এখন ক্রমে হতেছে নিঝুম।
সকলেরই চোখ ক্রমে বিজড়িত হ’য়ে যেন আসে;
যদিও আকাশ সিন্ধু ভ’রে গেল অগ্নির উল্লাসে;
যেমন যখন বিকেলবেলা কাটা হয় ক্ষেতের গোধূম
চিলের কান্নার মতো শব্দ ক’রে মেঠো ইঁদুরের ভিড় ফসলের ঘুম

গাঢ় করে দিয়ে যায়।-এইবার কুয়াশায় যাত্রা সকলের।
সমূদ্রের রোল থেকে একটি আবেগ নিয়ে কেউ
নদীর তরঙ্গে – ক্রমে তুষারের স্তুপে তার ঢেউ
একবার টের পাবে, দ্বিতীয়বারের
সময় আসার আগে নিজেকেই পাবে না সে ঢের।

এইখানে সময়কে যতদুর দেখা যায় চোখে
নির্জন ক্ষেতের দিকে চেয়ে দেখি দাঁড়ায়েছে অভিভুত চাষা;
এখনো চালাতে আছে পৃথিবীর প্রথম তামাশা
সকল সময় পান ক’রে ফেলে জলের মতন এক ঢোঁকে;
অঘ্রানের বিকেলের কমলা আলোকে
নিড়োনো ক্ষেতের কাজ ক’রে যায় ধীরে;
একটি পাখির মতো ডিনামাইটের ’পরে ব’সে।
পৃথিবীর মহত্তর অভিজ্ঞতা নিজের মনের মুদ্রাদোষে
নষ্ট হয়ে খ’সে যায় চারিদিকে আমিষ তিমিরে;
সোনালি সূর্যের সাথে মিশে গিয়ে মানুষটা আছে পিছু ফিরে।

ভোরের স্ফটিক রৌদ্রে নগরী মলিন হয়ে আসে।
মানুষের উৎসাহের কাছ থেকে শুরু হল মানুষের বৃত্তি আদায়।
যদি কেউ কানাকড়ি দিতে পারে বুকের উপরে হাত রেখে
তবে সে প্রেতের মতো ভেসে গিয়ে সিংহদরজায়
আঘাত হানিতে গিয়ে মিশে যায় অন্ধকার বিম্বের মতন।
অভিভূত হয়ে আছে — চেয়ে দ্যাখো — বেদনার নিজের নিয়ম।
নেউলধূসর নদী আপনার কাজ বুঝে প্রবাহিত হয়;
জলপাই অরণ্যের ওই পারে পাহাড়ের মেধাবী নীলিমা;
ওই দিকে সৃষ্টি যেন উষ্ণ স্থির প্রেমের বিষয়;
প্রিয়ের হাতের মতো লেগে আছে ঘড়ির সময় ভুলে গিয়ে
আকাশের প্রসারিত হাতের ভিতরে।

সেই আদি অরণির যুগ থেকে শুরু ক’রে আজ
অনেক মনীষা, প্রেম, নিমীল ফসলরাশি ঘরে
এসে গেছে মানুষের বেদনা ও সংবেদনাময়।
পৃথিবীর রাজপথে-রক্তপথে-অন্ধকার অববাহিকায়
এখনো মানুষ তবু খোঁড়া ঠ্যাঙে তৈমুরের মতো বার হয়।
তাহার পায়ের নিচে তৃণের নিকটে তৃণ মুক অপেক্ষায়;
তাহার মাথার ‘পরে সূর্য, স্বাতী, সরমার ভিড়;
এদের নৃত্যের রোলে অবহিত হয়ে থেকে ক্রমে একদিন
কবে তার ক্ষুদ্র হেমন্তের বেলা হবে নিসর্গের চেয়েও প্রবীণ?

চেয়েছে মাটির দিকে — ভুগর্ভে তেলের দিকে
সমস্ত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অবিরল যারা,
মাথার উপরে চেয়ে দেখেছে এবার;
দুরবীণে কিমাকার সিংহের সাড়া
পাওয়া যায় শরতের নির্মেঘ রাতে।
বুকের উপরে হাত রেখে দেয় তারা।
যদিও গিয়েছে ঢের ক্যারাভান ম’রে,
মশালের কেরোসিনে মানুষেরা অনেক পাহারা
দিয়ে গেছে তেল, সোনা, কয়লা ও রমণীকে চেয়ে;
চিরদিন এইসব হ্নদয় ও রুধিরের ধারা।
মাটিও আশ্চর্য সত্য। ডান হাত অন্ধকারে ফেলে
নক্ষত্রও প্রামাণিক; পরলোক রেখেছে সে জ্বেলে;
অনৃত সে আমাদের মৃত্যুকে ছাড়া।

মোমের আলোয় আজ গ্রস্থের কাছে ব’সে – অথবা ভোরের বেলা নদীর ভিতরে
আমরা যতটা দূর চ’লে যাই -চেয়ে দেখি আরো কিছু আছে তারপরে।
অনির্দিষ্ট আকাশের পানে উড়ে হরিয়াল আমারো বিবরে
ছায়া ফ্যালে। ঘুরোনো সিঁড়ির পথ বেয়ে যারা উঠে যায় ধবল মিনারে,
কিংবা যারা ঘুমন্তের মতো জেগে পায়চারি করে সিংহদ্বারে,
অথবা যে সব থাম সমীচীন মিস্তিরির হাত থেকে উঠে গেছে বিদ্যুতের তারে,
তাহারা ছবির মতো পরিতৃপ্ত বিবেকের রেখায় রয়েছে অনিমেষ।
হয়তো অনেক এগিয়ে তারা দেখে গেছে মানুষের পরম আয়ুর পারে শেষ
জলের রঙের মতো স্বচ্ছ রোদে একটিও বোলতার নেই অবলেশ।

তাই তারা লোষ্ট্রের মতন স্তব্ধ। আমাদেরও জীবনের লিপ্ত অভিধানে
বর্জাইস অক্ষরে লেখা আছে অন্ধকার দলিলের মানে।
সৃষ্টির ভিতরে তবু কিছুই সুদীর্ঘতম নয় — এই জ্ঞানে
লোকসানী বাজারের বাক্সের আতাফল মারীগুটিকার মতো পেকে
নিজের বীজের তরে জোর করে সূর্যকে নিয়ে আসে ডেকে।
অকৃত্রিম নীল আলো খেলা করে ঢের আগে মৃত প্রেমিকের শব থেকে।

একটি আলোক নিয়ে বসে থাকা চিরদিন;
নদীর জলের মতো স্বচ্ছ এক প্রত্যাশাকে নিয়ে;
সে সবের দিন শেষ হয়ে গেছে
এখন সৃষ্টির মনে — অথবা মনীষীদের প্রাণের ভিতরে।
সৃষ্টি আমাদের শত শতাব্দীর সাথে ওঠে বেড়ে।
একদিন ছিলো যাহা অরণ্যের রোদে — বালুচরে,
সে আজ নিজেকে চেনে মানুষের হৃদয়ের প্রতিভাকে নেড়ে।
আমরা জটিল ঢের হয়ে গেছি — বহুদিন পুরাতন গ্রহে বেঁচে থেকে।
যদি কেউ বলে এসে : ‘এই সেই নারী,
একে তুমি চেয়েছিলে এই সেই বিশুদ্ধ সমাজ–
তবুও দর্পণে অগ্নি দেখে কব্ে‌ ফুরায়ে গিয়েছে কার কাজ?

আমাদের মৃত্যু নেই আজ আর,
যদিও অনেক মৃত্যুপরস্পরা ছিলো ইতিহাসে;
বিস্তৃত প্রাসাদে তারা দেয়ালের অবলঙ ছবি;
নানারুপ ক্ষতি ক্ষয় নানা দিকে মরে গেছি — মনে পড়ে বটে
এইসব ছবি দেখি; বন্দীর মতন তবু নিস্তব্ধ পটে
নেই কোনো দেবদত্ত, উদয়ন, চিত্রসেনী স্থাণু।
এক দরজায় ঢুকে বহিস্কৃত হয়ে গেছে অন্য এক দুয়ারের দিকে
অমেয় আলোয় হেঁটে তারা সব।
(আমাদের পূর্বপুরুষেরা কোন্‌ বাতাসের শব্দ শুনেছিল;
তারপর হয়েছিলো পাথরের মতন নীরব?)
আমাদের মণিবন্ধে সময়ের ঘড়ি
কাচের গেলাসে জলে উজ্জুল শফরী;
সমুদ্রের দিবারৌদ্রে আরক্তিম হাঙরের মতো;
তারপর অন্য গ্রহ-নক্ষত্রেরা আমাদের ঘড়ির ভিতরে
যা হয়েছে, যা হতেছে, অথবা যা হবে সব এক সাথে প্রচারিত করে।
সৃষ্টির নাড়ীর ‘পরে হাত রেখে টের পাওয়া যায়
অসম্ভব বেদনার সাথে মিশে রয়ে গেছে অমোঘ আমোদ;
তবু তারা করে নাকো পরস্পরের ঋণশোধ।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #35

 

– জীবনানন্দ দাশ

আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে – এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয় – হয়তো বা শাঁখচিল শালিকের বেশে,
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিঁকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব কাঁঠাল ছায়ায়।
হয়তো বা হাঁস হবো – কিশোরীর – ঘুঙুর রহিবে লাল পায়
সারাদিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধভরা জলে ভেসে ভেসে।
আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে
জলঙ্গীর ঢেউ এ ভেজা বাংলারি সবুজ করুণ ডাঙ্গায়।

হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে।
হয়তো শুনিবে এক লক্ষীপেঁচা ডাকিতেছে শিমুলের ডালে।
হয়তো খৈয়ের ধান সরাতেছে শিশু এক উঠানের ঘাসে।
রূপসার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক সাদা ছেঁড়া পালে
ডিঙ্গা বায় – রাঙ্গা মেঘে সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে,
দেখিবে ধবল বক; আমারে পাবে তুমি ইহাদের ভীড়ে।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #36

 

– জীবনানন্দ দাশ

আমাকে একটি কথা দাও যা আকাশের মতো
সহজ মহৎ বিশাল,
গভীর; – সমস্ত ক্লান্ত হতাহত গৃহবলিভুকদের রক্তে
মলিন ইতিহাসের অন্তর ধুয়ে চেনা হাতের মতন,
আমি যাকে আবহমান কাল ভালোবেসে এসেছি সেই নারীর।
সেই রাত্রির নক্ষত্রালোকিত নিবিড় বাতাসের মতো:
সেই দিনের – আলোর অন্তহীন এঞ্জিন চঞ্চল ডানার মতন
সেই উজ্জ্বল পাখিনীর – পাখির সমস্ত পিপাসাকে যে
অগ্নির মতো প্রদীপ্ত দেখে অন্তিমশরীরিণী মোমের মতন।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #37

 

– জীবনানন্দ দাশ

আমাকে
তুমি দেখিয়েছিলে একদিন;
মস্ত বড় ময়দান — দেবদারু পামের নিবিড় মাথা — মাইলের পর মাইল;
দুপুরবেলার জনবিরল গভীর বাতাস
দূর শূন্যে চিলের পাটকিলে ডানার ভিতর অস্পষ্ট হয়ে হারিয়ে যায়;
জোয়ারের মতো ফিরে আসে আবার;

জানালায় জানালায় অনেক ক্ষণ ধরে কথা বলে:
পৃথিবীকে মায়াবী নদীর পারের দেশ বলে মনে হয়।
তারপর
দূরে
অনেক দূরে
খররৌদ্রে পা ছড়িয়ে বর্ষীয়সী রূপসীর মাতা ধান ভানে — গান গায় — গান গায়
এই দুপুরের বাতাস।

এক-একটা দুপুরে এক-একটা পরিপুর্ণ জীবন অতিবাহিত হয়ে যায় যেন।
বিকেলে নরম মুহুর্ত;
নদীর জলের ভিতর শম্বর, নীলগাই, হরিণের ছায়ার আসা যাওয়া;
একটা ধবর চিতল-হরিণীর ছায়া
আতার ধূসর ক্ষীরে গড়া মুর্তির মতো
নদীর জলে
সমস্ত বিকেলবেলা ধরে
স্থির!

মাঝে মাঝে অনেক দূর থেকে শ্মশানের চন্দনকাঠের চিতার গন্ধ
আগুণের — ঘিয়ের ঘ্রাণ;
বিকেলে
অসম্ভব বিষন্নতা।
ঝাউ হরিতকী শাল, নিভস্ত সূর্যে
পিয়াশাল পিয়াল আমলকী দেবদারু–
বাতাসের বুকে স্পৃহা, উৎসাহ, জীবনের ফেনা;

শাদা শাদাছিট কালো পায়রার ওড়াওড়ি জোছনায়–ছায়ায়,
রাত্রি;
নক্ষত্র ও নক্ষত্রের
অতীত নিস্তব্ধতা!

মরণের পরপারে বড়ো অন্ধকার
এই সব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #38

 

– জীবনানন্দ দাশ

আমাদের রূঢ় কথা শুনে তুমি সরে যাও আরো দূরে বুঝি নীলাকাশ;
তোমার অনন্ত নীল সোনালি ভোমরা নিয়ে কোনো দূর শান্তির ভিতরে
ডুবে যাবে? কত কাল কেটে গেল, তবু তার কুয়াশার পর্দা না সরে
পিরামিড্‌ বেবিলন শেষ হল — ঝরে গেল কতবার প্রান্তরের ঘাস;
তবুও লুকায়ে আছে যেই রূপ নক্ষত্রে তা কোনোদিন হল না প্রকাশ:
যেই স্বপ্ন যেই সত্য নিয়ে আজ আমরা চলিয়া যাই ঘরে,
কোনো এক অন্ধকারে হয়তো তা আকাশের যাযাবর মরালের স্বরে
নতুন স্পন্দন পায় নতুন আগ্রহে গন্ধে ভরে ওঠে পৃথিবীর শ্বাস;

তখন আমরা ওই নক্ষত্রের দিকে চাই — মনে হয় সব অস্পষ্টতা
ধীরে ধীরে ঝরিতেছে, — যেই রূপ কোনোদিন দেখি নাই পৃথিবীর পথে,
যেই শানি — মৃত জননীর মতো চেয়ে থাকে — কয় নাকো কথা,
যেই স্বপ্ন বার বার নষ্ট হয় আমাদের এই সত্য রক্তের জগতে,
আজ যাহা ক্লান্ত ক্ষীণ আজ যাহা নগ্ন চূর্ণ — অন্ধ মৃত হিম,
একদিন নক্ষত্রের দেশে তারা হয়ে রবে গোলাপের মতন রক্তিম।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #39

 

– জীবনানন্দ দাশ

আমার এ ছোটো মেয়ে — সব শেষ মেয়ে এই
শুয়ে আছে বিছানার পাশে –
শুয়ে থাকে —উঠে বসে —পাখির মতন কথা কয়
হামাগুড়ি দিয়ে ফেরে
মাঠে মাঠে আকাশে আকাশে

ভুলে যাই ওর কথা — আমার প্রথম মেয়ে সেই
মেঘ দিয়ে ভেসে আসে যেন
বলে এসে: ‘বাবা, তুমি ভালো আছ? ভালো আছ? — ভালোবাসো?
হাতখানা ধরি তার:ধোঁয়া শুধু কাপড়ের মতো শাদা মুখখানা কেন!

‘ব্যথা পাও? কবে আমি মরে গেছি — আজও মনে কর?’
দুই হাত চুপে চুপে নাড়ে তাই
আমার চোখের ’পরে, আমার মুখের ’পরে মৃত মেয়ে;
আমিও তাহার মুখে দু’হাত বুলাই;
তবু তার মুখ নাই — চোখ চুল নাই।

তবু তারে চাই আমি — তারে শুধু — পৃথিবীতে আর কিছু নয়
রক্ত মাংস চোখ চুল — আমার সে মেয়ে
আমার প্রথম মেয়ে — সেই পাখি — শাদা পাখি — তারে আমি চাই;
সে যেন বুঝিল সব — নতুন জীবন তাই পেয়ে
হঠাৎ দাঁড়াল কাছে সেই মৃত মেয়ে।

বলিল সে: ‘আমারে চেয়েছ, তাই ছোটো বোনটিরে –
তোমার সে ছোটো-ছোটো মেয়েটিরে এসেছি ঘাসের নিচে রেখে
সেখানে ছিলাম আমি অন্ধকারে এত দিন
ঘুমাতেছিলাম আমি’ — ভয় পেয়ে থেমে গেল মেয়ে,
বলিলাম: ‘আবার ঘুমাও গিয়ে —
ছোটো বোনটিরে তুমি দিয়ে যাও ডেকে।’

ব্যথা পেল সেই প্রাণ — খানিক দাঁড়াল চুপে — তারপর ধোঁয়া
সব তার ধোঁয়া হয়ে খসে গেল ধীরে ধীরে তাই,
শাদা চাদরের মতো বাতাসেরে জড়ায় সে একবার
কখন উঠেছে ডেকে দাঁড়কাক —
চেয়ে দেখি ছোটো মেয়ে হামাগুড়ি দিয়ে খেলে — আর কেউ নাই।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #40

 

– জীবনানন্দ দাশ

আমি কবি-সেই কবি-
আকাশে কাতর আঁখি তুলি হেরি ঝরা পালকের ছবি!
আন্‌মনা আমি চেয়ে থাকি দূর হিঙুল-মেঘের পানে!
মৌন নীলের ইশারায় কোন্ কামনা জাগিছে প্রাণে!
বুকের বাদল উথলি উঠিছে কোন্ কাজরীর গানে!
দাদুরী-কাঁদানো শাঙন-দরিয়া হৃদয়ে উঠিছে দ্রবি!

স্বপন-সুরার ঘোরে
আখের ভুলিয়া আপনারে আমি রেখেছি দিওয়ানা ক’রে!
জন্ম ভরিয়া সে কোন্ হেঁয়ালি হল না আমার সাধা-
পায় পায় নাচে জিঞ্জির হায়, পথে পথে ধায় ধাঁধা!
-নিমেষে পাসরি এই বসুধার নিয়তি-মানার বাধা
সারাটি জীবন খেয়ালের খোশে পেয়ালা রেখেছি ভ’রে!

ভুঁয়ের চাঁপাটি চুমি
শিশুর মতন, শিরীষের বুকে নীরবে পড়ি গো নুমি!
ঝাউয়ের কাননে মিঠা মাঠে মাঠে মটর-ক্ষেতের শেষে
তোতার মতন চকিতে কখন আমি আসিয়াছি ভেসে!
-ভাটিয়াল সুর সাঁঝের আঁধারে দরিয়ার পারে মেশে,-
বালুর ফরাশে ঢালু নদীটির জলে ধোঁয়া ওঠে ধূমি!

বিজন তারার সাঁঝে
আমার প্রিয়ের গজল-গানের রেওয়াজ বুঝি বা বাজে!
প’ড়ে আছে হেথা ছিন্ন নীবার, পাখির নষ্ট নীড়!
হেথায় বেদনা মা-হারা শিশুর, শুধু বিধবার ভিড়!
কোন্ যেন এক সুদূর আকাশ গোধূলিলোকের তীর
কাজের বেলায় ডাকিছে আমারে, ডাকে অকাজের মাঝে!

Bangla Kobita of Jibanananda Das #41

 

– জীবনানন্দ দাশ

আমি যদি হতাম বনহংস;
বনহংসী হতে যদি তুমি;
কোনো এক দিগন্তের জলসিঁড়ি নদীর ধারে
ধানক্ষেতের কাছে
ছিপছিপে শরের ভিতর
এক নিরালা নীড়ে;

তাহলে আজ এই ফাল্পুনের রাতে
ঝাউয়ের শাখার পেছনে চাঁদ উঠতে দেখে
আমরা নিম্নভূমির জলের গন্ধ ছেড়ে
আকাশের রুপালি শস্যের ভিতর গা ভাসিয়ে দিতাম-
তোমার পাখনায় আমার পালক, আমার পাখনায় তোমার রক্তের স্পন্দন-
নীল আকাশে খইক্ষেতের সোনালি ফুলের মতো অজস্র তারা,
শিরীষ বনের সবুজ রোমশ নীড়ে
সোনার ডিমের মতো
ফাল্গুনের চাঁদ।
হয়তো গুলির শব্দঃ
আমাদের তির্যক গতিস্রোত,
আমাদের পাখায় পিস্‌টনের উল্লাস,
আমাদের কন্ঠে উত্তর হাওয়ার গান!

হয়তো গুলির শব্দ আবারঃ
আমাদের স্তব্ধতা,
আমাদের শান্তি।
আজকের জীবনের এই টুকরো টুকরো মৃত্যু আর থাকত না:
থাকত না আজকের জীবনের টুকরো টুকরো সাধের ব্যর্থতা ও অন্ধকার;
আমি যদি বনহংস হতাম,
বনহংসী হতে যদি তুমি;
কোনো এক দিগন্তের জলসিড়ি নদীর ধারে
ধানক্ষেতের কাছে।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #42

 

– জীবনানন্দ দাশ

প্রান্তরের পারে তব তিমিরের খেয়া
নীরবে যেতেছে দুলে নিদালি আলেয়া!
-হেথা, গৃহবাতায়নে নিভে গেছে প্রদীপের শিখা,
ঘোমটায় আঁখি ঘেরি রাত্রি-কুমারিকা
চুপে চুপে চলিতেছে বনপথ ধরি!
আকাশের বুকে বুকে কাহাদের মেঘের গাগরী
ডুবে যায় ধীরে ধীরে আঁধার সাগরে!
ঢুলু-ঢুলু তারকার নয়নের পরে
নিশি নেমে আসে গাঢ়-স্বপনঙ্কুল!
শেহালায় ঢাকা শ্যাম বালুকার কূল
বনমালীর সাথে ঘুমায়েছে কবে!
বেণুবনশাখে কোন্‌ পেচকের রবে
চমকিছে নিরালা যামিনী!
পাতাল-নিলয় ছাড়ি কে নাগকামিনী
আঁকাবাঁকা গিরিপথে চলিয়াছে চিত্রা অভিসারিকার প্রায়!
শ্মশানশয্যায়
নেভ-নেভ কোন্‌ চিতা-স্ফুলিঙ্গেরে ঘিরে
ক্ষুধিত আঁধার আসি জমিতেছে ধীরে!
নিদ্রার দেউলমূলে চোখ দুটি মুদে
স্বপ্নের বুদ্‌বুদে
বিলসিছে যবে ক্লান্ত ঘুমন্তের দল-
হে অনল-উন্মুখ, চঞ্চল
উন্নমিত আঁখিদুটি মেলি
সন্তরি চলিছ তুমি রাত্রির কুহেলি
কোন্‌ দূর কামনার পানে!
ঝলমল দিবা অবসান
বধির আঁধারে
কান্তারের দ্বারে
একি তব মৌন নিবেদন!
-দিগভ্রান্ত-দরদী-উন্মন!
পল্লীপসারিণী যবে পণ্যরত্ন হেঁকে গেছে চ’লে
তোমার পিঙ্গল আঁখি ওঠে নি তো জ্বলে
আকাঙ্কার উলঙ্গ উল্লাসে!
জনতায়-নগরীর তোরণের পাশে,
অন্তঃপুরিকার বুকে, মণিসৌধসোপানের তীরে,
মরকত-ইন্দ্রনীল-অয়স্কান- খনির তিমিরে
যাও নি তো কভু তুমি পাথেয় সন্ধানে!
ভাঙা হাটে-ভিজা মাঠে-মরণের পানে
শীত প্রেতপুরে
একা একা মরিতেছ ঘুরে
না জানি কী পিপাসার ক্ষোভে!
আমাদের ব্যর্থতায়, আমাদের সকাতর কামনায় লোভে
মাগিতে আস নি তুমি নিমেষের ঠাঁই!
-অন্ধকার জলাভুমি কঙ্কালের ছাই,
পল্লীকান্তারের ছায়া-তেপান্তর পথের বিস্ময়
নিশীথের দীর্ঘশ্বাসময়
করিয়াছে বিমনা তোমারে!
রাত্রি-পারাবারে
ফিরিতেছ বারম্বার একাকী বিচরি!
হেমন্তের হিম পথ ধরি,
পউষ, আকাশতলে দহি দহি দহি
ছুটিতেছ বিহ্বল বিরহী
কত শত যুগজন্ম বহি!
কারে কবে বেসেছিলে ভালো
হে ফকির, আলেয়ার আলো!
কোন্‌ দূরে অস-মিত যৌবনের স্মৃতি বিমথিয়া
চিত্তে তব জাগিতেছে কবেকার প্রিয়া!
সে কোন্‌ রাত্রির হিমে হয়ে গেছে হারা!
নিয়েছে ভুলায়ে তারে মায়াবী ও নিশিমরু,
আঁধার সাহারা!
আজও তব লোহিত কপোলে
চুম্বন-শোণিমা তার উঠিতেছে জ্ব’লে
অনল-ব্যথায়!
চ’লে যায়-মিলনের লগ্ন চ’লে যায়!
দিকে দিকে ধূমাবাহু যায় তব ছুটি
অন্ধকারে লুটি লুটি লুটি!
ছলাময় আকাশের নিচে
লক্ষ প্রেতবধূদের পিছে
ছুটিয়া চলিছে তব প্রেম-পিপাসার
অগ্নি অভিসার!
বহ্নি-ফেনা নিঙাড়িয়া পাত্র ভরি ভরি,
অনন্ত অঙ্গার দিয়া হৃদয়ের পান্ডুলিপি গড়ি,
উষার বাতাস ভুলি, পলাতকা রাত্রির পিছনে
যুগ যুগ ছুটিতেছ কার অন্বেষণে।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #43

 

– জীবনানন্দ দাশ

হে নদী আকাশ মেঘ পাহাড় বনানী,
সৃজনের অন্ধকার অনির্দেশ উৎসের মতন
আজ এই পৃথিবীতে মানুষের মন
মনে হয়; অধঃপতিত এক প্রাণী।

প্রেম তার সব চেয়ে ছায়া, নিরাধার
নিঃস্বতায়- অকৃত্রিম আগুনের মত
নিজেকে না চিনে আজ রক্তে পরিণত
হে আগুন, কবে পাব জ্যোতিঃদীপাধার।

মানুষের জ্ঞানালোক সীমাহীন শক্তি পরিধির
ভিতরে নিঃসীম;
ক্ষমতার লালসায় অহেতুক বস্তুপুঞ্জে হুম;
সূর্য নয়- তারা নয়- ধোঁইয়ার শরীর।

এ অঙ্গার অগ্নি হোক, এই অগ্নি ধ্যানালোক হোক;
জ্ঞান হোক প্রেম,- প্রেম শোকাবহ জ্ঞান
হৃদয়ে ধারণ ক’রে সমাজের প্রাণ
অধিক উজ্জ্বল অর্থে করে নিক অশোক আলোক।

কাব্যগ্রন্থ – আলোপৃথিবী

Bangla Kobita of Jibanananda Das #44

 

– জীবনানন্দ দাশ

ঢের দিন বেঁচে থেকে দেখেছি পৃথিবীভরা আলো
তবুও গভীর গ্লানি ছিল কুরুবর্ষে রোমে ট্রয়ে;
উত্তরাধিকার ইতিহাসের হৃদয়ে
বেশি পাপ ক্রমেই ঘনালো।

সে গরল মানুষ ও মনীষীরা এসে
হয়তো বা একদিন ক’রে দেবে ক্ষয়;
আজ তবু কন্ঠে বিষ রেখে মানবতার হৃদয়
স্পষ্ট হতে পারে পরস্পরকে ভালবেসে।

কোথাও রয়েছে যেন অবিনশ্বর আলোড়নঃ
কোনো এক অন্য পথে- কোন্‌ পথে নেই পরিচয়;
এ মাটির কোলে ছাড়া অন্য স্থানে নয়;
সেখানে মৃত্যুর আগে হয় না মরণ।

আমাদের পৃথিবীর বনঝিরি জলঝিরি নদী
হিজল বাতাবী নিম বাবলার সেখানেও খেলা
করেছে সমস্ত দিন; হৃদয়কে সেখানে করে না অবহেলা
ফেনিল বুদ্ধির দৌড়;- আজকের মানবের নিঃসঙ্গতা যদি

সেসব শ্যামল নীল বিস্তারিত পথে
হ’তে চায় অন্য কোনো আলো কোনো মর্মের সন্ধানী,
মানুষের মন থেকে কাটবে না তা হ’লে যদিও সব গ্লানি
তবু আলো ঝল্কাবে অন্য এক সূর্যের শপথে।

আমাদের পৃথিবীর পাখালী ও নীলডানা নদী
আমলকী জামরুল বাঁশ ঝাউয়ে সেখানেও খেলা
করেছে সমস্ত দিন;- হৃদয়কে সেখানে করে না অবহেলা
বুদ্ধির বিচ্ছিন্ন শক্তি;- শতকের ম্লান চিহ্ন ছেড়ে দিয়ে যদি

নরনারী নেমে পড়ে প্রকৃত ও হৃদয়ের মর্মরিত হরিতের পথে-
অশ্রু রক্ত নিস্ফলতা মরণের খণ্ড খণ্ড গ্লানি
তাহ’লে রবে;- তবু আদি ব্যথা হবে কল্যাণী
জীবনের নব নব জলধারা- উজ্জ্বল জগতে।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #45

 

– জীবনানন্দ দাশ

সূর্যের আকাশের মত মানুষেরা অনুভাবনায় স্থির
এক আশ্বাস রয়ে গেছে পৃথিবীতে,
রয়ে গেছে আমাদের হৃদয়ে যে এই
ইতিহাস পৃথিবীর রক্তাক্ত নদীর কেবলি আয়ত
উৎসারণ অন্ধকারে নিজেরে প্রচুর ক’রে তবু
স্তিমিত হয়ে পড়ে;
মতুন নির্মল জলকণিকারা আসে
নক্ষত্রের সূর্যের নীলিমার মানব হৃদয়ের
আশ্চর্য রেবার হিল্লীলের মত।
সময় যা আচ্ছন্ন করেছিল তাকে সময় সংক্রান্তির পারে
মৃত্যু বা নিশ্চিহ্ন করেছিল তাকে উজ্জ্বল বস্তুপুঞ্জে
জাগিয়ে তুল্বার জন্যে দেখ
সচেতন হয়ে জেগে উঠে মানবঃ
চারিদিকে উন্মুক্ত সূর্যের
অন্তরালে সূর্যের
আলোর নক্ষত্রেরা রাত্রির নগরীর জ্ঞানের
অন্তহীন পরিচ্ছন্ন পবিত্রের ভিতর।

কাব্যগ্রন্থ – আলোপৃথিবী

Bangla Kobita of Jibanananda Das #46

 

– জীবনানন্দ দাশ

ইতিহাসপথ বেয়ে অবশেষে এই
শতাব্দীতে মানুষের কাজ
আশায় আলোয় শুরু হয়েছিল বুঝি- শুভ্র কথা
বলা হতেছিল;- রৌদ্রে জলে ভালোলেগেছিল
শরীরকে- জীবনকে।

কিন্তু তবু সবি প্রিয় মানুষের হাতে
অপ্রিয় প্রহার হয়ে মূল্যহীন মানুষের গায়ে
আশ্চর্য মৃত্যুর মত মূল্য হয়- হিম হয়।

মানুষের সভ্যতার বয়ঃসন্ধি দোষ
হয়তো কাটেনি আজো, তাই
এরকমই হতে হবে আরো রাত্রি দিন;-
নক্ষত্র সূর্যের সাথে সঞ্চালিত হয়ে তবু আলোকের পথে
মৃত ম্যামথের কাছে কুহেলিত ঋণ
শেষ ক’রে মানুষ সফল হতে পারে
উৎসাহ সংকল্প প্রেমে মূল্যের অক্ষুন্ন সংস্কারে;
আশা করা যাক।

সুধীরাও সেই কথা ভাবে,
আপ্রাণ নির্দেশ দান করে।
ইতিহাসে ঘুরপথ ভুল পথ গ্লানি হিংসা অন্ধকার ভয়
আরো ঢের আছে, তবু মানুষকে সেতু থেকে সেতুলোক পার হতে হয়।

কাব্যগ্রন্থ – আলোপৃথিবী

Bangla Kobita of Jibanananda Das #47

 

– জীবনানন্দ দাশ

সেই শৈশবের থেকে এ-সব আকাশ মাঠ রৌদ্র দেখেছি;
এই সব নক্ষত্র দেখেছি।
বিস্ময়র চোখে চেয়ে কতবার দেখা গেছে মানুষের বাড়ি
রোদের ভিতরে যেন সমুদ্রের পারে পাখিদের
বিষণ্ণ শক্তির মতো আয়োজনে নির্মিত হতেছে;
কোলাহলে-কেমন নিশীথ উৎসবে গ’ড়ে ওঠে।
একদিন শূন্যতায় স্তব্ধতায় ফিরে দেখি তারা
কেউ আর নেই।
পিতৃপুরুষেরা সব নিজ স্বার্থ ছেড়ে দিয়ে অতীতের দিকে
স’রে যায়- পুরানো গাছের সাথে সহমর্মী জিনিসের মতো
হেমন্তের রৌদ্রে-দিনে-অন্ধকারে শেষবার দাঁড়ায়ে তবুও
কখনো শীতের রাতে যখন বেড়েছে খুব শীত
দেখেছি পিপুল গাছ
আর পিতাদের ঢেউ
আর সব জিনিষ : অতীত।

তারপর ঢের দিন চ’লে গেলে আবার জীবনোৎসব
যৌনমত্তার চেয়ে ঢের মহীয়ান, অনেক করুণ।
তবুও আবার মৃত্যু।-তারপর একদিন মউমাছিদের
অনুরণনের বলে রৌদ্র বিচ্ছুরিত হ’ইয়ে গেলে নীল
আকাশ নিজের কন্ঠে কেমন নিঃসৃত হয়ে ওঠে;- হেমন্তের
অপরাহ্নে পৃথিবী মাঠের দিকে সহসা তাকালে
কোথাও শনের বনে- হলুদ রঙের খড়ে- চাষার আঙুলে
গালে-কেমন নিমীল সনা পশ্চিমের
অদৃশ্য সূর্যের থেকে চুপে নামে আসে;
প্রকৃতি ও পাখির শরীর ছুঁয়ে মৃতোপম মানুষের হাড়ে
কি যেন কিসের সৌরব্যবহারে এসে লেগে থাকে।
অথবা কখনো সূর্য- মনে পড়ে- অবহিত হয়ে
নীলিমার মাঝপথে এসে থেমে র’য়ে গেছে- বড়ো
গোল-রাহুর আভাস বেই-এমনই পবিত্র নিরুদ্বেল।
এই সব বিকেলের হেমন্তের সূর্যছবি- তবু
দেখাবার মতো আজ কোনো দিকে কেউ
নেই আর, অনেকেই মাটির শয়ানে ফুরাতেছে।
মানুষেরা এই সব পথে এসে চ’লে গেছে,- ফিরে
ফিরে আসে;- তাদের পায়ের রেখায় পথ
কাটে কারা, হাল ধরে, বীজ বোনে, ধান
সমুজ্বল কী অভিনিবেশে সোনা হয়ে ওঠে- দেখে;
সমস্ত দিনের আঁচ শেষ হলে সমস্ত রাতের
অগণন নক্ষত্রেও ঘুমাবার জুড়োবার মতো
কিছু নেই;- হাতুড়ি করাত দাঁত নেহাই তুর্‌পুন্
পিতাদের হাত থেকে ফিরেফির্‌তির মতো অন্তহীন
সন্ততির সন্ততির হাতে
কাজ ক’রে চ’লে গেছে কতো দিন।
অথবা এদের চেয়ে আরেক রকম ছিলো কেউ-কেউ;
ছোটা বা মাঝারি মধ্যবিত্তদের ভিড়;-
সেইখানে বই পড়া হত কিছু- লেখা হত;
ভয়াবহ অন্ধকারে সরুসলতের
রেড়ীর আলোয় মতো কী যেন কেমন এক আশাবাদ ছিল
তাহাদের চোখে মুখে মনের নিবেশে বিমনস্কতায়;
সাংসারে সমাজে দেশে প্রত্যন্তও পরাজিত হলে
ইহাদের মনে হত দীনতা জয়ের চেয়ে বড়;
অথবা বিজয় পরাজয় সব কোনো- এক পলিত চাঁদের
এ-পিঠ ও-পিঠ শুধু;- সাধনা মৃত্যুর পরে লোকসফলতা
দিয়ে দেবে; পৃথিবীতে হেরে গেলে কোনো ক্ষোভ নেই।

* * *

মাঝে-মাঝে প্রান্ত্রের জ্যোৎস্নায় তারা সব জড়ো হয়ে যেত-
কোথাও সুন্দর প্রেতসত্য আছে জেনে তবু পৃথিবীর মাটির কাঁকালে
কেমন নিবিড়ভাবে হয়ে ওঠে, আহা।
সেখানে স্থবির যুবা কোনো- এক তন্বী তরুণীর
নিজের জিনিস হতে স্বীকার পেয়েছে ভাঙ্গা চাঁদে
অর্ধ সত্যে অর্ধ নৃত্যে আধেক মৃত্যুর অন্ধকারেঃ
অনেক তরুণী যুবা- যৌবরাজ্যে যাহাদের শেষ
হয়ে গেছে- তারাও সেখানে অগণন
চৈত্রের কিরণে কিংবা হেমন্তের আরো।
অনবলুন্ঠিত ফিকে মৃগতৃষ্ণিকার
মতন জ্যোৎস্নায় এসে গোল হয়ে ঘুরে-ঘুরে প্রান্তরের পথে
চাঁদকে নিখিল ক’রে দিয়ে তবু পরিমেয় কলঙ্কে নিবিড়
ক’রে দিতে চেয়েছিল,- মনে মনে- মুখে নয়- দেহে
নয়; বাংলার মানসসাধনশীত শরীরের চেয়ে আরো বেশি
জয়ী হয়ে শুক্ল রাতে গ্রামীণ উৎসব
শেষ ক’রে দিতে গিয়ে শরীরের কবলে তো তবুও ডুবেছে বার-বার
অপরাধী ভীরুদের মতো প্রাণে।
তারা সব মৃত আজ।
তাহাদের সন্ততির সন্ততিরা অপরাধী ভীরুদের মতন জীবিত।
‘ঢের ছবি দেখা হল- ঢের দিন কেটে গেল- ঢের অভিজ্ঞতা
জীবনে জড়িত হয়ে গেল, তবু, হাতে খননের
অস্ত্র নেই- মনে হয়- চারিদিকে ঢিবি দেয়ালের
নিরেট নিঃসঙ্গ অন্ধকার’- ব’লে যেন কেউ যেন কথা বলে।
হয়তো সে বাংলার জাতীয় জীবন।
সত্যের নিজের রূপ তবুও সবের চেয়ে নিকট জিনিস
সকলের; অধিগত হলে প্রাণ জানালার ফাঁক দিয়ে চোখের মতন
অনিমেষ হয়ে থাকে নক্ষত্রের আকাশে তাকালে।
আমাদের প্রবীণেরা আমাদের আচ্ছন্নতা দিয়ে গেছে?
আমাদের মনীষীরা আমাদের অর্ধসত্য ব’লে গেছে
অর্ধমিথ্যার? জীবন তবুও অবিস্মরণীয় সততাকে
চায়; তবু ভয়- হয়তো বা চাওয়ার দীনতা ছাড়া আর কিছু নেই।
ঢের ছবি দেখা হল- ঢের দিনে কেটে গেল-ঢের অভিজ্ঞতা
জীবলে জড়িত হয়ে গেল, তবু, নক্ষত্রের রাতের মতন
সফলতা মানুষের দূরবীনে র’য়ে গেছে,- জ্যোতির্গ্রন্থে;
জীবনের জন্যে আজো নেই।
অনেক মানুষী খেলা দেখা হলো, বই পড়া সাঙ্গ হলো-ত বু
কে বা কাকে জ্ঞান দেবে- জ্ঞান বড় দূর- দূরতর আজ।
সময়ের ব্যাপ্তি যেই জ্ঞান আনে আমাদের প্রাণে
তা তো নেই; স্থবিরতা আছে- জরা আছে।
চারিদিক থেকে ঘিরে কেবলি বিচিত্র ভয় ক্লান্তি অবসাদ
র’য়ে গেছে। নিজেকে কেবলি আত্মকীড় করি; নীড়
গড়ি। নীড় ভেঙে অন্ধকারে এই যৌথ মন্ত্রণার
মাল্যিন এড়ায়ে উৎক্রান্ত হতে ভয়
পাই। সিন্ধুশব্দ বায়ুশব্দ রৌদ্রশব্দ রক্তশব্দ মৃত্যশব্দ এসে
ভয়াবহ ডাইনীর মতো নাচে- ভয় পাই- গুহার লুকাই;
লীন হতে চাই- লীন- ব্রহ্মশব্দে লীন হয়ে যেতে
চাই। আমাদের দু’হাজার বছরের জ্ঞান এ-রকম।
নচিকেতা ধর্মধনে উপবাসী হয়ে গেলে যম
প্রীত হয়। তবুও ব্রহ্মে লীন হওয়াও কঠিন।
আমারা এখনও লুপ্ত হই নি তো।
এখনও পৃথিবী সূর্যে হয়ে রৌদ্রে অন্ধকারে
ঘুরে যায়। থামালেই ভালো হত- হয়তো বা;
তবুও সকলই উৎস গতি যদি,- রৌদ্রশুভ্র সিন্ধুর উৎসবে
পাখির প্রমাথা দীপ্তি সাগরের সূর্যের স্পর্শে মানুষের
হৃদয়ে প্রতীক ব’লে ধরা দেয় জ্যাতির পথের থেকে যদি,
তাহলে যে আলো অর্ঘ্য ইতিহাসে আছে, তবু উৎসাহ নিবেশ
যেই জনমানসের অনির্বচনীয় নিঃসঙ্কোচ
এখনও আসে নি তাকে বর্তমান অতীতের দিকচক্রবালে বার-বার
নেভাতে জ্বালাতে গিয়ে মনে হয় আজকের চেয়ে আরো দূর
অনাগত উত্তরণলোক ছাড়া মানুষের তরে
সেই প্রীতি, স্বর্গ নেই, গতি আছে;- তবু
গতির ব্যসন থেকে প্রগতি অনেক স্থিরতর;
সে অনেক প্রতারণাপ্রতিভার সেতুলোক পার
হল ব’লে স্থির;-হতে হবে ব’লে দীন, প্রমাণ কঠিন;
তবুও প্রেমিক- তাকে হতে হবে; সময় কোথাও
পৃথিবীর মানুষের প্রয়োজন জেনে বিরচিত নয়; তবু
সে তার বহিমুর্খ চেতনার দান সব দিয়ে গেছে ব’লে
মনে হয়; এর পর আমাদের অন্তর্দীপ্ত হবার সময়।

কাব্যগ্রন্থ – বেলা অবেলা কালবেলা

Bangla Kobita of Jibanananda Das #49

 

অনেক কবিতা লিখে চলে গেলো যুবকের দল;

পৃথিবীর পথে-পথে সুন্দরীরা মূর্খ সসম্মানে
শুনিল আধেক কথা – এই সব বধির নিশ্চল
সোনার পিত্তল মূর্তি: তবু, আহা, ইহাদেরি কানে
অনেক ঐশ্বর্য ঢেলে চলে গেলো যুবকের দল:
একবার নক্ষত্রের পানে চেয়ে – একবার বেদনার পানে।

উত্তরপ্রবেশ
– জীবনানন্দ দাশ
পুরনো সময় সুর ঢের কেটে গেল।
যদি বলা যেত:
সমুদ্রের পারে কেটে গেছে
সোনার বলের মতো সুর্য ছিল পুবের আকাশে–
সেই পটভূমিকায় ঢের
ফেনশীর্ষ ঢেউ,
উড়ন্ত ফেনার মতো অগণন পাখি।
পুরনো বছর দেশ ঢের কেটে গেল
রোদের ভিতরে ঘাসে শুয়ে;
পুকুরের জল থেকে কিশোরের মতো তৃপ্ত হাতে
ঠান্ডা পানিফল, জল ছিড়ে নিতে গিয়ে;
চোখের পলকে তবু যুবকের মতো
মৃগনাভিঘন বড় নগরে পথে
কোনো এক সুর্যের জগতে
চোখের নিমেষ পড়েছিল।
সেইখানে সুর্য তুব অস্ত যায়।
পুনরুদয়ের ভোরে আসে
মানুষের হৃদয়ের অগোচর
গম্বুজের উপরে আকাশে।
এ ছাড়া দিনের কোনো সুর
নেই;
বসন্তের অন্য সাড়া নেই।
প্লেন আছে;
অগণন প্লেন
অগণ্য এয়োরোড্রাম
রয়ে গেছে
চারি দিকে উঁচুনিচু অন্তহীন নীড়–
হলেও বা হয়ে যেত পাখির মতন কাকলি
আনন্দে মুখর;

সেইখানে ক্লান্তি তবু–
ক্লান্তি–ক্লান্তি;
কেন ক্লান্তি
তা ভেবে বিস্ময়;
সেইখানে মৃত্যু তবু;
এই শুধু–
এই;
চাঁদ আসে একলাটি;
নক্ষত্রেরা দল বেঁধে আসে;
দিগন্তের সমুদ্রের থেকে হাওয়া প্রথম আবেগে
এসে তবু অস্ত যায়;
উদয়ের ভোরে ফিলে আসে
আপামর মানুষের হৃদয়ের অগোচর
রক্ত হেডলাইনের–রক্তের উপরে আকাশে।
এ ছাড়া পাখির কোনো সুর–
বসন্তের অন্য কোনো সাড়া নেই।
নিখিল ও নীড় জনমানবের সমস্ত নিয়মে
সজন নির্জন হয়ে থাকে
ভয় প্রেম জ্ঞান ভুল আমাদের মানবতা রোল
উত্তরপ্রবেশ করে আরো বড় চেতনার লোকে;
অনন্ত সূর্যের অস্ত শেষ করে দিয়ে
বীতশোক হে অশোক সঙ্গী ইতিহাস,
এ ভোর নবীন বলে মেনে নিতে হয়;
এখন তৃতীয় অঙ্ক অতএব; আগুনে আলোয় জ্যোতির্ময়।

কাব্যগ্রন্থ – সাতটি তারার তিমির

Bangla Kobita of Jibanananda Das #50

 

– জীবনানন্দ দাশ

আকাশের থেকে আলো নিভে যায় ব’লে মনে হয়।
আবার একটি দিন আমাদের মৃগতৃষ্ণার মতো পৃথিবীতে
শেষ হয়ে গেল তবে;— শহরের ট্রাম
উত্তেজিত হয়ে উঠে সহজেই ভবিতব্যতার
যাত্রীদের বুকে নিয়ে কোন্‌ এক নিরুদ্দেশ কুড়োতে চলেছে।
এই দিকে পায়দলদের ভিড়—অই দিকে টর্চের মশালে বার—বার
যে যার নিজের নামে সকলের চেরে আগে নিজের নিকটে
পরিচিত;— ব্যক্তির মতন নিঃসহায়;
জনতাকে অবিকল অমঙ্গল সমুদ্রের মতো মনে ক’রে
যে যার নিজের কাছে নিবারিত দ্বীপের মতন
হয়ে পড়ে অভিমানে—ক্ষমাহীন কঠিন আবেগে।

সে মুহূর্ত কেটে যায়; ভালোবাসা চায় না কি মানুষ নিজের
পৃথিবীর মানুষের? শহরে রাত্রির পথে হেঁটে যেতে যেতে
কোথাও ট্রাফিক থেকে উৎসারিত অবিরল ফাঁস
নাগপাশ খুলে ফেলে কিছুক্ষণ থেমে থেমে এ রকম কথা
মনে হয় অনেকেরই;—
আত্মসমাহিতিকূট ঘুমায়ে গিয়েছে হৃদয়ের!
তবু কোনো পথ নেই এখনো অনেক দিন, নেই।
একটি বিরাট যুদ্ধ শেষ হয়ে নিভে গেছে প্রায়।
আমাদের আধো-চেনা কোনো-এক পুরোনো পৃথিবী
নেই আর। আমাদের মনে চোখে প্রচারিত নতুন পৃথিবী
আসে নি তো।
এই দুই দিগন্তের থেকে সময়ের
তাড়া খেয়ে পলাতক অনেক পুরুষ—নারী পথে
ফুটপাতে মাঠে জীপে ব্যারাকে হোটেলে অলিগলির উত্তেজে
কমিটি-মিটিঙে ক্লাবে অন্ধকারে অনর্গল ইচ্ছার ঔরসে
সঞ্চারিত উৎসবের খোঁজে আজো সূর্যের বদলে
দ্বিতীয় সূর্যকে বুঝি শুধু অন্ন, শক্তি, অর্থ, শুধু মানবীর
মাংসের নিকটে এসে ভিক্ষা করে। সারাদিন— অনেক গভীর
রাতের নক্ষত্র ক্লান্ত হয়ে থাকে তাদের বিলোল কাকলীতে।
সকল নেশন আজ এই এক বিলোড়িত মহা-নেশনের
কুয়াশায় মুখ ঢেকে যে যার দ্বীপের কাছে তবু
সত্য থেকে— শতাব্দীর রাক্ষসী বেলায়
দ্বৈপ-আত্মা-অন্ধকার এক-একটি বিমুখ নেশন।

শীত আর বীতশোক পৃথিবীর মাঝখানে আজ
দাঁড়ায়ে এ জীবনের কতগুলো পরিচিত সত্ত্বশূন্য কথা—
যেমন নারীর প্রেম, নদীর জলের বীথি, সারসের আশ্চর্য ক্রেঙ্কার
নীলিমায়, দীনতায় যেই জ্ঞান, জ্ঞানের ভিতর থেকে যেই
ভালোবাসা; মানুষের কাছে মানুষের স্বাভাবিক
দাবীর আশ্চর্য বিশুদ্ধতা; যুগের নিকটে ঋণ, মনবিনিময়,
এবং নতুন জননীতিকের কথা— আরো স্মরণীয় কাজ
সকলের সুস্থতার— হৃদয়ের কিরিণের দাবী করে; আর অদূরের
বিজ্ঞানের আলাদা সজীব গভীরতা;
তেমন বিজ্ঞান যাহা নিজের প্রতিভা দিয়ে জেনে সেবকের
হাত দিব্য আলোকিত ক’রে দেয়— সকল সাধের
কারণ-কর্দম-ফেণা প্রিয়তর অভিষেকে স্নিগ্ধ ক’রে দিতে;—
এই সব অনুভব ক’রে নিয়ে সপ্রতিভ হতে হবে না কি।
রাত্রির চলার পথে এক তিল অধিক নবীন
সম্মুখীন— অবহিত আলোকবর্ষের নক্ষত্রেরা
জেগে আছে। কথা ভেবে আমাদের বহিরাশ্রয়িতা
মানবস্বভাবস্পর্শে আরো ঋত— অন্তর্দীপ্ত হয়।

কাব্যগ্রন্থ – বেলা অবেলা কালবেলা

Bangla Kobita of Jibanananda Das #51

 

– জীবনানন্দ দাশ

পৃথিবীতে ঢের দিন বেঁচে থেকে যখন হয়েছে পূর্ণ সময়ের অভিপ্রায়-
আগাগোড়া জীবনের দিক চেয়ে কে আবার আয়ু চায়?
যদিও চোখের ঘুম ভুলে গিয়ে মননের অহঙ্কারে চর্বি জ্বালায়

অপ্রেমিক, কোনো কিছু শেষ সত্য জেনে নেবে বিষয়ের থেকে।
তবু কোনো জাদুকর পুরানো স্ফটিক তার যায় নাই রেখে।
সময় কাটাতে হয় ব্যবহৃত হস্তাক্ষরে চীবরের ছায়াপাত দেখে।

অথবা উদ্রিক্ত যারা হয় নাক’- চিরকাল থাকে সমীচীন,-
তাহাদের মুণ্ড যেন কালো হাঁড়ি- মাচার উপরে সমাসীন;
মৃত্যু নাই তাহাদের;- জানে সব দেবী, পরী, জিন।

আর যারা বহুদিন পৃথিবীতে মেধে- মনে- ছিল কর্মক্ষম,
তারপর বুড়ো হয়ে স্মরণ করিতে চায় অবলুপ্ত মলয়াচলমঃ
তাদের হৃদয়ে ঢের মেষ আছে নাই কোনো শুভ্রঘ্রাণ গম।

পৃথিবীতে ঢের দিন বেঁচে থেকে যখন হয়েছে পূর্ণ সময়ের অভিপ্রায়-
আগাগোড়া জীবনের দিক চেয়ে কে আবার আয়ু চায়?
কন্যা তুলা কর্কটের বৃশ্চিকের আবার ঘটুক সমবায়।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #52

 

– জীবনানন্দ দাশ

কোথাও নদীর পারে সময়ের বুকে-
দাঁড়ায়ে রয়েছে আজো সাবেককালের এক স্তিমিত প্রাসাদ;
দেয়ালে একটি ছবিঃ বিচারসাপেক্ষ ভাবে নৃসিংহ উঠেছে;
কোথাও মঙ্গল সংঘটন হ’য়ে যাবে অচিরাৎ।

নিবিড় রমণী তার জ্ঞানময় প্রেমিকের খোঁজে
অনেক মলিন যুগ- অনেক রক্তাক্ত যুগ সমুত্তীর্ণ ক’রে
আজ এই সময়ের পারে এসে পুনরায় দেখে
আবহ্মানের ভাঁড় এসেছে গাধার পিঠে চ’ড়ে।

স্বাক্ষরের অক্ষরের অমেয় স্তূপের নিচে ব’সে থেকে যুগ
কোথাও সংগতি তবু পায়নাকো তার;
ভারে কাটে- তথাপিও ধারে কাটে ব’লে
সমস্ত সমস্যা কেটে দেয় তরবার।

চোখের উপরে
রাত্রি ঝরে
যে-দিকে তাকাই,
কিছু নাই
রাত্রি ছাড়া;
অন্ধকার সমুদ্রের তিমির মতন
উদীচীর দিকে ভেসে যাই;
ম্যানিলা- হাওয়াই,
টাহিটির দ্বীপ,
কাছে এসে দূরে চ’লে যায়-
দূরতর দেশে।
কী এক অশেষ কাজ করেছিলো তিমি;
সিন্ধুর রাত্রির জল এসে
মৃদু মর্মরিত জলে মিশে গিয়ে তাকে
বোর্নিওর সাগরের শেষে-
যেখানে বোর্নিও নেই- ম্লান আলাস্কাকে
ডাকে।
যতদূর যেতে হয়
ততদূর অবাচীর অন্ধকারে গিয়ে
তিমিরশিকারী এক নাবিককে আমি
ফেলেছি হারায়ে;
কোথায় রয়েছি-
জীব হ’য়ে কবে
ভূমিষ্ঠ হয়েছি।
এই তো জীবনঃ
সমুদ্রের অন্ধকারে প্রবেশাধিকারে;
নিপাট আঁধার;
ভালো বুঝে পুনরায়
সাগরের সৎ অন্ধকারে নিষ্ক্রমণ।
সবি আজো প্রতিশ্রুতি, তাই
দোশ হ’য়ে সব
হ’য়ে গেছে গুণ।
বেবুনের রাত্রি নয় তার হৃদয়ের
রাত্রির বেবুন।

কাব্যগ্রন্থ – সাতটি তারার তিমির

Bangla Kobita of Jibanananda Das #53

 

– জীবনানন্দ দাশ

একটা মোটরকার
খটকা নিয়ে আসে।

মোটরকার সব-সময়েই একটা অন্ধকার জিনিস,
যদিও দিনের রৌদ্র-আলোর পথে
রাতের সুদীপ্ত গ্যাসের ভিতর
আলোর সন্তানদের মধ্যে
তার নাম সবচেয়ে প্রথম।

একটা অন্ধকার জিনিস :
পরিষ্কার ভোরের বেলা
দেশের মটরশুঁটি-কড়াইয়ের সবুজ ক্ষেতে-মাঠে হাঁটতে হাঁটতে
হঠাৎ অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছি
লাল সুরকির রাস্তার ভিতর দিয়ে
হিজলগাছ দুটোর নিচে দিয়ে
উনিশশো চৌত্রিশের মডেল একটা মোটরকার
ঝকমক করছে, ঝড় উড়িয়ে ছুটেছে;
পথ ঘাট ক্ষেত শিশির সরে যেতে থাকে,
ভোরের আলো প্রতিকূল যুক্তির বিরুদ্ধে কোণের বধূর মতো
সহসা অগোচর
মাঠ নদী যেন নিশ্চেষ্ট,
সহসা যেন প্রতীজ্ঞা হারিয়ে ফেলে,
এই মোটর অগ্রদূত,
সে ছুটে চলেছে
যেই পথে সকলের যাওয়া উচিত;
একটা মোটরকারের পথ
সব সময়েই আমার কাছে খটকার মতো মনে হয়েছে,
অন্ধকারের মতো।
স্ট্যান্ডে
শহরের বিরাট ময়দানের পুবে পশ্চিমে-ফুটপাথের পাশে
মোটারকার;
নিঃশব্দ।
মাথায় হুড
ভিতরের বুরুশ-করা গভীর গদিগুলো
পালিশ স্টিয়ারিং-হুইল হেডলাইট;
কী নিয়ে স্থির?
কলকাতার ময়দানের একটা গাছ অন্য কিছু নিয়ে স্থির,
আমি অন্যকিছু নিয়ে স্থির;
মোটরের স্থিরতা একটা অন্ধকার জিনিস

একটা অন্ধকার জিনিস :
রাতের অন্ধকারে হাজার-হাজার কার হু-হু করে ছুটছে
প্যারিসে-নিউইয়র্কে-লন্ডনে-বার্লিনে-ভিয়েনায়-কলকাতায়
সমুদ্রের এপার ওপার ছুঁয়ে
অসংখ্য তারের মতো,
রাতের উল্কার মতো,
মানুষ-মানুষীর অবিরাম সংকল্প আয়োজনের অজস্র আলেয়ার মতো
তারাও চলেছে;
কোথায় চলেছে, তা আমি জানি না।

একটা মোটরকারের পথ- মোটরকার
সবসময়ই আমার কাছে খটকার মতো মনে হয়েছে,
অন্ধকারের মতো।

আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না;
আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে,
পৌঁছে অনেকক্ষণ বসে অপেক্ষা করবার অবসর আছে।
জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা
অন্য সবাই বহন করে করুক; আমি প্রয়োজন বোধ করি না :
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #54

 

– জীবনানন্দ দাশ

এই কি সিন্ধুর হাওয়া? রোদ আলো বনানীর বুকের বাতাস
কোথায় গভীর থেকে আসে!
অগণন পাখী উড়ে চ’লে গেলে তবু নীলাকাশ
কথা বলে নিজের বাতাসে।

রাঙা মেঘ- আদি সূর্য- স্বাভাবিক সামাজিক ব্যবহার সব
ফুরিয়ে গিয়েছে কত দূরে।
সে অনেক মানবীয় কাল ভেঙে এখন বিপ্লব
নতুন মানব-উৎস কোথাও রয়েছে এই সুরে।

যাযাবর ইতিহাসসহ পথ চিনে নিতে চায়।
অনেক ফ্যাক্টরি ফোর্ট ব্যাঙ্কারেরো আত্নস্থ মনের
অমার ভিতরে অমা রজনীর ভূকম্পনে কথা বলে যায়ঃ
আলো নেই, তবু তার অভিগমনের।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #55

 

– জীবনানন্দ দাশ

এই জল ভালো লাগে; বৃষ্টির রূপালি জল কত দিন এসে
ধুয়েছে আমার দেহ — বুলায়ে দিয়েছে চুল — চোখের উপরে
তার শান — স্নিগ্ধ হাত রেখে কত খেলিয়াছে, — আবেগের ভরে
ঠোঁটে এসে চুমা দিয়ে চলে গেছে কুমারীর মতো ভালোবেসে;
এই জল ভালো লাগে; — নীলপাতা মৃদু ঘাস রৌদ্রের দেশে
ফিঙ্গা যেমন তার দিনগুলো ভালোবাসে — বনের ভিতর
বার বার উড়ে যায়, — তেমনি গোপন প্রেমে এই জল ঝরে
আমার দেহের পরে আমার চোখের পরে ধানের আবেশে

ঝরে পড়ে; — যখন অঘ্রাণ রাতে ভরা ক্ষেত হয়েছে হলুদ,
যখন জামের ডালে পেঁচার নরম হিম গান শোনা যায়,
বনের কিনা েঝরে যেই ধান বুকে করে শান — শালিখুদ,
তেমনি ঝরিছে জল আমার ঠোঁটের পরে চোখের পাতায় –
আমার চুলের পরে, — অপরাহ্নে রাঙা রোদে সবুজ আতায়
রেখেছে নরম হাত যেন তার — ঢালিছে বুকের থেকে দুধ।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #56

 

– জীবনানন্দ দাশ

এই ডাঙা ছেড়ে হায় রূপ কে খুঁজিতে যায় পৃথিবীর পথে।
বটের শুকনো পাতা যেন এক যুগান্তের গল্প ডেকে আনে:
ছড়ায়ে রয়েছে তারা প্রান্তরের পথে পথে নির্জন অঘ্রানে;-
তাদের উপেক্ষা ক’রে কে যাবে বিদেশে বলো- আমি কোনো-মতে
বাসমতী ধানক্ষেত ছেড়ে দিয়ে মালাবারে- উটির পর্বতে
যাব নাকো, দেখিব না পামগাছ মাথা নাড়ে সমুদ্রের গানে
কোন দেশে,- কোথায় এলাচিফুল দারুচিনি বারুণীর প্রাণে
বিনুনী খসায়ে ব’সে থাকিবার স্বপ্ন আনে;- পৃথিবীর পথে

যাব নাকো : অশ্বত্থের ঝরাপাতা স্লান শাদা ধুলোর ভিতর,
যখন এ- দু’-পহরে কেউ নাই কোনো দিকে- পাখিটিও নাই,
অবিরল ঘাস শুধু ছড়ায়ে র’য়েছে মাটি কাঁকরের ’পর,
খড়কুটো উল্টায়ে ফিরিতেছে দু’একটা বিষণ্ণ চড়াই,
অশ্বত্থের পাতাগুলো প’ড়ে আছে স্লান শাদা ধুলোর ভিতর;
এই পথ ছেড়ে দিয়ে এ-জীবন কোনোখানে গেল নাকো তাই।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #57

 

– জীবনানন্দ দাশ

আমার জীবনে কোনো ঘুম নাই
মৎস্যনারীদের মাঝে সবচেয়ে রূপসী সে নাকি
এই নিদ্রা?

গায় তার ক্ষান্ত সমুদ্রের ঘ্রাণ- অবসাদ সুখ
চিন্তার পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন-বিমুখ
প্রাণ তার

এই দিন এই রাত্রি আসে যায়- বুঝিতে দেয় না তারে; কোনো ধ্বনি ঘ্রাণ
কোনো ক্ষুধা- কোনো ইচ্ছা- পরীরো সোনার চুল হয় যাতে ম্লানঃ
আমাদের পৃথিবীর পরীদের;- জানেনা সে; শোনেনা সে
জীবনের লক্ষ্য মৃত নিঃশ্বাসের স্বর;
তাহলে ঘুমাত কবে; সে শুধু সুন্দর,
প্রশ্নহীন অভিজ্ঞতাহীন দূর নক্ষত্রের মতো
সুন্দর অমর শুধু; দেবতারা করেনি বিক্ষত
ইহাদের।

এদের অপার রূপ শান্তি সচ্ছলতা
তবুও জানিত যদি আমার এ-জীবনের মুহূর্তের কথা
মানুষের জীবনের মুহূর্তের কথা।

দেবতারা করেনি বিক্ষত ইহাদেরঃ
(দেবতারা করেনি বিক্ষত নিজেদের
কোনো অভিজ্ঞতা নাই দেবতার)
ঘুঘুদের শাদা ডানা- নীল রাত্রি- কমলরঙের মেঘ- সমুদ্রের ফেনা রোদ-
হরিণের বুকে বেদনার
নীরব আঘাত;
এরা প্রশ্ন করেনাকোঃ ইহারা সুন্দর শান্ত- জীবনের উদ্‌যাপনে সন্দেহের হাত
ইহারা তোলে না কেউ আঁধারে আকাশে
ইহাদের দ্বিধা নাই- ব্যথা নাই- চোখে ঘুম আসে।
শুনেছে কে ইহাদের মুখে কোনো অন্ধকার কথা?
সকল সংকল্প চিন্তা রক্ত আনে ব্যথা আনে- মানুষের জীবনের এই বীভৎসা
ইহাদের ছোঁয় নাকো;-
ব্যুবনিক প্লেগের মতন
সকল আচ্ছন্ন শান্ত স্নিগ্ধতারে নষ্ট ক’রে ফেলিতেছে মানুষের মন!

গোলাপী ধূসর মেঘে পশ্চিমের বিয়োগ সে দ্যাখে না কি?
প্রজাপতি পাখি-মেয়ে করেনা কি মানুষের জীবনের ব্যথা আহরণ?
তবু এরা ব্যথা নয়ঃ ইহারা আবৃত সব- বিচিত্র- নীরব
অবিরল জাদুঘর এরা এক;- এরা রূপ ঘুম শান্তি স্থির
এই মৃত পাখি কীট- প্রজাপতি রাঙা মেঘ- সাপের আঁধার মুখে
ফরিঙের জোনাকির নীড়
এইসব।
আমি জানি, একদিন আমিও এমন
পতঙ্গের হৃদয়ের ব্যথা হব- সমুদ্রের ফেনা শাদা ফেনায় যেমন
ভেঙে পড়ে- ব্যথা পায়।
মানুষের মন
তবুও রক্তাক্ত হয় কেন এক অন্য বেদনায়
কীট যাহা জানে নাকো- জানে নাকো নদী ফেনা ঘাসরোদ- শিশির কুয়াশা
জ্যোৎস্নাঃ আম্লান হেলিওট্রোপ হায়!
এ-সৃষ্টির জাদুঘরে রূপ তারা- শান্তি- ছবি- তাহারা ঘুমায়
সৃষ্টি তাই চায়।

ভুলে যাব যেই সাধ- যে-সাহস এনেছিলো মানুষ কেবল
যাহা শুধু গ্লানি হলো- কৃপা হলো- নক্ষত্রের ঘৃণা হলো-
অন্য কোনো স্থল
পেল নাকো।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #58

 

– জীবনানন্দ দাশ

এই পৃথিবীতে আমি অবসর নিয়ে শুধু আসিয়াছি — আমি হৃষ্ট কবি
আমি এক; — ধুয়েছি আমার দেহ অন্ধকারে একা একা সমুদ্রের জলে;
ভালোবাসিয়াছি আমি রাঙা রোদ, ক্ষান্ত কার্তিকের মাঠে — ঘাসের আঁচলে
ফড়িঙের মতো আমি বেড়ায়েছি — দেখেছি কিশোরী এস হলুদ করবী
ছিঁড়ে নেয় — বুকে তার লাল পেড়ে ভিজে শাড়ি করুন শঙ্খের মতো ছবি
ফুটাতেছে — ভোরের আকাশখানা রাজহাস ভরে গেছে নব কোলাহলে
নব নব সূচনার: নদীর গোলাপী ঢেউ কথা বলে — তবু কথা বলে,
তবু জানি তার কথা কুয়াশায় ফুরায় না — কেউ যেন শুনিতেছে সবি

কোন্‌ রাঙা শাটিনের মেঘে বসে — অথবা শোনে না কেউ, শূণ্য কুয়াশায়
মুছে যায় সব তার; একদিন বর্ণচ্ছটা মুছে যাবো আমিও এমন;
তবু আজ সবুজ ঘাসের পরে বসে থাকি; ভালোবাসি; প্রেমের আশায়
পায়ের ধ্বনির দিকে কান পেতে থাকি চুপে; কাঁটাবহরের ফল করি আহরণ
কারে যেন এই গুলো দেবো আমি; মৃদু ঘাসে একা — একা বসে থাকা যায়
এই সব সাধ নিয়ে; যখন আসিবে ঘুম তারপর, ঘুমাব তখন।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #59

 

– জীবনানন্দ দাশ

এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে – সবচেয়ে সুন্দর করুণ :
সেখানে সবুজ ডাঙা ভ’রে আছে মধুকূপী ঘাসে অবিরল;
সেখানে গাছের নাম : কাঁঠাল, অশ্বত্থ, বট, জারুল, হিজল;
সেখানে ভোরের মেঘে নাটার রঙের মতো জাগিছে অরুণ;
সেখানে বারুণী থাকে গঙ্গাপসাগরের বুকে, – সেখানে বরুণ
কর্ণফুলী ধলেশ্বরী পদ্মা জলাঙ্গীরে দেয় অবিরল জল;
সেইখানে শঙ্খচিল পানের বনের মতো হাওয়ায় চঞ্চল,
সেইখানে লক্ষ্ণীপেঁচা ধানের গন্ধের মতো অস্ফুট, তরুণ;

সেখানে লেবুর শাখা নুয়ে থাকে অন্ধকারে ঘাসের উপর;
সুদর্শন উড়ে যায় ঘরে তার অন্ধকার সন্ধ্যার বাতাসে;
সেখানে হলুদ শাড়ি লেগে থাকে রূপসীর শরীরের ’পর –
শঙ্খমালা নাম তার : এ- বিশাল পৃথিবীর কোনো নদী ঘাসে
তারে আর খুঁজে তুমি পাবে নাকো বিশালাক্ষী দিয়েছিল বর,
তাই সে জন্মেছে নীল বাংলার ঘাস আর ধানের ভিতর।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #60

 

– জীবনানন্দ দাশ

এই পৃথিবীর বুকের ভিতরে কোথাও শান্তি আছে;
অঘ্রাণ মাস রাত্রি হ’লে অনেক বিষয়াবিষের সমাধান
মাঠে জলে পাখির নীড়ে নক্ষত্রেতে থাকে;
অমেয় গোলকধাঁধাঁয় ঘুরে প্রাণ
চেষ্টা করে সমাজ জাতি সময় সৃষ্টি সঠিক বুঝে নিতে।
সকল প্রয়াণ সফল হবে গ্লাশিয়ারের দীপ্তি আসার আগে;
এখন রৌদ্রে আজন্মকাল অনুষ্ঠানের দিন;
সফল হতে ইতিহাসের অনেক দিন লাগে।

সে সফলতা এই পৃথিবী- হয়তো সৃশঠি চূর্ণ হ’লে হবে;
আমি অনেক দূরের থেকে তাহার কারণধ্বনি
নদীর জলে সমস্ত দিন ক্রন্দসী উজ্জ্বল;
তোমায় আমি ভালোবাসি- এই সত্য স্বভাবপৃথিবীর
দানের মতন নিজেরই ফলাফল।

কাব্যগ্রন্থ – আলোপৃথিবী

Bangla Kobita of Jibanananda Das #61

 

– জীবনানন্দ দাশ

(অগণন সাধারণের)

সে এক বিচ্ছিন্ন দিনে আমাদের জন্ম হয়েছিলো
ততোধিক অসুস্থ সময়ে
আমাদের মৃত্যু হয়ে যায়।
দূরে কাছ শাদা উঁচু দেয়ালের ছায়া দেখে ভয়ে
মনে করে গেছি তাকে- ভালোভাবে মনে ক’রে নিলে-
এইখানে জ্ঞান হতে বেদনার সুরু-
অথবা জ্ঞানের থেকে ছুটি নিয়ে সান্ত্বনার হিম হ্রদে একাকী লুকালে
নির্জন স্ফটিকস্তম্ভ খুলে ফেলে মানুষের অভিভূত ঊরু
ভেঙে যাবে কোনো এক রম্য যোদ্ধা এসে।
নরকেও মৃত্যু নেই- প্রীতি নেই স্বর্গের ভিতরে;
মর্ত্যে সেই স্বর্গ নরকের প্রতি সৎ অবিশ্বাস
নিস্তেজ প্রতীতি নিয়ে মনীষীরা প্রচারিত করে।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #62

 

– জীবনানন্দ দাশ

বারবার সেই সব কোলাহল সমারোহ রীতি রক্ত,- ক্লান্তি লাগে যেন;
তাহারা অনেক জানে- এই দূর মাঠে আমি খুঁজি নাকো জীবনের মানে
শুধু এই মাঠ- রাত- আমারে ডেকেছে, আহা, বলেছি- ‘যাবোনা আর’- কেন

কেন যাবো? এই ধুলো গাভী হাঁস জ্যোৎস্না ছেড়ে আমি যাবো কোনখানে
সেখানে চিন্তার ব্যথা- ব্যথা না কি? আজ রাতে শুধু আমি শান্তির আকাশ
চেয়েছি যে- সেই ভালো- কথা কাজ প্রশ্ন শুধু ভুল করে- ব্যথা বহে আনে,

শান্তি ভালো;- বাদামি পাতার ঘ্রাণ ভালো না কি? পাখির সোনালি
চোখ- ঘাস
কোথায় বিবরে তার মাছরাঙা- তার রঙ তার নীড়- হৃদয়ের সাধ
এই নিয়ে কথা ভাবা এইখানে- ছবি আঁকা- মৃদু ছবি- নরম উচ্ছ্বাস;

ইঁদুর ধানের শিষ বেয়ে ওঠেঃ এই ছড়া এই সোনা আকাশের চাঁদ
এরা যেন নীড় তার- আমারো হৃদয় আজ চুপ হ’য়ে শুধু রঙ ঘ্রাণ
শুধু শান্তি- নিঃশব্দতা- আবিষ্কার;- এই সব এই সব সঞ্চয়ের স্বাধ

জীবনেরে এই ব’লে জানিতেছে- জ্যোৎস্না আরো শান্ত হ’য়ে ভরেছে উঠান
রাত্রি আরো ছবি হ’য়ে রূপ হ’য়ে ঘাসের কীটের মুখে শুনিতেছে গান।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #63

 

– জীবনানন্দ দাশ

(এই সব ভালো লাগে) : জানালার ফাঁক দিয়ে ভোরের সোনালি রোদ এসে
আমারে ঘুমাতে দেখে বিছানায়,—আমার কাতর চোখ, আমার বিমর্ষ ম্লান চুল –
এই নিয়ে খেলা করে: জানে সে যে বহুদিন আগে আমি করেছি কি ভুল
পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমাহীন গাঢ় এক রূপসীর মুখ ভালোবেসে,
পউষের শেষ রাতে আজো আমি দেখি চেয়ে আবার সে আমাদের দেশে
ফিরে এল; রং তার কেমন তা জানে অই টসটসে ভিজে জামরুল,
নরম জামের মতো চুল তার, ঘুঘুর বুকের মতো অস্ফুট আঙুল; –
পউষের শেষ রাতে নিমপেঁচাটির সাথে আসে সে যে ভেসে

কবেকার মৃত কাক: পৃথিবীর পথে আজ নাই সে তো আর;
তবুও সে ম্লান জানালার পাশে উড়ে আসে নীরব সোহাগে
মলিন পাখনা তার খড়ের চালের হিম শিশিরে মাখায়;
তখন এ পৃথিবীতে কোনো পাখি জেগে এসে বসেনি শাখায়;
পৃথিবীও নাই আর; দাঁড়কাক একা — একা সারারাত জাগে;
কি বা হায়, আসে যায়, তারে যদি কোনোদিন না পাই আবার।
নিমপেঁচা তবু হাঁকে : ‘পাবে নাকো কোনোদিন, পাবে নাকো
কোনোদিন, পাবে নাকো কোনোদিন আর।’

Bangla Kobita of Jibanananda Das #64

 

– জীবনানন্দ দাশ

একটি নক্ষত্র আসে; তারপর একা পায়ে চ’লে
ঝাউয়ের কিনার ঘেঁষে হেমন্তের তারাভরা রাতে
সে আসবে মনে হয়; – আমার দুয়ার অন্ধকারে
কখন খুলেছে তার সপ্রতিভ হাতে!
হঠাৎ কখন সন্ধ্যা মেয়েটির হাতের আঘাতে
সকল সমুদ্র সূর্য সত্বর তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাত্রি হতে পারে
সে এসে এগিয়ে দেয়;
শিয়রে আকাশ দূর দিকে
উজ্জ্বল ও নিরুজ্জ্বল নক্ষত্র গ্রহের আলোড়নে
অঘ্রানের রাত্রি হয়;
এ-রকম হিরন্ময় রাত্রি ইতিহাস ছাড়া আর কিছু রেখেছে কি মনে।

শেষ ট্রাম মুছে গেছে, শেষ শব্দ, কলকাতা এখন
জীবনের জগতের প্রকৃতির অন্তিম নিশীথ;
চারিদিকে ঘর বাড়ি পোড়ো-সাঁকো সমাধির ভিড়;
সে অনেক ক্লান্তি ক্ষয় অবিনশ্বর পথে ফিরে
যেন ঢের মহাসাগরের থেকে এসেছে নারীর
পুরোনো হৃদয় নব নিবিড় শরীরে।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #65

 

– জীবনানন্দ দাশ

আমরা মৃত্যুর দিকে জেগে উঠে দেখি
চারিদিকে ছায়া ভরা ভিড়
কুলোর বাতাসে উড়ে ক্ষুদের মতন
পেয়ে যায়- পেয়ে যায়- অণুপরমাণুর শরীর

একটি কি দু’টি মুখ- তাদের ভিতরে
যদিও আমি দেখিনি কোনোদিন- তবুও বাতাসে
প্রথম গার্গীর মতো- জানকীর মতো হয়ে ক্রমে
অবশেষে বনলতা সেন হয়ে আসে।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #66

 

– জীবনানন্দ দাশ

একদিন এই দেহ ঘাস থেকে ধানের আঘ্রাণ থেকে এই বাংলায়
জেগেছিল; বাঙালী নারীর মুখ দেখে রূপ চিনেছিলো দেহ একদিন;
বাংলার পথে পথে হেঁটেছিলো গাঙচিল শালিখের মতন স্বাধীন;
বাংলার জল দিয়ে ধূয়েছিল ঘাসের মতন স্ফুট দেহখানি তার;
একদিন দেখেছিল ধূসর বকের সাথে ঘরে চলে আসে অন্ধকার
বাংলার; কাঁচা কাঠ জ্বলে ওঠে —নীল ধোঁয়া নরম মলিন
বাতাসে ভাসিয়া যায় কুয়াশার করুণ নদীর মতো ক্ষীণ;
ফেনসা ভাতের গন্ধে আম —মুকুলের গন্ধ মিশে যায় যেন বার —বার;

এই সব দেখেছিল রূপ যেই স্বপ্ন আনে—স্বপ্নে যেই রক্তাক্ততা আছে,
শিখেছিল, সেই সব একদিন বাংলার চন্দ্রমালা রূপসীর কাছে;
তারপর বেত বনে,জোনাকি ঝিঝির পথে হিজল আমের অন্ধকারে
ঘুরেছে সে সৌন্দর্যের নীল স্বপ্ন বুকে করে,রূঢ় কোলাহলে গিয়ে তারে –
ঘুমন্ত — কন্যারে সেই —জাগাতে যায়নি আর — হয়তো সে কন্যার হৃদয়
শঙ্খের মতন রুক্ষ, অথবা পদ্মের মতো — ঘুম তবু ভাঙিবার নয়।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #67

 

– জীবনানন্দ দাশ

একদিন কুয়াশার এই মাঠে আমারে পাবে না কেউ খুঁজে আর, জানি;
হৃদয়ের পথ চলা শেষ হল সেই দিন — গিয়েছে যে শান — হিম ঘরে,
অথবা সান্ত্বনা পেতে দেরি হবে কিছু কাল — পৃথিবীর এই মাঠখানি
ভুলিতে বিলম্ব হবে কিছু দিন, এ মাঠের কয়েকটি শালিকের তরে
আশ্চর্য আর বিস্ময়ে আমি চেয়ে রবো কিছু কাল অন্ধকার বিছানার কোলে,
আর সে সোনালি চিল ডানা মেলে দূর থেকে আজো কি মাঠের কুয়াশায়
ভেসে আসে? সেই ন্যাড়া অম্বনে’র পানে আজো চলে যায় সন্ধ্যা সোনার মতো হলে
ধানের নরম শিষে মেঠো ইঁদুরের চোখ নক্ষত্রের দিকে আজো চায়?
সন্ধ্যা হলে? মউমাছি চাক আজো বাঁধে না কি জামের নিবিড় ঘন ডালে,
মউ খাওয়া হয়ে গেলে আজো তারা উড়ে যায় কুয়াশায় সন্ধ্যার বাতাসে –
কতো দূরে যায়, আহা… অথবা হয়তো কেউ চালতার ঝরাপাতা জ্বালে
মধুর চাকের নিচে — মাছিগুলো উড়ে যায়… ঝ’রে পড়ে… ম’রে থাকে ঘাসে –

Bangla Kobita of Jibanananda Das #68

 

– জীবনানন্দ দাশ

একদিন খুঁজেছিনু যারে
বকের পাখার ভিড়ে বাদলের গোধূলি-আঁধারে,
মালতীলতার বনে, কদমের তলে,
নিঝুম ঘুমের ঘাটে-কেয়াফুল, শেফালীর দলে!
-যাহারে খুজিয়াছিনু মাঠে মাঠে শরতের ভোরে
হেমন্তের হিম ঘাসে যাহারে খুজিয়াছিনু ঝরঝর
কামিনীর ব্যথার শিয়রে
যার লাগি ছুটে গেছি নির্দয় মসুদ চীনা তাতারের দলে,
আর্ত কোলাহলে
তুলিয়াছি দিকে দিকে বাধা বিঘ্ন ভয়-
আজ মনে হয়
পৃথিবীর সাঁজদীপে তার হাতে কোনোদিন জ্বলে নাই শিখা@
-শুধু শেষ নিশীথের ছায়া-কুহেলিকা
শুধু মেরু-আকাশের নীহারিকা, তারা
দিয়ে যায় যেন সেই পলাতকা চকিতার সাড়া!
মাঠে ঘাটে কিশোরীর কাঁকনের রাগিণীতে তার সুর
শোনে নাই কেউ
গাগরীর কোলে তার উত্থলিয়া ওঠে নাই আমাদের
গাঙিনীর ঢেউ!
নামে নাই সাবধানী পাড়াগাঁর বাঁকা পথের চুপে চুপে
ঘোমটার ঘুমটুকু চুমি!
মনে হয় শুধু আমি, আর শুধু তুমি
আর ঐ আকাশের পউষ-নীরবতা
রাত্রির নির্জনযাত্রী তারকার কানে কানে কত কাল
কহিয়াছি আধো আধো কথা!
আজ বুঝি ভুলে গেছে প্রিয়া!
পাতাঝরা আঁধারের মুসাফের-হিয়া
একদিন ছিল তব গোধূলির সহচর, ভুলে গেছ তুমি!
এ মাটির ছলনার সুরাপাত্র অনিবার চুমি
আজ মোর বুকে বাজে শুধু খেদ, শুধু অবসাদ!
মাহুয়ার, ধুতুরার স্বাদ
জীবনের পেয়ালায় ফোঁটা ফোঁটা ধরি
দুরন্ত শোণিতে মোর বারবার নিয়েছি যে ভরি!
মসজেদ-সরাই-শরাব
ফুরায় না তৃষা মোর, জুড়ায় না কলেজার তাপ!
দিকে দিকে ভাদরের ভিজা মাঠ-আলেয়ার শিখা!
পদে পদে নাচে ফণা,
পথে পথে কালো যবণিকা!
কাতর ক্রন্দন,-
কামনার কবর-বন্ধন!
কাফনের অভিযান, অঙ্গার সমাধি!
মৃত্যুর সুমেরু সিন্ধু অন্ধকারে বারবার উঠিতেছে কাঁদি!
মর্‌মর্‌ কেঁদে ওঠে ঝরাপাতাভরা ভোররাতের পবন-
আধো আঁধারের দেশে
বারবার আসে ভেসে
কার সুর!-
কোন্‌ সুদুরের তরে হৃদয়ের প্রেতপুরে ডাকিনীর মতো
মোর কেঁদে মরে মন!

Bangla Kobita of Jibanananda Das #69

 

– জীবনানন্দ দাশ

একদিন জলসিড়ি নদীটির পারে এই বাংলার মাঠে
বিশীর্ন বটের নীচে শুয়ে রব- পশমের মত লাল ফল
ঝরিবে বিজন ঘাসে-বাঁকা চাঁদ জেগে রবে- নদীটির জল
বাঙ্গালি মেয়ের মত বিশালাক্ষী মন্দিরের ধূসর কপাটে
আঘাত করিয়া যাবে ভয়ে ভয়ে-তারপর যেই ভাঙ্গা ঘাটে
রূপসীরা আজ আর আসে নাকো,পাট শুধু পচে অবিরল,
সেইখানে কলমির দামে বেধে প্রেতনীর মত কেবল
কাঁদিবে সে সারা রাত-দেখিব কখন কারা এসে আমকাঠে

সাজায়ে রেখেছে চিতাঃ বাংলার শ্রাবনের বিস্মিত আকাশ
চেয়ে রবে; ভিজে পেচা শান্ত স্নিগ্ধ চোখ মেলে কদমের বনে
শোনাবে লক্ষ্মীর গল্প-ভাসানের গান নদী শোনাবে নির্জনে;
চারিদিকে বাংলার ধানী শাড়ি-শাদা শাখা-বাংলার ঘাস
আকন্দ বাসকলতা ঘেরা এক নীল মঠ-আপনার মনে
ভাঙ্গিতেছে ধীরে ধীরে-চারিদিকে জীবনের এই সব আশ্চর্য উচ্ছ্বাস-

Bangla Kobita of Jibanananda Das #70

 

– জীবনানন্দ দাশ

একদিন পৃথিবীর পথে আমি ফেলিয়াছি, আমার শরীর
নরম ঘাসের পথে হাঁটিয়াছে; বসিয়াছে ঘাসে
দেখিয়াছে নক্ষত্রের জোনাকিপোকার মতো কৌতুকের অমেয় আকাশে
খেলা করে; নদীর জলের গন্ধে ভরে যায় ভিজে স্নিগ্ধ তীর
অন্ধকারে; পথে পথে শব্দ পাই কাহাদের নরম শাড়ির,
স্লান চুল দেখা যায়; সান্ত্বনার কথা নিয়ে কারা আসে –
ধূসর কড়ির মতো হাতগুলো — নগ্ন হাত সন্ধ্যার বাতাসে
দেখা যায়: হলুদ ঘাসের কাছে মরা হিম প্রজাপতিটির

সুন্দর করুণ পাখা পড়ে আছে — দেখি আমি; — চুপে থেমে থাকি;
আকাশে কমলা রঙ ফুটে ওঠে সন্ধ্যায় — কাকগুলো নীল মনে হয়;
অনেক লোকের ভিড়ে ডুবে যাই — কথা কই — হাতে হাত রাখি;
করুণ বিষন্ন চুলে কার যেন কোথাকার গভীর বিষ্ময়
লুকায়ে রয়েছে বুঝি… নক্ষত্রের নিচে আমি ঘুমাই একাকী;
পেঁচার ধূসর ডানা সারারাত জোনাকির সাথে কথা কয়।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #71

 

– জীবনানন্দ দাশ

একদিন যদি আমি কোনো দূর বিদেশের সমুদ্রের জলে
ফেনার মতন ভাসি শীত রাতে — আসি নাকো তোমাদের মাঝে
ফিরে আর — লিচুর পাতার ‘পরে বহুদিন সাঁঝে
যেই পথে আসা-যাওয়া করিয়াছি, — একদিন নক্ষত্রের তলে
কয়েকটা নাটাফল তুলে নিয়ে আনারসী শাড়ির আচঁলে
ফিঙার মতন তুমি লঘু চোখে চলে যাও জীবনের কাজে,
এই শুধু… বেজির পায়ের শব্দ পাতার উপড়ে যদি বাজে
সারারাত… ডানার অস্পষ্ট ছায়া বাদুড়ের ক্লান্ত হয়ে চলে

যদি সে পাতার ‘পরে, — শেষ রাতে পৃথিবীর অন্ধকারে শীতে
তোমার ক্ষীরের মতো মৃদু দেহ — ধূসর চিবুক, বাম হাত
চালতা গাছের পাশে খোড়ো ঘরে স্নিগ্ধ হয়ে ঘুমায় নিভৃতে,
তবুও তোমার ঘুম ভেঙে যাবে একদিন চুপে অকস্মাৎ
তুমি যে কড়ির মালা দিয়েছিলে — সে হার ফিরাযে দিয়ে দিতে
যখন কে এক ছায়া এসেছিল… দরজায় করেনি আঘাত।

কাব্যগ্রন্থ – রুপসী বাংলা

Bangla Kobita of Jibanananda Das #72

 

– জীবনানন্দ দাশ

এখানে আকাশ নীল- নীলাভ আকাশ জুড়ে সজিনার ফুল
ফুটে থাকে হিম শাদা- রং তার আশ্বিনের আলোর মতন;
আকন্দফুলের কালো ভীমরুল এইখানে করে গুঞ্জরণ
রৌদ্রের দুপুর ভ’রে;- বারবার রোদ তার সুচিক্বণ চুল
কাঁঠাল জামের বুকে নিঙড়ায়ে;- দহে বিলে চঞ্চল আঙুল
বুলায়ে বুলায়ে ফেরে এইখানে জাম লিচু কাঁঠালের বন,
ধনপতি, শ্রীমন্তের, বেহুলার, লহনার ছুঁয়েছে চরণ;
মেঠো পথে মিশে আছে কাক আর কোকিলের শরীরের ধূল,

কবেকার কোকিলের জানো কি তা? যখন মুকুন্দরাম, হায়,
লিখিতেছিলেন ব’সে দু’পহরে সাধের সে চন্ডিকামঙ্গল,
কোকিলের ডাক শুনে লেখা তাঁর বাধা পায়- থেমে থেমে যায়;-
অথবা বেহুলা একা যখন চলেছে ভেঙে গাঙুড়ের জল
সন্ধ্যার অন্ধকারে, ধানক্ষেতে, আমবনে, অস্পষ্ট শাখায়
কোকিলের ডাক শুনে চোখে তার ফুটেছিল কুয়াশা কেবল।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #73

 

– জীবনানন্দ দাশ

এখানে ঘুঘুর ডাকে অপরাহ্নে শান্তি আসে মানুষের মনে;
এখানে সবুজ শাখা আঁকাবাঁকা হলুদ পাখিরে রাখে ঢেকে;
জামের আড়ালে সেই বউকথাকওটিরে যদি ফেল দেখে
একবার — একবার দু’পহর অপরাহ্নে যদি এই ঘুঘুর গুঞ্জনে
ধরা দাও — তাহলে অনন্তকাল থাকিতে যে হবে এই বনে;
মৌরির গন্ধমাখা ঘাসের শরীরে ক্লান্ত দেহটিরে রেখে
আশ্বিনের ক্ষেতঝরা কচি কচি শ্যামা পোকাদের কাছে ডেকে
রব আমি চকোরীর সাথে যেন চকোরের মতন মিলনে;

উঠানে কে রূপবতী খেলা করে — ছাড়ায়ে দিতেছে বুঝি ধান
শালিখের; ঘাস থেকে ঘাসে ঘাসে খুঁটে খুঁটে খেতেছে সে তাই;
হলুদ নরম পায়ে খয়েরি শালিখগুলো ডরিছে উঠান;
চেয়ে দ্যাখো সুন্দরীরে : গোরোচনা রূপ নিয়ে এসেছে কি রাই!
নীলনদে — গাঢ় রৌদ্রে — কবে আমি দেখিয়াছি — করেছিল স্নান

Bangla Kobita of Jibanananda Das #74

 

– জীবনানন্দ দাশ

এখানে প্রাণের স্রোত আসে যায় — সন্ধ্যায় ঘুমায় নীরবে
মাটির ভিটের ‘পরে — লেগে থাকে অন্ধকারে ধুলোর আঘ্রাণ
তাহাদের চোখে — মুখে; — কদমের ডালে পেঁচা কথা কবে —
কাঁঠালের ডাল থেকে হিজলের ডালে গিয়ে করিবে আহ্বান
সাপমাসী পোকাটিরে… সেই দিন আঁধারে উঠিবে নড়ে ধান
ইঁদুরের ঠোঁটে — চোখে; বাদুড়ের কালো ডানা করমচা পল্লবে

কুয়াশারে নিঙড়ায়ে উড়ে যাবে আরো দূর নীল কুয়াশায়,
কেউ তাহা দেখিবে না; — সেদিন এ পাড়াগাঁর পথের বিষ্ময়
দেখিতে পাবো না আর — ঘুমায়ে রহিবে সব; যেমন ঘুমায়
আজ রাতে মৃত যারা; যেমন হতেছে ঘুমে ক্ষয়
অশ্বত্থ ঝাউয়ের পাতা চুপে — চুপে আজ রাতে, হায়;
যেমন ঘুমায় মৃতা, — তাহার বুকের শাড়ি যেমন ঘুমায়।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #75

 

– জীবনানন্দ দাশ

এ-সব কবিতা আমি যখন লিখেছি বসে নিজ মনে একা;
চালতার পাতা থেকে টুপ — টুপ জ্যোৎস্নায় ঝরছে শিশির;
কুয়াশায় সি’র হয়ে ছিল স্নান ধানসিড়ি নদীটির তীরে;
বাদুড় আধাঁর ডানা মেলে হিম জ্যোৎস্নায় কাটিয়াছে রেখা
আকাঙ্খার; নিভু দীপ আগলায়ে মনোরমা দিয়ে গেছে দেখা
সঙ্গে তার কবেকার মৌমাছির…. কিশোরীর ভিড়
আমের বউল দিল শীতরাতে; — আনিল আতার হিম ক্ষীর;
মলিন আলোয় আমি তাহাদের দেখিলাম, — এ কবিতা লেখা

তাহাদের ম্লান মনে কবে, তাহাদের কড়ির মতন
ধূসর হাতের রূপ মনে করে; তাহাদের হৃদয়ের তরে।
সে কত শতাব্দী আগে তাহাদের করুণ শঙ্খের মতো স্তন
তাহাদের হলুদ শাড়ি — ক্ষীর দেহ — তাহাদের অপরূপ মন
চলে গেছে পৃথিবীর সব চেয়ে শান্ত হিম সান্ত্বনার ঘরে :
আমার বিষন্ন স্বপ্নে থেকে থেকে তাহাদের ঘুম ভেঙে পড়ে।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #76

 

– জীবনানন্দ দাশ

-ওগো দরদিয়া
তোমারে ভুলিবে সবে, যাবে সবে তোমারে ত্যজিয়া;
ধরণীর পসরায় তোমারে পাবে না কেহ দিনান্তেও খুঁজে
কে জানে রহিবে কোথা নিশিভারে নেশাখোর আঁখি তব বুজে!
-হয়তো সিন্ধুর পারে শ্বেতশঙ্খ ঝিনুকের পাশে
তোমার কঙ্কালখানা শুয়ে রবে নিদ্রাহারা উর্মির নিশ্বাসে!
চেয়ে রবে নিষ্পলক অতি দূরে লহরীর পানে,
গীতিহারা প্রাণ তবে হয়তো বা তৃপ্তি পাবে তরঙ্গের গানে!
হয়তো বনচ্ছায়া লতাগুল্ম পল্লবের তলে
ঘুমায়ে রহিবে তুমি নীল শষ্পে শিশিরের দলে;
হয়তো বা প্রান্তরের পারে তুমি রবে শুয়ে প্রতিধ্বনিহারা-
তোমারে হেরিবে শুধু হিমানীর শীর্ণাকাশ-নীহারিকা-তারা,
তোমারে চিনিবে শুধু প্রেম জোছনা-বধির জোনাকি!
তোমারে চিনিবে শুধু আঁধারের আলেয়ার আঁখি
তোমারে চিনিবে শুধু আকাশের কালো মেঘ-মৌন-আলোহারা,
তোমারে চিনিয়া নেবে তমিস্রার তরঙ্গের ধারা!
কিংবা কেহ চিনিবে না, হয়তো বা জানিবে না কেহ
কোথায় লুটায়ে আছে হেমন্তের দিবাশেষে ঘুমন্তের দেহ!
-হয়েছিল পরিচয় ধরণীর পান’শালে যাহাদের সনে,
তোমার বিষাদ-হর্ষ গেঁথেছিলে একদিন যাহাদের মনে,
যাহাদের বাতায়নে একদিন গিয়েছিলে পথিক-অতিথি
তোমারে ভুলিবে তারা- ভুলে যাবে সব কথা, সবটুকু স্মৃতি!
নাম তব মুছে যাবে মুসাফের-অঙ্গারের পান্ডুলিপিখানি
নোনা ধরা দেয়ালের বুক থেকে খসে যাবে কখন না জানি!
তোমার পানের পাত্রে নিঃশেষে শুকায়ে যাবে শেষের তলানি,
দন্ড দুই মাছিগুলো করে যাবে মিছে কানাকানি!
তারপর উড়ে যাবে দূরে দূরে জীবনের সুরার তল্লাসে
মৃত এক অলি শুধু পড়ে রবে মাতালের বিছানার পাশে!
পেয়ালা উপুড় করে হয়তো বা রেখে যাবে কোনো একজন,
কোথা গেছে ইয়োসোফ্‌ জানে না সে, জানে না সে গিয়েছে কখন।
জানে না যে, অজানা সে, আরবার দাবি নিয়ে আসিবে না ফিরে-
জানে না রে চাপা পড়ে গেছে সে যে কবেকার কোথাকার ভিড়ে!
জানিতে চাহে না কিছু-ঘাড় নিচু করে কে বা রাখে আঁখি বুজে
অতীত স্মৃতির ধ্যানে, অন্ধকার গৃহকোণে একখানা শূন্য পাত্র খুঁজে!
যৌবনের কোন্‌ এক নিশীথে সে কবে
তুমি যে আসিয়াছিলে বনরানি। জীবনের বাসন্তী-উৎসবে
তুমি যে ঢালিয়াছিলে ফাগরাগ-আপনার হাতে মোর সুরাপাত্রখানি
তুমি যে ভরিয়াছিলে-জুড়ায়েছে আজ তার ঝাঁঝ, গেছে ফুরায়ে তলানি।
তবু তুমি আসিলে না, বারেকের তরে দেখা দিলে নাকো হায়!
চুপে চুপে কবে আমি বসুধার বুক থেকে নিয়েছি বিদায়-
তুমি তাহা জানিলে না-চলে গেছে মুসাফের
কবে ফের দেখা হবে আহা
কে বা জানে! কবরের পরে তার পাতা ঝরে, হাওয়া কাঁদে হা হা!

Bangla Kobita of Jibanananda Das #77

 

– জীবনানন্দ দাশ

কখন সোনার রোদ নিভে গেছে — অবিরল শুপুরির সারি
আঁধারে যেতেছে ডুবে — প্রান্তরের পার থেকে গরম বাতাস
ক্ষুধিত চিলের মতো চৈত্রের এ অন্ধকার ফেলিতেছে শ্বাস;
কোন চৈত্রে চলে গেছে সেই মেয়ে — আসিবে না করে গেছে আড়ি :
ক্ষীরুই গাছের পাশে একাকী দাঁড়ায়ে আজ বলিতে কি পারি
কোথাও সে নাই এই পৃথিবীতে তাহার শরীর থেকে শ্বাস
ঝরে গেছে বলে তারে ভুলে গেছে নক্ষত্রের অসীম আকাশ,
কোথাও সে নাই আর — পাব নাকো তারে কোনো পৃথিবী নিঙাড়ি?

এই মাঠে — এই ঘাসে ফল্‌সা এ-ক্ষীরুয়ে যে গন্ধ লেগে আছে
আজও তার যখন তুলিতে যাই ঢেঁকিশাক — দুপুরের রোদে
সর্ষের ক্ষেতের দিকে চেয়ে থাকি — অঘ্রাণে যে ধান ঝরিয়াছে
তাহার দু-এক গুচ্ছ তুলে নিই, চেয়ে দেখি নির্জন আমোদে
পৃথিবীর রাঙা রোদে চড়িতেছে আকাঙ্ক্ষায় চিনিচাঁপা গাছে —
জানি সে আমার কাছে আছে আজো — আজো সে আমার কাছে কাছে।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #78

 

– জীবনানন্দ দাশ

কত দিন ঘাসে আর মাঠে
আমার উৎসাহে প্রাণ কাটে
খড় খুঁটি—অশ্বথ্থের শুকনো পাতা চুপে উল্টাই
দু’একটা পোকা যদি পাই
আমারে চেনো না নাকি: আমি যে চড়াই।
কতদিন তোমাদের ভোরের উঠানে
দু’-একটা খই আর মুড়কির ঘ্রাণে
উড়ে আসি চুপে
দেখি কোনো রূপে
চাল ডাল ছোলা ক্ষুদ খুঁজে পাই কিনা
ঝুরঝুর ক’রে ফুল ফুরায় সজিনা
থুপ্‌ থুপ্‌ থুপ্‌ থুপ্‌—একাকী লাফাই
ঘুম নাই—চোখে ক্লান্তি নাই –
থুপ্ থুপ্ থুপীর মতন
দেখিনি কি করি আহরণ
চিনি মিঠাইয়ের গুঁড়ি—মিশ্রির কণা
ছাতু আটা…কলসীর পাশে বুঝি নাচিছে খঞ্জনা!
আকাশে কতটা রোদ
তোমাদের এত কি আমোদ।
ছোট ছোট ছেলে আর মেয়েদের দল
উঠানে কিসের এত ভিড়
ছোট ছোট ছেলেমেয়ে—তোমাদের নরম শরীর
হাতে তবু পাটকেল—ঢিল ?
আমারে তাড়াও কেন? আমি বুঝি দাঁড়কাক চিল!
চীনেবাদামের খোসা শূন্য ঠোঙা এই শুধু চাই
আমি যে চড়াই।
যাই উড়ে যাই
জানালার পাশে
বোলতার চাক খুব বড়ো হয়ে আসে
হলদে বোলতা পাখি, ভাই
এসেছি চড়াই
এনেছি একটা কুটো আর এক খড়
এই নিয়ে ঘরের ভিতর
আমিও বানাবো এক ঘর
কি বলো তোমরা
ভাটের বনের থেকে এলে কি ভোমরা
মধু পেলে খুঁজে
সারাদিন একটুও ঘুমাইনি,—চোখ আসে বুজে
মাকড়শা, অন্ধকারে আছো তুমি মিশে
এখানে কার্ণিশে
আমারে ঘুমাতে দেবে ভাই
আমি যে চড়াই—
থাক ঘুম—যাই উড়ে যাই
আমি যে চড়াই।
ঘুম নাই—চোখে ক্লান্তি নাই
কাঠমল্লিকায়
কাঁঠালী শাখায়
করবীর বনে
হিজলের সনে
বেগুনের ভিড়ে
ঘাসের শরীরে
যাই—যাই—যাই
চাই—চাই—চাই
গাই—গাই—গাই
ঘুম নাই—নাই
আমি যে চড়াই।
তবু একদিন
যখন হলুদ তৃণ
ভ’রে আছে মাঠে
পাতায় শুকনো ডাঁটে
ভাসিছে কুয়াশা
দেখিলাম খানিকটা রোম
মাঠের কিনারে ঘাসে—নির্জন নরম
শিশিরে রয়েছে ডুবে—চোখ বুজে আছে
কেমন সহিষ্ণু ছায়া মুখের উপরে পড়িয়াছে
বহুক্ষণ আমারে থাকিতে বলে এইখানে
এই স্থির নীরবতা, এই করুণতা
মৃত্যুরে নিঃশেষ ক’রে দেয় নাকি: নক্ষত্রের সাথে কয় নাকি কথা ?
এর চেয়ে বেশি রূপ, বেশি রেখা, বেশি করুণতা
আর কে দেখাতে পারে
আকাশের নীল বুকে—অথবা এ ধুলোর আঁধারে।।

কাব্যগ্রন্থ – রুপসী বাংলা

Bangla Kobita of Jibanananda Das #79

 

– জীবনানন্দ দাশ

কত ভোরে- দু’-পহরে – সন্ধ্যায় দেখি নীল শুপুরির বন
বাতাসে কাঁপিছে ধীরে;- খাঁচার শুকের মতো গাহিতেছে গান
কোন এক রাজকন্যা- পরনে ঘাসের শাড়ি- কালো চুলে ধান
বাংলার শালিধান- আঙিনায় ইহাদের করেছে বরণ,
হৃদয়ে জলের গন্ধ কন্যার- ঘুম নাই, নাইকো মরণ
তার আর কোনোদিন- পালঙ্কে সে শোয় নাকো, হয় নাকো স্লান,
লক্ষ্ণীপেঁচা শ্যামা আর শালিখের গানে তার জাগিতেছে প্রাণ-
সারাদিন- সারারাত বুকে ক’রে আছে তারে শুপুরির বন;

সকালে কাকের ডাকে আলো আসে, চেয়ে দেখি কালো দাঁড়কাক
সবুজ জঙ্গল ছেয়ে শুপুরির- শ্রীমন্তও দেখেছে এমন :
যখন ময়ূরপঙ্খী ভোরের সিন্ধুর মেঘে হয়েছে অবাক,
সুদূর প্রবাস থেকে ফিরে এসে বাংলার শুপুরির বন
দেখিয়াছে- অকস্মাৎ গাঢ় নীল : করুণ কাকের ক্লান্ত ডাক
শুনিয়াছে- সে কত শতাব্দী আগে ডেকেছিল তাহারা যখন।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #80

 

– জীবনানন্দ দাশ

কতদিন তুমি আর আমি এসে এইখানে বসিয়াছি ঘরের ভিতর
খড়ের চালের নিচে, অন্ধকারে; — সন্ধ্যার ধূসর সজল
মৃদু হাত খেলিতেছে হিজল জামের ডালে — বাদুড় কেবল
করিতেছে আসা-যাওয়া আকাশের মৃদু পথে — ছিন্ন ভিজে খড়
বুকে নিয়ে সনকার মতো যেন পড়ে আছে নরম প্রান্তর;
বাঁকা চাঁদ চেয়ে আছে — কুয়াশায় গা ভাসায়ে দেয় অবিরল
নিঃশব্দ গুবরে পোকা — সাপমাসী — ধানী শ্যামাপোকাদের দল;
দিকে দিকে চালধোয়া গন্ধ মৃদু — ধূসর শাড়ির ক্ষীণ স্বর

শোনা যায় — মানুষের হৃদয়ের পুরোনো নীরব
বেদনার গন্ধ ভাসে — খড়ের চালের নিচে তুমি আর আমি
কতদিন মলিন আলোয় বসে দেখেছি বুঝেছি এই সব;
সময়ের হাত থেকে ছুটি পেয়ে স্বপনের গোধূলিতে নামি
খড়ের চালের নিচে মুখোমুখি বসে থেকে তুমি আর আমি
ধূসর আলোয় বসে কতদিন দেখেছি বুঝেছি এইসব।

কাব্যগ্রন্থ – রুপসী বাংলা

Bangla Kobita of Jibanananda Das #81

 

– জীবনানন্দ দাশ

কতদিন সন্ধ্যার অন্ধকারে মিলিয়াছি আমরা দুজনে;
আকাশ প্রদীপ জ্বেলে তখন কাহারা যেন কার্তিকের মাস
সাজায়েছে, — মাঠ থেকে গাজন গানের স্নান ধোঁয়াটে উচ্ছ্বাস
ভেসে আসে; ডানা তুলে সাপমাসী উড়ে যায় আপনার মনে
আকন্দ বনের দিকে; একদল দাঁড়কাক ম্লান গুঞ্জরণে
নাটার মতন রাঙা মেঘ নিঙড়ায়ে নিয়ে সন্ধ্যার আকাশ
দু’মুহূর্ত ভরে রাখে — তারপর মৌরির গন্ধমাখা ঘাস
পড়ে থাক: লক্ষ্মীপেঁচা ডাল থেকে ডালে শুধু উড়ে চলে বনে

আধো ফোটা জ্যোৎস্নায়; তখন ঘাসের পাশে কতদিন তুমি
হলুদ শাড়িটি বুকে অন্ধকারে ফিঙ্গার পাখনার মতো
বসেছ আমার কাছে এইখানে — আসিয়াছে শটিবন চুমি
গভীর আঁধার আরো — দেখিয়াছি বাদুড়ের মৃদু অবিরত
আসা — যাওয়া আমরা দুজনে বসে বলিয়াছি ছেঁড়াফাঁড়া কত
মাঠ ও চাঁদের কথা: ম্লান চোখে একদিন সব শুনেছ তো।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #82

 

– জীবনানন্দ দাশ

ভ্রমরীর মতো চুপে সৃজনের ছায়াধূপে ঘুরে মরে মন
আমি নিদালির আঁখি, নেশাখোর চোখের স্বপনে!
নিরালায় সুর সাথি, বাঁধি মোর মানসীর বেণী,
মানুষ দেখে নি মোরে কোনোদিন, আমারে চেনে নি!
কোনো ভিড় কোনোদিন দাঁড়ায় নি মোর চারি পাশে-
শুধায় নি কেহ কভু-আসে কি রে,- সে কি আসে-আসে।
আসে নি সে ভরাহাটে-খয়াঘাটে-পৃথিবীর পসরায় মাঝে
পাটনী দেখে নি তারে কোনোদিন-মাঝি তারে ডাকে নিকো সাঁঝে।
পরাপার করে নি সে মণিরত্ন-বেসাতির সিন্ধুর সীমানা,-
চেনা-চেনা মুখ সবই-সে যে সুদুর-অজানা!

করবীকুঁড়ির পানে চোখ তার সারাদিন চেয়ে আছে চুপে,
রূপসাগরের মাঝে কোন্‌ দূর গোধূলির সে যে আছে ডুবে!
সে যেন ঘাসের বুকে, ঝিলমিল শিশিরের জলে;
খুঁজে তারে পাওয়া যাবে এলোমেলো বেদিয়ার দলে,
বাবলার ফুলে ফুলে ওড়ে তার প্রজাপতি-পাখা,
ননীর আঙুলে তার কেঁপে ওঠে কচি নোনাশাখা!

হেমন্তের হিম মাঠে, আকাশের আবছায়া ফুঁড়ে
বকবধুটির মতো কুয়াশায় শাদা ডানা যায় তার উড়ে!
হয়তো শুনেছ তারে-তার সুর, দুপুর আকাশে
ঝরাপাতাভরা মরা দরিয়ার পাশে
বেজেছে ঘুঘুর মুখে, জল-ডাহুকীর বুকে পউষনিশায়
হলুদ পাতার ভিড়ে শিরশিরে পুবালি হাওয়ায়!

হয়তো দেখেছ তারে ভুতুড়ে দীপের চোখে মাঝরাতে দেয়ালের পরে
নিভে যাওয়া প্রদীপের ধূসর ধোঁয়ায় তার সুর যেন ঝরে!
শুক্লা একাদশী রাতে বিধবার বিছানায় সেই জোছনা ভাসে
তারই বুকে চুপে চুপে কবি আসে সুর তার আসে।
উস্‌খুস্‌ এলো চুলে ভরে আছে কিশোরীর নগ্ন মুখখানি,-
তারই পাশে সুর ভাসে অলখিতে উড়ে যায় কবির উড়ানি!

বালুঘড়িটির বুকে ঝিরি ঝিরি ঝিরি ঝিরি গান যবে বাজে
রাতবিরেতের মাঠে হাঁটে সে যে আলসে, অকাজে!
ঘুমকুমারীর মুখে চুমো খায় যখন আকাশ
যখন ঘুমায়ে থাকে টুনটুনি, মধুমাছি,ঘাস
হাওয়ার কাতর শ্বাস থেমে যায় আমলকী সাড়ে,
বাঁকা চাঁদ ডুবে যায় বাদলের মেঘের আঁধারে,
তেঁতুলের শাখে শাখে বাদুড়ের কালো ডানা ভাসে,
মনের হরিণী তার ঘুরে মরে হাহাকারে বনের বাতাসে!

জোনাকির মতো সে যে দূরে দূরে যায় উড়ে উড়ে-
আপনার মুখ দেখে ফেরে সে যে নদীর মুকুরে-
জ্বলে ওঠে আলোয়ার মতো তার লাল আঁখিখানি।
আঁধারে ভাসায় খেয়া সে কোন্‌ পাষাণী!

জানে না তো কী যে চায়- কবে হায় কী গেছে হারায়ে।
চোখ বুজে খোঁজে একা-হাতড়ায় আঙুল বাড়ায়ে
কারে আহা।-কাঁদে হা হা পুরের বাতাস,
শ্মশানশবের বুকে জাগে এক পিপাসার শ্বাস!
তারই লাগি মুখ তোলে কোন মৃতা-হিম চিতা জ্বেলে দেয় শিখা,
তার মাঝে যায় দহি বিরহীর ছায়াপুত্তলিকা!

Bangla Kobita of Jibanananda Das #83

 

– জীবনানন্দ দাশ

আমাদের হাড়ে এক নির্ধূম আনন্দ আছে জেনে
পঙ্কিল সময়স্রোতে চলিতেছে ভেসে;
তা না হ’লে সকলি হারায়ে যেতো ক্ষমাহীন রক্তের- নিরুদ্দেশে।
হে আকাশ, একদিন ছিলে তুমি প্রভাতের তটিনীর;
তারপর হ’য়ে গেছ দূর মেরুনিশীথের স্তব্ধ সমুদ্রের।
ভোরবেলা পাখিদের গানে তাই ভ্রান্তি নেই,
নেই কোনো নিস্ফলতা আলোকের পতঙ্গের প্রাণে।
বানরী ছাগল নিয়ে যে- ভিক্ষুক প্রতারিত রাজপথে ফেরে-
আঁজলায় স্থির শান্ত সলিলের অন্ধকারে-
খুঁজে পায় জিজ্ঞাসার মানে।
চামচিকা যার হয় নিরালোকে ওপারের বায়ুসন্তরণে;
প্রান্তরের অমরতা জেগে ওঠে একরাশ প্রাদেশিক ঘাসের উন্মেষে;
জীর্ণতম সমাধির ভাঙ্গা ইঁট অসম্ভব পরগাছা ঘেঁষে
সবুজ সোনালিচোখ ঝিঁঝিঁ-দম্পতির ক্ষুধা করে আবিষ্কার
একটি বাদুড় দূর স্বোপার্জিত জ্যোৎস্নার মনীষায় ডেকে নিয়ে যায়
যাহাদের যতদূর চক্রবাল আছে লভিবার।
হে আকাশ, হে আকাশ,
একদিন ছিলে তুনি মেরুনিশীথের স্তব্ধ সমুদ্রের মতো;
তারপর হ’য়ে গেছ প্রভাতের নদীটির মতো প্রতিভার!

কাব্যগ্রন্থ – সাতটি তারার তিমির

Bangla Kobita of Jibanananda Das #84

 

– জীবনানন্দ দাশ

একবার যখন দেহ থেকে বার হয়ে যাব
আবার কি ফিরে আসব না আমি পৃথিবীতে?
আবার যেন ফিরে আসি
কোনো এক শীতের রাতে
একটা হিম কমলালেবুর করুণ মাংস নিয়ে
কোমো এক পরিচিত মুমূর্ষুর বিছানার কিনারে।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #85

 

– জীবনানন্দ দাশ

কেউ যাহা জানে নাই কোনো এক বাণী –
আমি বহে আনি;
একদিন শুনেছ যে সুর –
ফুরায়েছে পুরনো তা — কোনো এক নতুন কিছুর
আছে প্রয়োজন,
তাই আমি আসিয়াছি, আমার মতন
আর নাই কেউ!
সৃষ্টির সিন্ধুর বুকে আমি এক ঢেউ
আজিকার: শেষ মুহুর্তের
আমি এক — সকলের পায়ের শব্দের
সুর গেছে অন্ধকারে থেমে;
তারপর আসিয়াছি নেমে
আমি;
আমার পায়ের শব্দ শোনো –
নতুন এ, আর সব হারানো — পুরনো।
উৎসবের কথা আমি কহি নাকো,
পড়ি নাকো দুর্দশার গান,
কে কবির প্রাণ
উৎসাহে উঠেছে শুধু ভরে –
সেই কবি — সেও যাবে সরে;
যে কবি পেয়েছে শুধু যন্ত্রণার বিষ
শুধু জেনেছে বিষাদ,
মাটির আর রক্তের কর্কশ স্বাদ,
যে বুঝেছে, প্রলাপের ঘোরে
যে বকেছে — সেও যাবে সরে;
একে একে সবই
ডুবে যাবে — উৎসবের কবি,
তবু বলিতে কি পারো
যাতনা পাবে না কেউ আরো?
যেইদিন তুমি যাবে চ’লে
পৃথিবী গাবে কি গান তোমার বইয়ের পাতা খুলে?
কিংবা যদি গায় — পৃথিবী যাবে কি তবু ভুলে
একদিন যেই ব্যথা ছিল সত্য তার?
আনন্দের আবর্তনে আজিকে আবার
সেদিনের পুরানো আঘাত
ভুলিবে সে? ব্যথা যারা সয়ে গেছে রাত্রি — দিন
তাহাদের আর্ত ডান হাত
ঘুম ভেঙে জানাবে নিষেধ;
সব ক্লেশ আনন্দের ভেদ
ভুল মনে হবে;
সৃষ্টির বুকের পরে ব্যথা লেগে রবে,
শয়তানের সুন্দর কপালে
পাপের ছাপের মতো সেইদিনও! –
মাঝরাতে মোম যারা জ্বালে,
রোগা পায়ে করে পায়চারি,
দেয়ালে যাদের ছায়া পড়ে সারি সারি
সৃষ্টির দেয়ালে –
আহ্লাদ কি পায় নাই তারা কোনোকালে?
যেই উড়ো উৎসাহের উৎসবের রব
ভেসে আসে — তাই শুনে জাগে নি উৎসব?
তবে কেন বিহ্বলের গান
গায় তারা! — বলে কেন, আমাদের প্রাণ
পথের আহত
মাছিদের মতো!

উৎসবের কথা আমি কহি নাকো,
পড়ি নাকো ব্যর্থতার গান;
শুনি শুধু সৃষ্টির আহ্বান –
তাই আসি,
নানা কাজ তার
আমরা মিটায়ে যাই –
জাগিবার কাল আছে — দরকার আছে ঘুমাবার;
এই সচ্ছলতা
আমাদের;আকাশ কহিছে কোন্‌ কথা
নক্ষত্রের কানে?
আনন্দের? দুর্দশার? পড়ি নাকো। সৃষ্টির আহ্বানে
আসিয়াছি।
সময়সিন্ধুর মতো:
তুমিও আমার মতো সমুদ্রের পানে, জানি, রয়েছ তাকায়ে,
ঢেউয়ের হুঁচোট লাগে গায়ে
ঘুম ভেঙে যায় বার বার
তোমার — আমার!
জানি না তো কোন্‌ কথা কও তুমি ফেনার কাপড়ে বুক ঢেকে,
ওপারের থেকে;
সমুদ্রের কানে
কোন্‌ কথা কই আমি এই পারে — সে কি কিছু জানে?
আমিও তোমার মতো রাতের সিন্ধুর দিকে রয়েছি তাকায়ে,
ঢেউয়ের হোঁচট লাগে গায়ে
ঘুম ভেঙে যায় বার বার
তোমার আমার!

কোথাও রয়েছ, জানি, তোমারে তবুও আমি ফেলেছি হারায়ে;
পথ চলি — ঢেউ ভেজে পায়ে;
রাতের বাতাস ভেসে আসে,
আকাশে আকাশে
নক্ষত্রের পরে
এই হাওয়া যেন হা হা করে!
হু হু করে ওঠে অন্ধকার!
কোন্‌ রাত্রি — আঁধারের পার
আজ সে খুঁজিছে!
কত রাত ঝরে গেছে — নিচে — তারও নিচে
কোন্‌ রাত — কোন্‌ অন্ধকার
একবার এসেছিল — আসিবে না আর।
তুমি এই রাতের বাতাস,
বাতাসের সিন্ধু — ঢেউ,
তোমার মতন কেউ
নাই আর!
অন্ধকার — নিঃসাড়তার
মাঝখানে
তুমি আনো প্রাণে
সমুদ্রের ভাষা
রুধিবে পিপাসা
যেতেছে জাগায়ে
ছেঁড়া দেহে — ব্যথিত মনের ঘায়ে
ঝরিতেছ জলের মতন –
রাতের বাতাস তুমি — বাতাসে সিন্ধু — ঢেউ,
তোমার মতন কেউ
নাই আর!

গান গায়, যেখানে সাগর তার জলের উল্লাসে,
সমুদ্রের হাওয়া ভেসে আসে,
যেখানে সমস্ত রাত ভ’রে,
নক্ষত্রের আলো পড়ে ঝ’রে
যেই খানে,
পৃথিবীর কানে
শস্য গায় গান,
সোনার মতন ধান
ফ’লে ওঠে যেইখানে –
একদিন — হয়তো — কে জানে
তুমি আর আমি
ঠান্ডা ফেনা ঝিনুকের মতো চুপে থামি
সেইখানে বর পড়ে!
যেখানে সমস্ত রাত্রি রক্ষত্রের আলো পড়ে ঝ’রে,
সমুদ্রের হাওয়া ভেসে আসে,
গান গায় সিন্ধু তার জলের উল্লাসে।

ঘুমাতে চাও কি তুমি?
অন্ধকারে ঘুমাতে কি চাই? –
ঢেউয়ের গানের শব্দ
সেখানে ফেনার গন্ধ নাই?
কেহ নাই — আঙুলের হাতের পরশ
সেইখানে নাই আর –
রূপ যেই স্বপ্ন আনে, স্বপ্নে বুকে জাগায় যে রস
সেইখানে নাই তাহা কিছু;
ঢেউয়ের গানের শব্দ
যেখানে ফেনার গন্ধ নাই –
ঘুমাতে চাও কি তুমি?
সেই অন্ধকারে আমি ঘুমাতে কি চাই!
তোমারে পাব কি আমি কোনোদিন? — নক্ষত্রের তলে
অনেক চলার পথ — সমুদ্রের জলে
গানের অনেক সুর — গানের অনেক সুর — বাজে –
ফুরাবে এ — সব, তবু…. তুমি যেই কাজে
ব্যস্ত আজ — ফুরাবে না জানি;
একদিন তবু তুমি তোমার আঁচলকানি
টেনে লবে; যেটুকু করার ছিল সেইদিন হয়ে গেছে শেষ,
আমার এ সমুদ্রের দেশ
হয়তো হয়েছে স্তব্ধ সেইদিন, — আমার এ নক্ষেত্রের রাত
হয়তো সরিয়া গেছে — তবু তুমি আসিবে হঠাৎ
গানের অনেক সুর — গানের অনেক সুর সমুদ্রের জলে,
অনেক চলার পথ নক্ষত্রের তলে!

আমার নিকট থেকে
তোমারে নিয়েছে কেটে কখন সময়!
চাঁদ জেগে রয়
তারা ভরা আকাশের তলে,
জীবন সবুজ হয়ে ফলে,
শিশিরের শব্দে গান গায়
অন্ধকার, আবেগ জানায়
রাতের বাতাস!
মাটি ধুলো কাজ করে — মাঠে মাঠে ঘাস
নিবিড় — গভীর হয়ে ফলে!
তারা ভরা আকাশের তলে
চাঁদ তার আকাঙ্খার স্থল খুঁজে লয় –
আমার নিকট থেকে তোমারে নিয়েছে কেটে যদিও সময়।
একদিন দিয়েছিলে যেই ভালোবাসা,
ভুলে গেছ আজ তার ভাষা!
জানি আমি, তাই
আমিও ভুলিয়া যেতে চাই
একদিন পেয়েছি যে ভালোবাসা
তার স্মৃতি আর তার ভাষা;
পৃথিবীতে যত ক্লান্তি আছে,
একবার কাছে এসে আসিতে চায় না আর কাছে
যে — মুহুর্তে;
একবার হয়ে গেছে, তাই যাহা গিয়েছে ফুরায়ে
একবার হেঁটেছে যে, তাই যার পায়ে
চলিবার শক্তি আর নাই;
সব চেয়ে শীত, তৃপ্ত তাই।
কেন আমি গান গাই?
কেন এই ভাষা
বলি আমি! এমন পিপাসা
বার বার কেন জাগে!
পড়ে আছে যতটা সময়
এমনি তো হয়।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #86

 

– জীবনানন্দ দাশ

কাউকে ভালোবেসেছিলাম জানি
তবুও ভালোবাসা,
দুপুরবেলার সূর্যে ভোরের শিশির
নেমে আসা,
ভোরের দিকে হৃদয় ফেরাই
যাই চলে যাই-
নীল সকালে যাই চলে যাই-
একটি নদী একটি অরূণ
শিউলি শিশির পাখি-
‘আমরা মায়ার মনের জিনিস
মায়াবিনীর বেলায় শুধু জাগি’
বলছে সে কোন্‌ ত্রিকোণ থেকে
ছায়ার পরিভাষা।
কাউকে ভালোবেসেছিলাম, জানি,
তবুও ভালোবাসা।
সে কোন্‌ সুদূর মরুর মনে চলে গেছ
হায়, যাযাবর তুমি,
সেইখানে কি মিলবে বনহংসী বাঁধা বাসা!

হায় বলিভূক, কখন ভেবেছিলে
মাটি ছেড়ে দূর আকাশের নীলে
ধূসর ডানার অগ্নি ছেড়ে দিলে
মিটে যাবে মায়াময়ী মাটির পিপাসা।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #87

 

– জীবনানন্দ দাশ

জেগে ওঠে হৃদয়ে আবেগ —
পাহাড়ের মতো অই মেঘ
সঙ্গে লয়ে আসে
মাঝরাতে কিংবা শেষরাতে আকাশে
যখন তোমারে! —
মৃত কে পৃথিবী এক আজ রাতে ছেড়ে দিল যারে!
ছেঁড়া ছেঁড়া শাদা মেঘ ভয় পেয়ে গেছে সব চলে
তরাসে ছেলের মতো– আকাশে নক্ষত্র গেছে জ্ব’লে
অনেক সময়–
তারপর তুমি এলে, মাঠের শিয়রে– চাঁদ–
পৃথিবীতে আজ আর যা হবার নয়,
একদিন হয়েছে যা– তারপর হাতছাড়া হয়ে
হারায়ে ফুরায়ে গেছে– আজও তুমি তার স্বাদ লয়ে
আর-একবার তবু দাঁড়ায়েছ এসে!
নিড়োনো হয়েছে মাঠ পৃথিবীর চার দিকে,
শস্যের ক্ষেত চেষে চেষে
গেছে চাষা চ’লে;
তাদের মাটির গল্প– তাদের মাঠের গল্প সব শেষ হলে
অনেক তবুও থাকে বাকি–
তুমি জানো– এ পৃথিবীর আজ জানে তা কি!

Bangla Kobita of Jibanananda Das #88

 

– জীবনানন্দ দাশ

পাহাড়, আকাশ, জল অনন্ত প্রান্তরঃ
সৃজনের কী ভীষণ উৎস থেকে জেগে
কেমন নীরব হয়ে রয়েছে আবেগ;
যেন বজ্রবাতাসের ঝড়
ছবির ভিতরে স্থির- ছবির ভিতরে আরো স্থির।

কোথাও উজ্জ্বল সূর্য আসে;
জ্যোতিষ্কেরা জ্ব’লে ওঠে সপ্রতিভ রাতে
আদি ধাতু অনাদির ধাতুর আঘাতে
নারীশিক্ষা হত যদি পুরুষের পাশেঃ
আকাশ প্রান্তর নীল পাহাড়ের মত
নক্ষত্র সূর্যের মত বিশ্ব-অন্তর্লীন
উজ্জ্বল শান্তির মত আমাদের রাত্রি আর দিন
হবে নাকি ব্রহ্মান্ডের লীন কারুকার্যে পরিণত।

কাব্যগ্রন্থ – আলোপৃথিবী

Bangla Kobita of Jibanananda Das #89

 

– জীবনানন্দ দাশ

যৌবনের সুরাপাত্র গরল-মদির
ঢালো নি অধরে তব, ধরা-মোহিনীর
উর্ধ্বফণা মায়া-ভুজঙ্গিনী
আসে নি তোমার কাম্য উরসের পথটুকু চিনি
চুমিয়া চুমিয়া তব হৃদয়ের মধু
বিষবহ্নি ঢালে নিকো বাসনার বধূ
অন্তরের পানপাত্রে তব;
অম্লান আনন্দ তব, আপ্লুত উৎসব,
অশ্রুহীন হাসি,
কামনার পিছে ঘুরে সাজো নি উদাসী।
ধবল কাশের দলে, আশ্বিনের গগনের তলে
তোর তরে রে কিশোর, মৃগতৃষ্ণা কভু নাহি জ্বলে!
নয়নে ফোটে না তব মিথ্যা মরুদ্যান।
অপরূপ রূপ-পরীস্থান
দিগন্তের আগে।
তোমার নির্মেষ চক্ষে কভু নাহি জাগে!
আকাশকুসুবীথি দিয়া
মাল্য তুমি আনো না রচিয়া
ছলাময় গগনের নিচে!
-রূপ-পিপাসায় জ্বলি মৃত্যুর পাথারে
স্পন্দহীন প্রেতপুরদ্বারে
করো নিকো করাঘাত তুমি
সুধার সন্ধানে লক্ষ বিষপাত্র চুমি
সাজো নিকো নীলকন্ঠ ব্যাকুল বাউল!
অধরে নাহিকো তৃষ্ণা, চক্ষে নাহি ভুল,
রক্তে তব অলক্ত যে পরে নাই আজও রানী,
রুধির নিঙাড়ি তব আজও দেবী মাগে নাই রক্তিম চন্দন!
কারাগার নাহি তব, নাহিকো বন্ধন,
দীঘল পতাকা, বর্শা তন্দ্রাহারা প্রহরীর লও নি তুলিয়া,
-সুকুমার কিশোরের হিয়া!
-জীবনসৈকতে তব দুলে যায় লীলায়িত লঘুনৃত্য নদী,
বক্ষে তব নাচে নিকো যৌবনের দুরন্ত জলধি;
শূল-তোলা শম্ভূর মতন
আস্ফালিয়া উঠে নাই মন
মিথ্যা বাধাবিধানের ধ্বংসের উল্লাসে!
তোমার আকাশে
দ্বাদশ সূর্যের বহ্নি ওঠে নিকো জ্বলি
কক্ষচ্যুত, উল্কাসম পড়ে নিকো স্খলি,
কুজ্ঝটিকা আবর্তের মাঝে
অনির্বাণ স্ফুলিঙ্গের সাজে!
সব বিঘ্ন সকল আগল
ভাঙিয়া জাগো নি তুমি স্পন্দন-পাগল
অনাগত স্বপ্নের সন্ধানে
দুরন্ত দুরাশা তুমি জাগাও নি প্রাণে!
নিঃস্ব দুটি অঞ্চলির আকিঞ্চন মাগি
সাজো নিকো দিকভোলা দিওয়ানা বৈরাগী!
পথে পথে ভিক্ষা মেগে কাম্য কল্পতরু
বাজাও নি শ্মশান-ডমরু!
জোছনাময়ী নিশি তব, জীবনের অমানিশা ঘোর
চক্ষে তব জাগে নি কিশোর!
আঁধারের নির্বিকল্প রূপ,
স্পন্দহীন বেদনার কূপ
রুদ্ধ তব বুকে;
তোমার সম্মূখে
ধরিত্রী জাগিছে ফুল্ল সুন্দরীর বেশে,
নিত্য বেলাশেষে
যেই পুষ্প ঝরে,
যে বিরহ জাগে চরাচরে,
গোধূলির অবসানে শ্লোকম্লান সাঁঝে,
তাহার বেদনা তব বক্ষে নাহি বাজে,
আকাঙ্খার অগ্নি দিয়া জ্বালো নাই চিতা,
ব্যথার সংহিতা
গাহ নাই তুমি!
দরিয়ার তীর ছাড়ি দেখ নাই দাব-মরুভূমি
জ্বলন্ত নিষ্ঠুর!
নগরীর ক্ষুব্ধ বক্ষে জাগে যেই মৃত্যুপ্রেতপুর,
ডাকিনীর রুক্ষ অট্টহাসি
ছন্দ তার মর্মে তব ওঠে না প্রকাশি!
সভ্যতার বীভৎস ভৈরবী
মলিন করে নি তব মানসের ছবি,
ফেনিল করে নি তব নভোনীল, প্রভাতের আলো,
এ উদভ্রান্ত যুবকের বক্ষে তার রশ্মি আজ ঢালো, বন্ধু, ঢালো!

Bangla Kobita of Jibanananda Das #90

 

– জীবনানন্দ দাশ

আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা যদি হয়
আবার বছর কুড়ি পরে-
হয়তো ধানের ছড়ার পাশে
কার্তিকের মাসে-
তখন সন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে- তখন হলুদ নদী
নরম নরম শর কাশ হোগলায়- মাঠের ভিতরে !

অথবা নাইকো ধান ক্ষেতে আর,
ব্যস্ততা নাই আর,
হাঁসের নীড়ের থেকে খড়
পাখির নীড় থেকে খড়
ছড়াতেছে; মনিয়ার ঘরে রাত, শীত আর শিশিরের জল !
জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি, কুড়ি, বছরের পার,-
তখন হঠাৎ যদি মেঠো পথে পাই আমি তোমারে আবার !
হয়তো এসেছে চাঁদ মাঝরাতে একরাশ পাতার পিছনে
সরু- সরু- কালো কালো ডালপালা মুখে নিয়ে তার,
শিরীষের অথবা জামের
ঝাউয়ের-আমেরঃ
কুড়ি বছরের পরে তখন তোমারে নাই মনে !

জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি-কুড়ি বছরের পার-
তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার !
তখন হয়তো মাঠে হামাগুড়ি দিয়ে পেচা নামে-
বাবলার গলির অন্ধকারে
অশথের জানালার ফাকে
কোথায় লুকায় আপনাকে !
চোখের পাতার মতো নেমে চুপি কোথায় চিলের ডানা থামে-
সোনালি সোনালি চিল- শিশির শিকার করে নিয়ে গেছে তারে-
কুড়ি বছর পরে সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে !

Bangla Kobita of Jibanananda Das #91

 

– জীবনানন্দ দাশ

কেন মিছে নক্ষত্রেরা আসে আর? কেন মিছে জেগে ওঠে নীলাভ আকাশ?
কেন চাঁদ ভেসে ওঠেঃ সোনার ময়ূরপঙ্খী অশ্বত্থের শাখার পিছনে?
কেন ধুলো সোঁদা গন্ধে ভরে ওঠে শিশিরের চুমো খেয়ে- গুচ্ছে গুচ্ছে
ফুটে ওঠে কাশ?
খঞ্জনারা কেন নাচে? বুলবুলি দুর্গাটুনটুনি কেন ওড়াওড়ি করে
বনে বনে?
আমরা যে কমিশন নিয়ে ব্যস্ত- ঘাটি বাঁধি- ভালিবাসি নগর ও
বন্দরের শ্বাস
ঘাস যে বুতের নীচে ঘাস শুধু- আর কিছু নয় আহা- মোটের যে
সবচেয়ে বড় এই মানব্জীবনে
খঞ্জনারা নাচে কেন তবে আর- ফিঙা বুলবুলি কেন উড়াউড়ি করে
বনে বনে?

Bangla Kobita of Jibanananda Das #92

 

– জীবনানন্দ দাশ

কেমন বৃষ্টি ঝরে—মধুর বৃষ্টি ঝরে—ঘাসে যে বৃষ্টি ঝরে—রোদে যে বৃষ্টি ঝরে আজ
কেমন সবুজ পাতা—জামীর সবুজ আরও—ঘাস যে হাসির মতো—রোদ যে সোনার মতো ঘাসে
সোনার রেখার মতো—সোনার রিঙের মতো—রোদ যে মেঘের কোলে—তোমার গালের টোলে রোদ
তোমার চুলে যে রোদ—মেঘের মতন চুলে—তোমার চোখে যে রোদ—সেও যে মেঘের মতো চোখ
আকাশে সোনালি চিল পাখনা ছড়ায়ে কাঁদে—(এমন সোনালি চিল)—সোনালি রেণুর মতো ঝরিছে কান্না আহা, মিশরে শুনেছি যেন কবে
আকাশে এমন ছেঁড়া ময়লা মেঘের রাশ—পড়েছে তাদের ছায়া নীলের ঘোলা জলে নিঝুম পিরামিডে
এমনই সোনালি রোদ—সোনার থামের মতো—ঘিয়ের শিখার মতো রয়েছে আকাশ ছিঁড়ে তবু
কেঁদেছে সোনালি চিল এমনই আকাশ ঘুরে—শুনেছি মিশরে আমি হাজার হাজার যুগ আগে
তোমার চুলে যে রোদ—মেঘের মতন চুলে—তোমার চোখে যে রোদ—সেও যে মেঘের মতো চোখ
কেমন বৃষ্টি ঝরে—মধুর বৃষ্টি ঝরে—ঘাসে যে বৃষ্টি ঝরে—রোদে যে বৃষ্টি ঝরে আজ

কাব্যগ্রন্থ – রুপসী বাংলা

Bangla Kobita of Jibanananda Das #93

 

– জীবনানন্দ দাশ

কোথাও চলিয়া যাব একদিন;-তারপর রাত্রির আকাশ
অসংখ্য নক্ষত্র নিয়ে ঘুরে যাবে কতকাল জানিব না আমি;
জানিব না কতকাল উঠানে ঝরিবে এই হলুদ বাদামী
পাতাগুলো-মাদারের ডুমুরের-সোঁদা গন্ধ-বাংলার শ্বাস
বুকে নিয়ে তাহাদের;-জানিব না পরথুপী মধুকূপী ঘাস
কত কাল প্রান-রে ছড়ায়ে রবে- কাঁঠাল শাখার থেকে নামি
পাখনা ডলিবে পেচাঁ এই ঘাসে-বাংলার সবুজ বালামী
ধানী শাল পশমিনা বুকে তার -শরতের রোদের বিলাস
কতো কাল নিঙড়াবে;-আচলে নাটোর কথা ভুলে গিয়ে বুঝি
কিশোরের মুখে চেয়ে কিশোরী করিবে তার মৃদু মাথা নিচু;
আসন্ন সন্ধ্যার কাক-করুণ কাকের দল খোড়া নীড় খুঁজি
উড়ে যাবে;-দুপুরে ঘাসের বুকে সিদুরের মতো রাঙা লিচু
মুখে গুজে পড়ে রবে-আমিও ঘাসের বুকে রবো মুখ গুজি;
মৃদু কাঁকনের শব্দ-গোরোচনা জিনি রং চিনিব না কিছু-

Bangla Kobita of Jibanananda Das #94

 

– জীবনানন্দ দাশ

কোথাও দেখি নি, আহা, এমন বিজন ঘাস — প্রান্তরের পারে
নরম বিমর্ষ চোখে চেয়ে আছে– নীল বুকে আছে তাহাদের
গঙ্গাফরিঙের নীড়,কাঁচপোকা, প্রজাপতি শ্যামাপোকা ঢের,
হিজলের ক্লান্ত পাতা– বটের অজস্র ফল ঝরে বারে বারে
তাহাদের শ্যাম বুকে–পাড়াগাঁর কিশোরেরা যখন কান্তারে
বেতের নরম ফল, নাটা ফক খেতে আসে,ধুন্দুল বীজের
খোঁজ করে ঘাসে ঘাসে– বক তাহা জানে নাকো, পায় নাকো টের
শালিখ, খন্জনা তাহা– লক্ষ লক্ষ ঘাস এই নদীর দু-ধারে

নরম কান্তারে এই পাড়াগাঁর বুকে শুয়ে সে কোন দিনের
কথা ভাবে; তখন এ জলসিড়ি শুকায় নি, মজে নি আকাশ,
বল্লাল সেনের ঘোড়া– ঘোড়ার কেশর ঘেরা ঘুঙুর জিনের
শব্দ হত এই পথে–আরো আগে রাজপুত্র কত দিন রাশ
টেনে টেনে এই পথে– কি যেন খুঁজেছে আহা, হয়েছে উদাস;
আজ আর খোঁজাখুজি নাই কিছু–নাটা ফলে মিটিতেছে আশ-

Bangla Kobita of Jibanananda Das #95

 

– জীবনানন্দ দাশ

কোথাও দেখিনি, আহা, এমন বিজন ঘাস – প্রান্তরের পারে
নরম বিমর্ষ চোখে চেয়ে আছে-নীল বুকে আছে তাহাদের
গঙ্গাফড়িঙের নীড়, কাঁচপোকা, প্রজাপতি, শ্যামাপোকা ঢের,
হিজলের ক্লান- পাতা,- বটের অজস্র ফল ঝরে বারে বারে
তাহাদের শ্যাম বুকে,-পাড়াগাঁর কিশোরেরা যখন কান্তারে
বেতের নরম ফল, নাটা ফল খেতে আসে, ধুন্দুল বীজের
খোঁজ করে ঘাসে ঘাসে-বক তাহা জানে নাকো, পায় নাকো টের
শালিখ খঞ্জনা তাহা; লক্ষ লক্ষ ঘাস এই নদীর দু’ধারে

নরম কান্তারে এই পাড়াগার বুকে শুয়ে সে কোন্‌ দিনের
কথা ভাবে; তখন এ জলসিড়ি শুকায়নি, মজেনি আকাশ,
বল্লাল সেনের ঘোড়া-ঘোড়ার কেশর ঘেরা ঘুঙুর জিনের
শব্দ হত এই পথে আরো আগে রাজপুত্র কতো দিন রাশ
টেনে টেনে এই পথে কি যেন খুঁজেছে, আহা হয়েছে উদাস,
আজ আর খোঁজাখুজি নাই কিছু- নাটাফলে মিটিতেছে আশ-

Bangla Kobita of Jibanananda Das #96

 

– জীবনানন্দ দাশ

কোথাও মঠের কাছে — যেইখানে ভাঙা মঠ নীল হয়ে আছে
শ্যাওলায় — অনেক গভীর ঘাস জমে গেছে বুকের ভিতর,
পাশে দীঘি মজে আছে — রূপালী মাছের কন্ঠে কামনার স্বর
যেইখানে পটরানী আর তার রূপসী সখীরা শুনিয়াছে
বহু বহু দিন আগে — যেইখানে শঙ্খমালা কাঁথা বুনিয়াছে
সে কত শতাব্দী আগে মাছরাঙা — ঝিলমিল — কড়ি খেলা ঘর;
কোন্‌ যেন কুহকীর ঝাঁড়ফুঁকে ডুবে গেছে সব তারপর
একদিন আমি যাব দু-প্রহরে সেই দূর প্রান্তরের কাছে,

সেখানে মানুষ কেউ যায় নাকে — দেখা যায় বাঘিনীর ডোরা
বেতের বনের ফাঁকে — জারুল গাছের তলে রৌদ্র পোহায়
রূপসী মৃগীর মুখ দেখা যায়, — শাদা ভাঁট পুষ্পের তোড়া
আলোকতার পাশে গন্ধ ঢালে দ্রোণফু বাসকের গায়;
তবুও সেখানে আমি নিয়ে যাবো একদিন পাটকিলে ঘোড়া
যার রূপ জন্মে — জন্মে কাঁদায়েছে আমি তারে খুঁজিব সেথায়।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #97

 

– জীবনানন্দ দাশ

কোথায় গিয়েছে আজ সেইসব পাখি-আর সেইসব ঘোড়া-
সেই শাদা দালানের নারী?
বাবলা ফুলের গন্ধে-সোনালি রোদের রঙ্গে ওড়া
সেইসব পাখি-আর সেইসব ঘোড়া
চলে গেছে আমাদের এ পৃথিবী ছেড়ে;
হৃদয় কোথায় বলো-কোথায় গিয়েছে আজ সব
অন্ধকার; মৃত নাসপাতিটির মতন নীরব।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #98

 

– জীবনানন্দ দাশ

এখন অনেক রাতে বিছানা পেয়েছ।
নরম আঁধার ঘর
শান্তি নিস্তব্ধতা;
এখন ভেবো না কোনো কথা
এখন শোনো না কোনো স্বর
রক্তাক্ত হৃদয় মুছে
ঘুমের ভিতর
রজনীগন্ধার মতো মুদে থাকো।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #99

 

– জীবনানন্দ দাশ

কোনোদিন দেখিব না তারে আমি: হেমন্তে পাকিবে ধান, আষাঢ়ের রাতে
কালো মেঘ নিঙড়ায়ে সবুজ বাঁশের বন গেয়ে যাবে উচ্ছ্বাসের গান
সারারাত, — তবু আমি সাপচরা অন্ধ পথে — বেনুবনে তাহার সন্ধান
পাবো নাকে: পুকুরের পাড়ে সে যে আসিবে না কোনোদিন হাঁসিনীর সাথে,
সে কোনো জ্যোৎস্নায় আর আসিবে না — আসিবে না কখনো প্রভাতে,
যখন দুপুরে রোদে অপরাজিতার মুখ হয়ে থাকে ম্লান,
যখন মেঘের রঙে পথহারা দাঁড়কাক পেয়ে গেছে ঘরের সন্ধান,
ধূসর সন্ধ্যায় সেই আসিবে না সে এখানে; — এইখানে ধুন্দুল লতাতে
জোনাকি আসিবে শুধু: ঝিঁঝিঁ শুধু; সারারাত কথা কবে ঘাসে আর ঘাসে
বাদুড় উড়িবে শুধু পাখনা ভিজায়ে নিয়ে শান্ত হয়ে রাতের বাতাসে;
প্রতিটি নক্ষত্র তার স’ান খুঁজে জেগে রবে প্রতিটির পাশে
নীরব ধূসর কণা লেগে রবে তুচ্ছ অনূকণাটির শ্বাসে
অন্ধকারে — তুমি, সখি চলে গেলে দূরে তবু; — হৃদয়ের গভীর বিশ্বাসে
অশ্বত্থের শাখা ঐ দুলিতেছে; আলো আসে, ভোর হয়ে আসে।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #100

 

– জীবনানন্দ দাশ

এখানে বনের কাছে ক্যাম্প আমি ফেলিয়াছি;
সারারাত দখিনা বাতাসে
আকাশের চাঁদের আলোয়
এক ঘাইহরিণীর ডাকে শুনি –
কাহারে সে ডাকে!

কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;
বনের ভিতরে আজ শিকারীরা আসিয়াছে,
আমিও তাদের ঘ্রাণ পাই যেন,
এইখানে বিছানায় শুয়ে শুয়ে
ঘুম আর আসে নাকো
বসন্তের রাতে।

চারি পাশে বনের বিস্ময়,
চৈত্রের বাতাস,
জোছনার শরীরের স্বাদ যেন্‌!
ঘাইমৃগী সারারাত ডাকে;
কোথাও অনেক বনে — যেইখানে জোছনা আর নাই
পুরুষহিরণ সব শুনিতেছে শব্দ তার;
তাহারা পেতেছে টের
আসিতেছে তার দিকে।
আজ এই বিস্ময়ের রাতে
তাহাদের প্রেমের সময় আসিয়াছে;
তাহাদের হৃদয়ের বোন
বনের আড়াল থেকে তাহাদের ডাকিতেছে
জোছনায় –
পিপাসার সন্ত্বনায় — অঘ্রাণে — আস্বাদে!
কোথাও বাঘের পাড়া বনে আজ নাই আর যেন!
মৃগদের বুকে আজ কোনো স্পষ্ট ভয় নাই,
সন্দেহের আবছায়া নাই কিছু;
কেবন পিপাসা আছে,
রোমহর্ষ আছে।

মৃগীর মুখের রূপে হয়তো চিতারও বুকে জেগেছে বিস্ময়!
লালসা — আকাঙক্ষা — সাধ — প্রেম স্বপ্ন স্ফুট হয়ে উঠিতেছে সব দিকে
আজ এই বসন্তের রাতে;
এই খানে আমার নক্‌টার্ন –|

একে একে হরিণেরা আসিতেছে গভীর বনের পথ ছেড়ে,
সকল জলের শব্দ পিছে ফেলে অন্য এক আশ্বাসের খোঁজে
দাঁতের — নখের কথা ভূলে গিয়ে তাদের বোনের কাছে অই
সুন্দরী গাছের নীচে — জোছনায়!
মানুষ যেমন করে ঘ্রাণ পেয়ে আসে তার নোনা মেয়েমানুষের কাছে
হরিণেরা আসিতেছে।

– তাদের পেতেছি আমি টের
অনেক পায়ের শব্দ শোনা যায়,
ঘাইমৃগী ডাকিতেছে জোছনায়।
ঘুমাতে পারি না আর;
শুয়ে শুয়ে থেকে
বন্দুকের শব্দ শুনি;
চাঁদের আলোয় ঘাইহরিণি আবার ডাকে;
এইখানে পড়ে থেকে একা একা
আমার হৃদয়ে এক অবসাদ জমে ওঠে
বন্দুকের শব্দ শুনে শুনে
হরিণীর ডাক শুনে শুনে।

কাল মৃগী আসিবে ফিরিয়া;
সকালে — আলোয় তারে দেখা যাবে –
পাশে তার মৃত সব প্রেমিকেরা পড়ে আছে।
মানুষেরা শিখায়ে দিয়েছে তারে এই সব।

আমার খাবার ডিশে হরিণের মাংসের ঘ্রাণ আমি পাব,
মাংস খাওয়া হল তবু শেষ?
কেন শেষ হবে?
কেন এই মৃগদের কথা ভেবে ব্যথা পেতে হবে
তাদের মতন নই আমিও কি?
কোনো এক বসন্তের রাতে
জীবনের কোনো এক বিস্ময়ের রাতে
আমারেও ডাকে নি কি কেউ এসে জোছনায় — দখিনা বাতাসে
অই ঘাইহরিণীর মতো?

আমার হৃদয় — এক পুরুষহরিণ –
পৃথিবীর সব হিংসা ভুলে গিয়ে
চিতার চোখের ভয় — চমকের কথা সব পিছে ফেলে রেখে
তোমারে কি চায় নাই ধরা দিতে?
আমার বুকের প্রেম ঐ মৃত মৃগদের মতো
যখন ধূলায় রক্তে মিশে গেছে
এই হরিণীর মতো তুমি বেঁচেছিল নাকি
জীবনের বিস্ময়ের রাতে
কোনো এক বসন্তের রাতে?

তুমিও কাহার কাছে শিখেছিলে!
মৃত পশুদের মতো আমাদের মাংস লয়ে আমারও পড়ে থাকি;
বিয়োগের — বিয়োগের — মরণের মুখে এসে পড়ে সব
ঐ মৃত মৃগদের মতো –
প্রেমের সাহস সাধ স্বপ্ন বেঁচে থেকে ব্যথা পাই, ঘৃণা মৃত্যু পাই;
পাই না কি?
দোনলার শব্দ শুনি।
ঘাইমৃগী ডেকে যায়,
আমার হৃদয়ে ঘুম আসে নাকো
একা একা শুয়ে থেকে;
বন্দুকের শব্দ তবু চুপে চুপে ভুলে যেতে হয়।
ক্যম্পের বিছানায় রাত তার অন্য এক কথা বলে;
যাহাদের দোনলার মুখে আজ হরিণেরা মরে যায়
হরিণের মাংস হাড় স্বাদ তৃপ্তি নিয়ে এল যাহাদের ডিশে
তাহারাও তোমার মতন –
ক্যাম্পের বিছানায় শুয়ে থেকে শুকাতেছে তাদের ও হৃদয়
কথা ভেবে — কথা ভেবে — ভেবে।

এই ব্যথা এই প্রেম সব দিকে রয়ে গেছে –
কোথাও ফড়িঙে — কীটে, মানুষের বুকের ভিতরে,
আমাদের সবের জীবনে।
বসন্তের জোছনায় অই মৃত মৃগদের মতো
আমরা সবাই।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #101

 

– জীবনানন্দ দাশ

ঢের সম্রাটের রাজ্যে বাস ক’রে জীব
অবশেষে একদিন দেখেছে দু-তিন ধনু দূরে
কোথাও সম্রাট নেই, তবুও বিপ্লবী নেই, চাষা
বলদের নিঃশব্দতা ক্ষেতের দুপুরে।
বাংলার প্রান্তরের অপরাহ্ন এসে
নদীর খাড়িতে মিশে ধীরে
বেবিলন লণ্ডনের জন্ম, মৃত্যু হ’লে-
তবুও রয়েছে পিছু ফিরে।
বিকেল এমন ব’লে একটি কামিন এইখানে
দেখা দিতে এলো তার কামিনীর কাছে;
মানবের মরণের পরে তার মমির গহ্বর
এক মাইল রৌদ্রে প’ড়ে আছে।


আবার বিকেলবেলা নিভে যায় নদীর খাড়িতে;
একটি কৃষক শুধু ক্ষেতের ভিতরে
তার বলদের সাথে সারাদিন কাজ ক’রে গেছে;
শতাব্দী তীক্ষ্ম হ’য়ে পড়ে।
সমস্ত গাছের দীর্ঘ ছায়া
বাংলার প্রান্তরে পড়েছে;
এ-দিকের দিনমান- এ যুগের মতো শেষ হ’য়ে গেছে,
না জেনে কৃষক চোত-বোশেখের সন্ধ্যার বিলম্বনে প’ড়ে
চেয়ে দেখে থেমে আছে তবুও বিকাল;
ঊনিশশো বেয়াল্লিশ ব’লে মনে হয়
তবুও কি ঊনিশশো বিয়াল্লিশ সাল।


কোথাও শান্তির কথা নেই তার, উদ্দীপ্তিও নেই
একদিন মৃত্যু হবে, জন্ম হয়েছে;
সূর্য উদয়ের সাথে এসেছিলো ক্ষেতে;
সূর্যাস্তের সাথে চ’লে গেছে।
সূর্য উঠবে জেনে স্থির হ’য়ে ঘুমায়ে রয়েছে।
আজ রাতে শিশিরের জল
প্রাগৈতিহাসিক স্মৃতি নিয়ে খেলা করে;
কৃষাণের বিবর্ণ লাঙ্গল,
ফালে ওপড়ানো সব অন্ধকার ঢিবি,
পোয়াটাক মাইলের মতন জগৎ
সারাদিন অন্তহীন কাজ ক’রে নিরুৎকীর্ণ মাঠে
প’ড়ে আছে সৎ কি অসৎ।


অনেক রক্তের ধ্বকে অন্ধ হ’য়ে তারপর জীব
এইখানে তবুও পায়নি কোনো ত্রাণ;
বৈশাখের মাঠের ফাটলে
এখানে পৃথিবী অসমান।
আর কোনো প্রতিশ্রুতি নেই।
কেবল খড়ের স্তুপ প’ড়ে আছে দুই- তিন মাইল,
তবু তা সোনার মতো নয়,
কেবল কাস্তের শব্দ পৃথিবীর কামানকে ভুলে
করুণ নিরীহ, নিরাশ্রয়।
আর কোনো প্রতিশ্রুতি নেই।
জলপিপি চ’লে গেলে বিকেলের নদী কান পেতে
নিজের জলের সুর শোনে;
জীবাণুর থেকে আজ কৃষক, মানুষ
জেগেছে কি হেতুহীন সম্প্রসারণে-
ভ্রান্তিবিলাসে নীল আচ্ছন্ন সাগরে?
চৈত্য, ক্রুশ, নাইন্টিথ্রি ও সোবিয়েট শ্রুতি প্রতিশ্রুতি
যুগান্তের ইতিহাস অর্থ দিয়ে কূলহীন সেই মহাসাগরে প্রাণ
চিনে-চিনে হয়তো বা নচিকেতা প্রচেতার চেয়ে অনিমেষে
প্রথম ও অন্তিম মানুষের প্রিয় প্রতিমান
হ’য়ে যায় স্বাভাবিক জনমানবের সূর্যালোকে।

কাব্যগ্রন্থ – সাতটি তারার তিমির

Bangla Kobita of Jibanananda Das #102

 

– জীবনানন্দ দাশ

খুঁজে তারে মরো মিছে — পাড়াগাঁর পথে তারে পাবে নাকো আর;
রয়েছে অনেক কাক এ উঠানে — তবু সেই ক্লান্ত দাঁড়কাক
নাই আর; — অনেক বছর আগে আমে জামে হৃষ্ট এক ঝাঁক
দাঁড়কাক দেখা যেত দিন — রাত, — সে আমার ছেলেবেলাকার
কবেকার কথা সব; আসিবে না পৃথিবীতে সেদিন আবার:
রাত না ফুরাতে সে যে কদমের ডাল থেকে দিয়ে যেত ডাক, —
এখনো কাকের শব্দে অন্ধকার ভোরে আমি বিমনা, অবাক
তার কথা ভাবি শুধু; এত দিনে কোথায় সে? কি যে হলো তার
কোথায় সে নিয়ে গেছে সঙ্গে করে সেই নদী, ক্ষেত, মাঠ, ঘাস,
সেই দিন, সেই রাত্রি, সেই সব ম্নান চুল, ভিজে শাদা হাত
সেইসব নোনা গাছ, করমচা, শামুক গুগলি, কচি তালশাসঁ
সেইসব ভিজে ধুলো, বেলকুড়ি ছাওয়া পথ, ধোয়া ওঠা ভাত,
কোথায় গিয়েছে সব? — অসংখ্য কাকের শব্দে ভরিছে আকাশ
ভোর রাতে — নবান্নের ভোরে আজ বুকে যেন কিসের আঘাত!

Bangla Kobita of Jibanananda Das #103

 

– জীবনানন্দ দাশ

সর্বদাই প্রবেশের পথ র’য়ে গেছে;
এবং প্রবেশ ক’রে পুনরায় বাহির হবার;-
অরণ্যের অন্ধকার থেকে এক প্রান্তরের আলোকের পথে;
প্রান্তরের আলো থেকে পুনরায় রাত্রির আঁধারে;
অথবা গৃহের তৃপ্তি ছেড়ে দিয়ে নারী, ভাঁড়, মক্ষিকার বারে।

এই সব শরীরের বিচরণ।
ঘুমায়ে সে যেতে পারে।
(সচেতন যাত্রার পথ তবু আরো প্রসারিত।
আলো অন্ধকার তার কাছে কিছু নয়।)
উট পাখি সারাদিন দিবারৌদ্রে ফিরে
বালির ভিতরে মাথা রেখে দিয়ে আপনার অন্ধ পরিচয়
হয়তো ভা নিয়ে যায়,- তা’ পাখির বিনয়।

কোনো এক রমণীকে ভালোবেসে,
কোনো এক মরকের দেশে গিয়ে জোর পেয়ে,
কোন এক গ্রন্থ প’ড়ে প্রিয় সত্য পেয়ে গেছি ভেবে,
অথবা আরেক সত্য সকলকে দিতে গিয়ে অভিভূত হয়ে,
শরতের পরিষ্কার রাত পেয়ে সব চেয়ে পোষাকী, উজ্জ্বল-
চিন্তা তবু বর্ষারাতে দ্বার থেকে দ্বারে
ভিজে কুকুরের মত গাত্রদাহ ঝাড়ে।
সমাধির ঢের নিচে- নদীর নিকটে সব উঁচু উঁচু গাছের শিকড়
গিয়ে নড়ে।

সেইখানে দার্শনিকের দাঁত ক্কাথ পান করে
পরিত্যাক্ত মিঠে আলিউ, মরামাস, ইঁদুরের শবের ভিতরে;-
জেনে নিয়ে আমরা প্রস্তুত ক’রে নিই নিজেদের;
কেননা ভূমিকা ঢের র’য়ে গেছে-
বোঝা যাবে (কিছুটা বিনয় যদি থেকে থাকে চোখে)-
সূশ্রী ময়ূরও কেন উটপাখি সৃষ্টি ক’রেছিল
টানাপোড়েনের সুরে- সূর্যের সপ্তকে।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #104

 

– জীবনানন্দ দাশ

ডুবলো সূর্য; অন্ধকারের অন্তরালে হারিয়ে গেছে দেশ।
এমনতর আঁধার ভালো আজকে কঠিন রুক্ষ শতাব্দীতে।
রক্ত-ব্যথা ধনিকতার উষ্ণতা এই নীরব স্নীগ্ধ অন্ধকারের শীতে
নক্ষত্রদের স্থির সমাসীন পরিষদের থেকে উপদেশ
পায় না নব; তবুও উত্তেজনাও যেন পায় না এখন আর;
চারদিকেতে সার্থবাহের ফ্যাক্টার ব্যঙ্ক মিনার জাহাজ—সব,
ইন্দ্রলোকের অপ্সরীদের ঘাটা,
গ্লাসিয়ারের যুগের মতন আঁধারে নীরব।

অন্ধকারের এ-হাত আমি ভালোবাসি; চেনা নারীর মতো
অনেক দিনের অদর্শনার পরে আবার হাতের কাছে এসে
জ্ঞানের আলো দিনকে দিয়ে কি অভিনিবেশে
প্রেমের আলো প্রেমকে দিতে এসেছে সময় মতো;
হাত দু’খানা ক্ষমাসফল; গণনাহীন ব্যক্তিগত গ্লানি
ইতিহাসের গোলকধাঁধায় বন্দী মরুভূমি-
সবের প্রে মৃত্যুতে নয়—নীরবতায় আত্মবিচারের
আঘাত দেবার ছলে কি রাত এমন স্নিগ্ধ তুমি।

আজকে এখন আধাঁরে অনেক মৃত ঘুমিয়ে আছে।
অনেক জীবিতেরা কঠিন সাঁকো বেয়ে মৃত্যুনদীর দিকে
জলের ভিতর নামছে—ব্যবহৃত পৃথিবীটিকে
সন্ততিদের চেয়েও বেশি দৈব আধাঁর আকাশবাণীর কাছে
ছেড়ে দিয়ে—স্থির ক’রে যায় ইতিহাসের গতি।
যারা গেছে যাচ্ছে—রাতে যাবো সকলি তবে।
আজকে এ-রাত তোমার থেকে আমায় দূরে দাঁড় করিয়ে দিয়ে
তবুও তোমার চোখে আত্মা আত্মীয় এক রাত্রি হয়ে রবে।

তোমায় ভালোবেসে আমি পৃথিবীতে আজকে প্রেমিক, ভাবি।
তুমি তোমার নিজের জীবন ভালোবাস; কথা
এইখানেতেই ফুরিয়ে গেছে; শুনেছি তোমার আত্মলোলুপতা
প্রেমের চেয়ে প্রাণের বৃহৎ কাহিনীদের কাছে গিয়ে দাবি
জানিয়ে নিদয় খৎ দেখিয়ে আদায় ক’রে নেয়
ব্যাপক জীবন শোষণ ক’রে যে-সব নতুন সচল স্বর্গ মেলে;
যদিও আজ রাষ্ট সমাজ অতীত অনাগতের কাছে তমসুকে বাধাঁ,
প্রাণাকাশে বচনাতীত রাত্রি আসে তবুও তোমার গভীর এরিয়েলে।

কাব্যগ্রন্থ – বেলা অবেলা কালবেলা

Bangla Kobita of Jibanananda Das #105

 

– জীবনানন্দ দাশ

গল্পে আমি পড়িয়াছি কাঞ্চী কাশী বিদিশার কথা
কোনদিন চোখে দেখি নাই
একদিন ভাবিলাম মাঠে মাঠে কুয়াশায়
যদি আমি কোনোদিন বিদিশায় যাই—

মাঠে মাঠে কুয়াশায় ভাবিলাম এই কথা
বহু দিন বহু বহু রাত ধ’রে আমি
যদি আমি—কোনোদিন যদি আমি
অবন্তীর পথে গিয়ে নামি—

পউষের কুয়াশায় সাপের খোলস, পাতা, ডিম
প’ড়ে আছে ঘাসে,
কেন যে করুণ চোখ পথ ভুলে ভেসে গেল
ময়জানি নদীটির পাশে—

এসেছে এ কার বজরা ?
চারিদিকে শীত নদী : যেন মরুভূমি
বজরার জানালায় কার মুখ
এই পথে এত দিন পরে কেন তুমি ?

কবেকার মাঠ—পথ—মন্দির কুয়াশার ফাঁকে দিল দেখা
হৃদয়ে তাতাল বালির মতো তৃষা
নদীর আঁধার জলে ভ’রে গেল
আমি যে গো দেখেছি বিদিশা।

সব কথা মনে পড়ে
জলসিড়ি নদী আর জানে না সে কথা
নীলাভ ঘাসের পথে জ্যোৎস্নায়।

কাব্যগ্রন্থ – রুপসী বাংলা

Bangla Kobita of Jibanananda Das #106

 

– জীবনানন্দ দাশ

গুবরে ফড়িং শুধু উড়ে যায় আজ এই সন্ধ্যার বাতাসে,
খড়কুটা ঝড়ে শুধু শাইকের মুখ থেকে চুপে।
আবার শালিখা, সেই খড়গুনো কুড়ায় নিশ্চুপে।
সন্ধ্যার লাল শিরা মৃদু চোখে ঘরে ফিরে আসে
ঘুঘুর নরম ডাকে—নীরব আকাশে
নক্ষত্রেরা শান্তি পায়—পউষের কুয়াশায় ধূপে
পুঁয়ের সবুজ রাঙা লতা আছে ডুবে।
এ কোমল স্নিগ্ধ হিম সান্ত্বনার মাসে
চোখে তার শান্তি শুধু—লাল লাল ফলে বুক আছে দেখ ভ’রে।
গুবরে ফড়িং কই উড়ে যায় আজ এই সন্ধ্যার বাতসে,
খড়কুটা ঝরে শুধু শালিখের মুখ থেকে চুপে
আবার শালিখ অই খড়গুনো কুড়ায় নিশ্চুপে।
সন্ধ্যার লাল শিরা মৃদু চোখে ঘরে ফিরে আসে
তবুও তোমারে আমি কোনোদিন পাব নাকো অসীম আকাশে।

কাব্যগ্রন্থ – রুপসী বাংলা

Bangla Kobita of Jibanananda Das #107

 

– জীবনানন্দ দাশ

দরদালানের ভিড়- পৃথিবীর শেষে
যেইখানে প’ড়ে আছে- শব্দহীন- ভাঙ্গা-
সেইখানে উঁচু-উঁচু হরীতকী গাছের পিছনে
হেমন্তের বিকেলের সূর্য গোল- রাঙা-

চুপে-চুপে ডুবে যায়- জ্যোৎস্নায়।
পিপুলের গাছে ব’সে পেঁচা শুধু একা
চেয়ে দ্যাখে; সোনার বলের মতো সূর্য আর
রূপার ডিবের মতো চাঁদের বিখ্যাত মুখ দেখা।

হরীতকী শাখাদের নিচে যেন হীরের স্ফুলিঙ্গ
আর স্ফটিকের মতো শাদা জলের উল্লাসঃ
নৃমুণ্ডের আবছায়া- নিস্তব্ধতা-
বাদামী পাতার ঘ্রাণ- মধুকুপী ঘাস।

কয়েকটি নারী যেন ঈশ্বরীর মতোঃ
পুরুষ তাদেরঃ কৃতকর্ম নবীন;
খোঁপার ভিতরে চুলেঃ নরকের নবজাত মেঘ,
পায়ের ভঙ্গির নিচে হঙকঙের তৃণ।

সেখানে গোপন জল ম্লান হ’য়ে হীরে হয় ফের,
পাতাদের উৎসরণে কোন শব্দ নাই;
তবু তারা টের পায় কামানের স্থবির গর্জনে
বিনষ্ট হতেছে সাংহাই।

সেইখানে যুথচারী কয়েকটি নারী
ঘনিষ্ঠ চাঁদের নিচে চোখ আর চুলের সংকেতে
মেধাবিনী; দেশ আর বিদেশের পুরুষেরা
যুদ্ধ আর বাণিজ্যের রক্তে আর উঠিবে না মেতে।

প্রগাঢ় চুম্বন ক্রমে টানিতেছে তাহাদের
তুলোর বালিশে মাথা রেখে আর মানবীয় ঘুমে
স্বাদ নেই; এই নিচু পৃথিবীর মাঠের তরঙ্গ দিয়ে
ওই চূর্ণ ভূখণ্ডের বাতাসে- বরুণে
ক্রুর পথ নিয়ে যায় হরীতকী বনে- জ্যোৎস্নায়।
যুদ্ধ আর বাণিজ্যের বেলোয়ারি রৌদ্রের দিন
শেষ হ’য়ে গেছে সব; বিনুনিতে নরকের নির্বাচন মেঘ,
পায়ের ভঙ্গির নিচে বৃশ্চিক কর্কট- তুলা- মীন।

কাব্যগ্রন্থ – সাতটি তারার তিমির

Bangla Kobita of Jibanananda Das #108

 

– জীবনানন্দ দাশ

গোলপাতা ছাউনির বুক চুমে নীল ধোঁয়া সকালে সন্ধ্যায়
উড়ে যায়- মিশে যায় আমবনে কার্তিকের কুয়াশার সাথে;
পুকুরের লাল সর ক্ষীণ ঢেউয়ে বার-বার চায় সে জড়াতে
করবীর কচি ডাল; চুমো খেতে চায় মাছরাঙাটির পায়;
এক-একটি ইট ধ্বসে-ডুবজলে ডুব দিয়ে কোথায় হারায়
ভাঙা ঘাটলায় এই-আজ আর কেউ এসে চাল-ধোয়া হাতে
বিনুনি খসায় নাকো-শুকনো পাতা সারা দিন থাকে যে গড়াতে;
কড়ি খেলিবার ঘর মজে গিয়ে গোখুরার ফাটলে হারায়;

ডাইনীর মতো হাত তুলে-তুলে ভাঁট আঁশশ্যাওড়ার বন
বাতাসে কি কথা কয় বুঝি নাকো, -বুঝি নাকো চিল কেন কাঁদে
পৃথিবীর কোনো পথে দেখি নই আমি, হায়, এমন বিজন
শাদা পথ-সোঁদা পথ-বাঁশের ঘোমটা মুখে বিধবার ছাঁদে
চলে গেছে শ্মশানের পারে বুঝি;-সন্ধ্যা সহসা কখন;
সজিনার ডালে পেঁচা কাঁদে নিম-নিম নিম কার্তিকের চাঁদে।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #109

 

– জীবনানন্দ দাশ

ঘরের ভিতরে দীপ জ্বলে ওঠে সন্ধ্যায়—ধীরে ধীরে বৃষ্টি ক্ষান্ত হয়
ভিজে চালে ডুমুরের পাতা ঝরে—শালিখ বসিয়া থাকে মুহূর্ত সময়
জানালার কাছে এসে, ভিজে জানালার কাছে
মৌমাছি বহুক্ষণ মৃদু গুমরায়
এইসব ভালো লাগে : এইসব ম্লান গন্ধ মৃদু স্বাদ চায়
পৃথিবীর পথে ঘুরে আমার হৃদয়
ডুমুরের পাতা ঝরে ভিজে চালে—ধীরে ধীরে বৃষ্টি ক্ষান্ত হয়
মলিন শাড়ির ঘ্রাণ ধূপ হাতে দুয়ারে দাঁড়ায়।

এইসব ভালোবাসি—জীবনের পথে ঘুরে
এইসব ভালোবাসে আমার হৃদয়
ঘরে আলো, বৃষ্টি ক্ষান্ত হ’ল সন্ধ্যায়
ঘরের দীপ জ্বলে ওঠে, ধীরে ধীরে বৃষ্টি ক্ষান্ত হয়
ভিজে চালে কদমের পাতা ঝরে—শালিক বসিয়া থাকে মুহূর্ত সময়
মলিন শাড়ির ঘ্রাণ ধূপ হাতে দুয়ারে দাঁড়ায়
মৃদু আরো মৃদু হয়ে অবিরল বাতাসে হারায়।।

কাব্যগ্রন্থ – রুপসী বাংলা

Bangla Kobita of Jibanananda Das #110

 

– জীবনানন্দ দাশ

ঘাটশিলা—ঘটশিলা—
কলকাতা ছেড়ে বল ঘাটশিলা কে যায় মিছাই
চিরদিন কলতাকা থাকি আমি,
ঘাটশিলা ছাই।

চিঠির উপরে তবু চিঠি
কয়েকটা দিন
এইখানে এসে তুমি থেকে যাও
চিঠিগুনো হয়ে গেল পুরোনো মলিন

তবু আমি গেলাম না
যদিও দেখেছি আমি কলকাতা থেকে
কত দিন কত রাত
ঘাটশিলা গিয়েছে অনেকে

একদিন তারপর—বহুদিন পরে
অনেক অসাধ অনিচ্ছায়
ঘাটশিলা চলিলাম
ঘাটশিলা দেখিলাম হায়

আবার এসেছি ফিরে—ধোঁয়ায় ধুলায় ভিড়ে
ফুটপাথে—ট্রামের জগতে
পথ থেকে পথে ফিরি
পথ থেকে ক্লান্ত পথে পথে।

কী হল তোমার, আহা,
আমার হৃদয়
তোমারে যে গোধূলির তেপান্তরে
মায়াবীর মতো মনে হয়,

যেই এই পৃথিবীর বেলা শেষ হয়ে গেছে
ম্না ঘোড়া নিয়ে একা তুমি
কড়ির পাহাড় খুঁজে ঘুরিতেছ
ঘুরিছ হাড়ের মরুভূমি।

কাব্যগ্রন্থ – রুপসী বাংলা

Bangla Kobita of Jibanananda Das #111

 

– জীবনানন্দ দাশ

কচি লেবুপাতার মতো নরম সবুজ আলোয়
পুথিবী ভরে গিয়েছে এই ভোরের বেলা;
কাঁচা বাতাবির মতো সবুজ ঘাস-তেমনি সুঘ্রাণ-
হরিণেরা দাঁত দিয়ে ছিড়ে নিচ্ছে।
আমারো ইচ্ছা করে এই ঘাসের এই ঘ্রাণ হরিৎ মদের মতো
গেলাসে – গেলাসে পান করি,
এই ঘাসের শরীর ছানি- চোখে চোখে ঘষি,
ঘাষের পাখনায় আমার পালক,
ঘাষের ভিতর ঘাস হয়ে জন্মাই কোন এক নিবিড় ঘাস-মাতার
শরীরের সুস্বাদ অন্ধকার থেকে নেমে।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #112

 

– জীবনানন্দ দাশ

ঘাসের বুকের থেকে কবে আমি পেয়েছি যে আমার শরীর –
সবুজ ঘাসের থেকে; তাই রোদ ভালো লাগে — তাই নীলাকাশ
মৃদু ভিজে সকরুণ মনে হয়; — পথে পথে তাই এই ঘাস
জলের মতন স্নিগ্ধ মনে হয়, — কউমাছিদের যেন নীড়
এই ঘাস; — যত দূর যাই আমি আরো যত দূর পৃথিবীর
নরম পায়ের তলে যেন কত কুমারীর বুকের নিঃশ্বাস
কথা কয় — তাহাদের শান — হাত খেলা করে — তাদের খোঁপায় এলো ফাঁস
খুলে যায় — ধূসর শাড়ির গন্ধে আসে তারা — অনেক নিবিড়

পুরোনো প্রাণের কথা কয়ে যায় — হৃদয়ের বেদনার কথা –
সান্ত্বনার নিভৃত নরম কথা — মাঠের চাঁদের গল্প করে –
আকাশের নক্ষত্রের কথা কয়; — শিশিরের শীত সরলতা
তাহাদের ভালো লাগে, — কুয়াশারে ভালো লাগে চোখের উপরে;
গরম বৃষ্টির ফোঁটা ভালো লাগে; শীত রাতে — পেঁচার নম্রতা;
ভালো লাগে এই যে অশ্বথ পাতা আমপাতা সারারাত ঝরে।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #113

 

– জীবনানন্দ দাশ

ঘাসের ভিতরে সেই চড়ায়ের শাদা ডিম ভেঙে আছে — আমি ভালোবাসি
নিস্তব্ধ করুণ মুখ তার এই — কবে যেন ভেঙেছিল — ঢের ধুলো খড়
লেগে আছে বুকে তার — বহুক্ষণ চেয়ে থাকি; — তারপর ঘাসের ভিতর
শাদা শাদা ধুলোগুলো পড়ে আছে, দেখা যায় খইধান দেখি একরাশি
ছড়ায়ে রয়েছে চুপে; নরম বিষন্ন গন্ধ পুকুরের জল থেকে উঠিতেছে ভাসি;
কান পেতে থাকি যদি, শোনা যায়, সরপুটি চিতলের উদ্ভাসিত স্বর
মীনকন্যাদের মতো, সবুজ জলের ফাঁকে তাদের পাতালপুরী ঘর
দেখা যায় — রহস্যের কুয়াশায় অপরূপ — রূপালি মাছের দেহ গভীর উদাসী

চলে যায় মন্ত্রিকুমারের মতো, কোটাল ছেলের মতো রাজার ছেলের মতো মিলে
কোন এক আকাঙ্খার উদঘাটনে কত দূরে; বহুক্ষণ চেয়ে থাকি একা
অপরাহ্ন এল বুঝি? — রাঙা রৌদ্রে মাছরাঙা উড়ে যায় — ডানা ঝিলমিলে;
এক্ষুনি আসিবে সন্ধ্যা, — পৃথিবীতে ম্রিয়মাণ গোধূলি নামিলে
নদীর নরম মুখ দেখা যাবে — মুখে তার দেহে তার কতো মৃদু রেখা
তোমারি মুখের মতো: তবুও তোমার সাথে কোনোদিন হবে নাকো দেখা।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #114

 

– জীবনানন্দ দাশ

ঘুমায়ে পড়িব আমি একদিন তোমাদের নক্ষত্রের রাতে;
তখনো যৌবন প্রাণে লেগে আছে হয়তো বা — আমার তরুণ দিন
তখনো হয়নি শেষ- সেই ভালো — ঘুম আসে-বাংলার তৃণ
আমার বুকের নিচে চোখ বুজে-বাংলার আমের পাতাতে
কাঁচপোকা ঘুমায়েছে — আমিও ঘুমায়ে রবো তাহাদের সাথে,
ঘুমাব প্রাণের সাধে এই মাঠে — এই ঘাসে — কথাভাষাহীন
আমার প্রাণের গল্প ধীরে-ধীরে যাবে-অনেক নবীন
নতুন উৎসব রবে উজানের-জীবনের মধুর আঘাতে

তোমাদের ব্যস্ত মনে; — তবুও, কিশোর, তুমি নখের আঁচড়ে
যখন এ ঘাস ছিঁড়ে চলে যাবে — যখন মানিকমালা ভোরে
লাল-লাল বটফল কামরাঙা কুড়াতে আসিবে এই পথে–
যখন হলুদ বোঁটা শেফালি কোনো এক নরম শরতে
ঝরিয়ে ঘাসের পরে, — শালিখ খঞ্জনা আজ কতো দূরে ওড়ে–
কতোখানি রোদ-মেঘ — টের পাবে শুয়ে শুয়ে মরণের ঘোরে।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #115

 

– জীবনানন্দ দাশ

ঘুমায়ে পড়িব আমি একদিন তোমাদের নক্ষত্রের রাতে
শিয়রে বৈশাখ মেঘ-শাদা-শাদা যেন কড়ি-শঙ্খের পাহাড়
নদীর ওপার থেকে চেয়ে রবে- কোনো এক শঙ্খবালিকার
ধূসর রূপের কথা মনে হবে-এই আম জামের ছায়াতে
কবে যেন তারে আমি দেখিয়াছি-কবে যেন রাখিয়াছে হাতে
তার হাতে- কবে যেন তারপর শ্মশান চিতায় তার হাড়
ঝরে গেছে, কবে যেন; এ জনমে নয় যেন-এই পাড়াগাঁর
পথে তবু তিন শো বছর আগে হয়তো বা- আমি তার সাথে

কাটায়েছি; পাঁচশো বছর আগে হয়তো বা — সাতশো বছর
কেটে গেছে তারপর তোমাদের আম জাম কাঁঠালের দেশে;
ধান কাটা হয়ে গেলে মাঠে-মাঠে কতোবার কুড়ালাম খড়;
বাঁধিলাম ঘর এই শ্যামা আর খঞ্জনার দেশ ভালোবেসে,
ভাসানের গান গুনে কত বার ঘর আর খড় গেল ভেসে
মাথুরের পালা বেঁধে কত বার ফাঁকা হল খর আর ঘর।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #116

 

– জীবনানন্দ দাশ

আমরা যাইনি মরে আজও – তবু কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়:
মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে;
প্রস্তরযুগের সব ঘোড়া যেন – এখনও ঘাসের লোভে চরে
পৃথিবীর কিমাকার ডাইনামোর ‘পরে।

আস্তাবলের ঘ্রাণ ভেসে আসে একভিড় রাত্রির হাওয়ায়;
বিষন্ন খড়ের শব্দ ঝরে পড়ে ইস্পাতের কলে;
চায়ের পেয়ালা ক’টা বেড়ালছানার মতো – ঘুমে-ঘেয়ো
কুকুরের অস্পষ্ট কবলে

হিম হয়ে নড়ে গেল ও – পাশের পাইস্-রেস্তরাঁতে,
প্যারাফিন-লন্ঠন নিভে গেল গোল আস্তাবলে।
সময়ের প্রশান্তির ফুঁয়ে;
এইসব নিওলিথ – স্তব্ধ তার জ্যোৎস্নাকে ছুঁয়ে।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #117

 

– জীবনানন্দ দাশ

ক্লান্ত জনসাধারণ আমি আজ,- চিরকাল;- আমার হৃদয়ে
পৃথিবীর দণ্ডীদের মত পরিমিত ভাষা নেই।
রাত্রিবেলা বহুক্ষণ মোমের আলোর দিকে চেয়ে,
তারপর ভোরবেলা যদি আমি হাত পেতে দিই
সূর্যের আলো দিকে,- তবুও আমার সেই একটি ভাবনা
অতীব সহজ ভাষা খুঁজে নিতে গিয়ে
হৃদয়ঙ্গম করে সব আড়ষ্ট, কঠিন দেবতারা
অপরূপ মদ খেয়ে মুখ মুছে নিয়ে
পুনরায় তুলে নেয় অপূর্ব গেলাস;
উত্তেজিত না-হ’য়েই অনায়াসে ব’লে যায় তারাঃ
হেমন্তের ক্ষেতে কবে হলুদ ফসল ফলেছিলো,
অথবা কোথায় কালো হ্রদ ঘিরে ফুটে আছে সবুজ সিঙাড়া।
রক্তাতিপাতের দেশে ব’সেও তাদের সেই প্রাঞ্জলতায়
দেখে যাই সেই সোনালি ফসল হ্রদ, সিঙাড়ার ছবি;
আমার প্রেমিক সেই জলের কিনারে ঘাসে- দক্ষ প্রজাপতি;
মানুষ-ও-ছাগমুণ্ড কেটে তাকে শুদ্ধ ক’রে দিয়ে যাবে অনাগত সবি,
একদিন হয়তো বা;- আজ সব উত্তমর্ণ দেবতাকে আমার হৃদয়
যে-সব পবিত্র মদ দিয়েছিলো- যে সব মদির
আলোর রঙের মতো ম্লান মদ দিয়ে গিয়েছিলো,-
যখনি চুমুক দিই হ’য়ে থাকি চর্মচক্ষুস্থির!

কাব্যগ্রন্থ – সাতটি তারার তিমির

Bangla Kobita of Jibanananda Das #118

 

– জীবনানন্দ দাশ

চলছি উধাও, বল্গাহারা- ঝড়ের বেগে ছুটে
শিকল কে সে বাঁধছে পায়ে!
কোন্‌ সে ডাকাত ধরছে চেপে টুটি!
-আঁধার আলোর সাগরশেষে
প্রেতের মতো আসছে ভেসে!
আমার দেহের ছায়ার মতো, জড়িয়ে আছে মনের সনে,
যেদিন আমি জেগেছিলাম, সেও জেগেছে আমার মনে!
আমার মনের অন্ধকারে
ত্রিশূলমূলে, দেউলদ্বারে
কাটিয়েছে সে দুরন্ত কাল ব্যর্থ পূজার পুষ্প ঢেলে!
স্বপন তাহার সফল হবে আমায় পেলে, আমায় পেলে!
রাত্রিদিবার জোয়ার স্রোতে
নোঙরছেঁড়া হৃদয় হ’তে
জেগেছে সে হালের নাবিক
চোখের ধাধায় ঝড়ের ঝাঁঝে
মনের মাঝে মানের মাঝে
আমার চুমোর অন্বেষণে
প্রিয়ার মতো আমার মনে
অঙ্কহারা কাল ঘুরেছে কাতর দুটি নয়ন তুলে,
চোখের পাতা ভিজিয়ে তাহার আমার অশ্রুপাথার-কূলে!
ভিজে মাঠের অন্ধকারে কেঁদেছে মোর সাথে
হাতটি রেখে হাতে!
দেখিনি তার মুখখানি তো,
পাইনি তারে টের,
জানি নি হায় আমার বুকে আশেক-অসীমের
জেগে আছে জনমভোরের সূতিকাগার থেকে!
কত নতুন শরাবশালায় নাবনু একে একে!
সরাইখানার দিলপিয়ালায় মাতি
কাটিয়ে দিলাম কত খুশির রাতি!
জীবন-বীণার তারে তারে আগুন-ছড়ি টানি
গুঞ্জরিয়া এল-গেল কত গানের রানি,
নাশপাতি-গাল গালে রাখি কানে কানে করলে কানাকানি
শরাব-নেশায় রাঙিয়ে দিল আঁখি!
-ফুলের ফাগে বেহুঁশ হোলি নাকি!
হঠাৎ কখন স্বপন-ফানুস কোথায় গেল উড়ে!
-জীবন মরু- মরীচিকার পিছে ঘুরে ঘুরে
ঘায়েল হয়ে ফিরল আমার বুকের কেরাভেন-
আকাশ-চরা শ্যেন!
মরুঝড়ের হাহাকারে মৃগতৃষার লাগি
প্রাণ যে তাহার রইল তবু জাগি
ইবলিশেরই সঙ্গে তাহার লড়াই-হল শুরু!
দরাজ বুকে দিল্‌ যে উড়–উড়-!
ধূসর ধু ধু দিগন্তরে হারিয়ে যাওয়া নার্গিসেই শোভা
থরে থরে উঠল ফুটে রঙিন-মনোলোভা!
অলীক আশার, দূর-দুরশার দুয়ার ভাঙার তরে
যৌবন মোর উঠল নেচে রক্তমুঠি, ঝড়ের ঝুঁটির পরে!
পিছে ফেলে টিকে থাকার ফাটকে কারাগারে
ভেঙে শিকল ধ্বসিয়ে ফাঁড়ির দ্বার
চলল সে যে ছুটে!
শৃঙ্খল কে বাধল তাহার পায়ে-
চুলের ঝুটি ধরল কে তার মুঠে!
বর্শা আমার উঠল ক্ষেপে খুনে,
হুমকি আমার উঠল বুকে রুখে!
দুশমন কে পথের সুমুখে
-কোথায় কে বা!
এ কোন মায়া
মোহ এমন কার!
বুকে আমার বাঘের মতো গর্জাল হুঙ্কার!
মনের মাঝের পিছুডাকা উঠল বুঝি হেঁকে-
সে কোন সুদূরে তারার আলোরে থেকে
মাথার পরের খা খা মেঘের পাথারপুরী ছেড়ে
নেমে এল রাত্রিদিবার যাত্রাপথে কে রে!
কী তৃষা তার!
কী নিবেদন!
মাগছে কিসের ভিখ্‌!
উদ্যত পথিক
হঠাৎ কেন যাচ্ছে থেমে-
আজকে হঠাৎ থামতে কেন হয়!
-এই বিজয়ী কার কাছে আজ মাগছে পরাজয়!
পথ- আলেয়ার খেয়ায় ধোঁয়ায় ধ্রুবতারার মতন কাহার আঁখি
আজকে নিল ডাকি
হালভাঙা এই ভুতের জাহাজটারে!
মড়ার খুলি-পাহাড়প্রমাণ হাড়ে
বুকে তাহার জ’মে গেছে কত শ্মশান-বোঝা!
আক্রোশে হা ছুটছিল সে একরোখা, এক সোজা
চুম্বকেরই ধ্বংসগিরির পানে,
নোঙরহারা মাস্তুলেরই টানে!
প্রেতের দলে ঘুরেছিল প্রেমের আসন পাতি,
জানে কি সে বুকের মাঝে আছে তাহার সাথী!
জানে কি সে ভোরের আকাশ, লক্ষ তারার আলো
তাহার মনের দূয়ারপথেই নিরিখ হারালো!
জানি নি সে তোহার ঠোঁটের একটি চুমোর তরে
কোন্‌ দিওয়ানার সারেং কাঁদে
নয়নে নীর ঝরে!
কপোত-ব্যথা ফাটে রে কার অপার গগন ভেদি!
তাহার বুকের সীমার মাঝেই কাঁদছে কয়েদি
কোন্‌ সে অসীম আসি!
লক্ষ সাকীর প্রিয় তাহার বুকের পাশাপাশি
প্রেমের খবর পুছে
কবের থেকে কাঁদতে আছে-
‘পেয়ালা দে রে মুঝে!’

Bangla Kobita of Jibanananda Das #119

 

– জীবনানন্দ দাশ

চলে যাব শুকনো পাতা-ছাওয়া ঘাসে — জামরুল হিজলের বনে;
তলতা বাঁশের ছিপ হাতে রবে — মাছ আমি ধরিব না কিছু; —
দীঘির জলের গন্ধে রূপালি চিতল আর রূপসীর পিছু
জামের গভীর পাতা — মাখা শান — নীল জলে খেলিছে গোপনে;
আনারস ঝোপে ওই মাছরাঙা তার মাছরাঙাটির মনে
অস্পষ্ট আলোয় যেন মুছে যায় — সিঁদুরের মতো রাঙা লিচু
ঝড়ে পড়ে পাতা ঘাসে, — চেয়ে দেখি কিশোরী করেছে মাথা নিচু —
এসেছে সে দুপুরের অবসরে জামরুল লিচু আহরণে —

চলে যায়; নীলাম্বরী সরে যায় কোকিলের পাখনার মতো
ক্ষীরুয়ের শাখা ছুঁয়ে চালতার ডাল ছেড়ে বাঁশের পিছনে
কোনো দূর আকাঙ্খার ক্ষেতে মাঠে চলে যায় যেন অব্যহত,
যদি তার পিছে যাও দেখিবে সে আকন্দের করবীর বনে
ভোমরার ভয়ে ভীরু — বহু ক্ষণ পায়চারি করে আনমনে
তারপর চলে গেল : উড়ে গেল যেন নীল ভোমরার সনে।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #120

 

– জীবনানন্দ দাশ

বেবিলোন কোথা হারায়ে গিয়েছে-মিশর-অসুর কুয়াশাকালো;
চাঁদ জেগে আছে আজও অপলক, মেঘের পালকে ঢালিছে আলো!
সে যে জানে কত পাথারের কথা, কত ভাঙা হাট মাঠের স্মৃতি!
কত যুগ কত যুগান্তরের সে ছিল জোছনা, শুক্লা তিথি!
হয়তো সেদিনও আমাদেরই মতো পিলুবারোয়ার বাঁশিটি নিয়া
ঘাসের ফরাশে বসিত এমনি দূর পরদেশী প্রিয় ও প্রিয়া!
হয়তো তাহারা আমাদেরই মতো মধু-উৎসবে উঠিত মেতে
চাঁদের আলোয় চাঁদমারী জুড়ে, সবুজ চরায়, সবজি ক্ষেত!
হয়তো তাহারা মদঘূর্ণনে নাচিত কাঞ্চীবাধঁন খুলে
এমনি কোন এক চাঁদের আলোয়-মরু ওয়েসিসে তরুর মূলে!
বীর যুবাদল শত্রুর সনে বহুদিনব্যাপী রণের শেষে
এমনি কোন-এক চাঁদিনীবেলায় দাঁড়াত নগরীতোরণে এসে!
কুমারীর ভিড় আসিত ছুটিয়া, প্রণয়ীর গ্রীবা জড়ায়ে নিয়া
হেঁটে যেত তারা জোড়ায় জোড়ায় ছায়াবীথিকার পথটি দিয়া!
তাদের পায়ের আঙুলের ঘায়ে খড়- খড়- পাতা উঠিত বাজি,
তাদের শিয়রে দুলিত জোছনা, চাঁচর-চিকন পত্ররাজি!
দখিনা উঠিত মর্মরি মধুবনাণীর লতা-পল্লব ঘিরে
চপল মেয়েরা উঠিত হাসিয়া-এল-বল্লভ-এল রে ফিরে!’
তুমি ঢুলে যেতে, দশমীর চাঁদ তাহাদের শিরে সারাটি নিশি,
নয়নে তাদের দুলে যেতে তুমি-চাঁদিনী-শরাব, সুরার শিশি!
সেদিনও এমনি মেঘের আসরে জ্বলছে পরীর বাসরবাতি,
হয়তো সেদিনও ফুটেছে মোতিয়া-ঝরেছে চন্দ্রমল্লীপাতি!
হয়তো সেদিনও নেখাখোর মাছি গুমরিয়া গেছে আঙুরবনে,
হয়তো সেদিনও আপেলের ফুল কেপেঁছে আঢুল হাওয়ার সনে!
হয়তো সেদিনও এলাচির বন আতরের শিশি দিয়েছে ঢেলে
হয়তো সেদিনও ডেকেছে পাপিয়া কাঁপিয়া কাঁপিয়া সরোর শাখে,
হয়তো সেদিনও পাড়ার নাগরী ফিরেছে এমনি গাগরি কাঁখে!
হয়তো সেদিনও পানসী দুলায়ে গেছে মাঝি বাকাঁ ঢেউটি বেয়ে,
হয়তো সেদিন মেঘের শকুনডানায় গেছিল আকাশ ছেয়ে!
হয়তো সেদিনও মাণিকজোড়ের মরা পাখাটির ঠিকানা মেগে
অসীম আকাশে ঘুরেছে পাখিনী ছট্‌ফট্‌ দুটি পাখার বেগে!
হয়তো সেদিনও খুর খুর করে খরগোশছানা গিয়েছে ঘুরে
ঘন মেহগিনি টার্পিন তলে- বালির জর্দা বিছানা ফুঁেড়!
হয়তো সেদিনও জানালার নীল জাফরির পাশে একেলা বসি
মনের হরিনী হেরেছে তোমারে-বনের পারের ডাগর শশী!
শুক্লা একাদশীর নিশীথে মণিহর্ম্যের তোরণে গিয়া
পারাবত-দূত পাঠায়ে দিয়েছে প্রিয়ের তরেতে হয়তো প্রিয়ো!
অলিভকুঞ্জে হা হা করে হাওয়া কেঁেদছে কাতর যামিনী ভরি!
ঘাসের শাটিনে আলোর ঝালরে মার্টিল পাতা পড়েছে ঝরি’!
উইলোর বন উঠেছে ফুঁপায়ে-ইউ তরুশাখা গিয়েছে ভেঙে,
তরুনীর দুধ-ধবধবে বুকে সাপিনীর দাঁত উঠেছে রেঙে!
কোন্‌ গ্রীস কোন্‌ কার্থেজ, রোম ক্রবেদুর যুগ কোন,-
চাঁদের আলোয় স্মৃতির কবর শফরে বেড়ায় মন!
জানি না তো কিছু-মনে হয় শুধু এমনি তুহিন চাঁদের নিচে
কত দিকে দিকে-কত কালে কালে হয়ে গেছে কত কী যে!
কত যে শ্মশান-মশান কত যে-কত যে কামনা পিপাস-আশা
অস্তচাঁদের আকাশে বেঁধেছে আরব-উপন্যাসের বাসা!

Bangla Kobita of Jibanananda Das #121

 

– জীবনানন্দ দাশ

চারিদিকে প্রকৃতির ক্ষমতা নিজের মতো ছড়ায়ে রয়েছে।
সূর্য আর সূর্যের বনিতা তপতী
মনে হয় ইহাদের প্রেম
মনে ক’রে নিতে গেলে, চুপে
তিমিরবিদারী রীতি হয়ে এরা আসে
আজ নয়,- কোনো এক আগামী আকাশে।
অন্নের ঋণ,বিমলিন স্মৃতি সব
বন্দ্র বস্তির পথে কোনো এক দিন
নিমেষের রহস্যের মতো ভুলে গিয়ে
নদীর নারীর কথা-আরো প্রদীপ্তির কথা সব
সহসা চকিত হয়ে ভেবে নিতে গেলে বুঝি কেউ
হৃদয়কে ঘিরে রাখে দিতে চায় একা আকাশের
আশেপাশে অহেতুক ভাঙা শাদা মেঘের মতন।
তবুও নারীর নাম ঢের দূরে আজ,
ঢের দূরে মেঘ;
সারাদিন নিলেমেয় কালিমার খারিজের কাজে মিশে থেকে
ছুটি নিতে ভালোবেসে ফেলে যদি মন
ছুটি দিতে চায় না বিবেক।
মাঝে-মাঝে বাহিরের অন্তহীন প্রসারের থেকে
মানুষের চোখে-পড়া-না-পড়া সে কোন স্বভাবের
সুর এসে মানবের প্রাণে
কোন এক মানে পেতে চায়ঃ
যে-পৃথিবী শুভ হতে গিয়ে হেরে গেছে সেই ব্যর্থতার মানে।
চারিদিকে কলকাতা টোকিও দিল্লী মস্কো আতলান্তিকের কলরব,
সরবরাহের ভোর,
অনুপম ভোরাইয়ের গান;
অগণন মানুষের সময় ও রক্তের জোগান
ভাঙে গড়ে ঘর বাড়ি মরুভূমি চাঁদ
রক্ত হাড় বসার বন্দর জেটি ডক;
প্রীতি নেই, পেতে গেলে হৃদয়ের শান্তি স্বর্গের
প্রথম দুয়ারে এসে মুখরিত ক’রে তোলে মোহিনী নরক।
আমাদের এ-পৃথিবীর যতদুর উন্নত হয়েছে
ততদূর মানুষের বিবেক সফল।
সে-চেতনা পিরামিডে পেপিরাসে প্রিন্টিং-প্রেসে ব্যাপ্ত হয়ে
তবুও অধিক আধুনিকতর চরিত্রের বল।
শাদাশাদে মনে হয় সে-সব ফসলঃ
পায়ের চলার পথে দিন আর রাত্রির মতন;-
তবুও এদের গতি স্নিগ্ধ নিয়ন্ত্রিত ক’রে বার বার উত্তর সমাজ
ঈষৎ অনন্যসাধারণ।

কাব্যগ্রন্থ – বেলা অবেলা কালবেলা

Bangla Kobita of Jibanananda Das #122

 

– জীবনানন্দ দাশ

চারিদিকে শান্ত বাতি — ভিজে গন্ধ — মৃদু কলরব;
খেয়ানৌকোগুলো এসে লেগেছে চরের খুব কাছে;
পৃথিবীর এই সব গল্প বেঁচে রবে চিরকাল;-
এশিরিয়া ধুলো আজ — বেবিলন ছাই হয়ে আছে।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #123

 

– জীবনানন্দ দাশ

চিরদিন শহরেই থাকি
পড়ে থাকি পাটের আড়তে
করি কেরানির কাজ—শুভে-লাভে যদি কোনোমতে
দিন যায় চ’লে
আকাশের তলে
নক্ষত্রেরা কয় কোন্‌ কথা
জোৎস্নায় প্রাণের জড়তা
ব্যথা কেন পায়
সে সব খবর নিয়ে কাজ কিবা হায়

বিয়ে হয়েছিল কবে—মরে গেছে বউ
যদিও মহুয়া গাছে ফুটে ওঠে মৌ
একবার ঝরে গেলে তবু তারপর
মহুয়া মহুয়া তবু : কেরানির ঘর
কেরানির ঘর শুধু হায়
জীবনের গল্প শুধু একবার আসে—শুধু একবার নীল কুয়াশায়
নিঃশেষে ফুরায়।

দেবতা ভজি না আমি
তীর্থ করি নাকো
তোমরা ঠাকুর নিয়ে থাকো।
তবু আমি একবার ছুটি পেয়ে বেড়াবার তরে
গেলাম খানিকটা দূর—তারকেশ্বরে
গভীর অসাধ নিয়ে—গাঢ় অনিচ্ছায়
ট্রেনে আমি চড়িলাম হায়
কলরবে ধোঁয়ার ধূলায়
সাধ ক’রে কে বা মিছে যায়

জানি না ঈশ্বর কে বা—জানি শুধু ভুখা ভগবান
দিনগত পাপক্ষয় ক’রে পাব ত্রাণ
তারপর একদিন নিমতলা ঘাটে
কিংবা কাশি মিত্রের তল্লাটে
পড়ে রব
তবুও যখন আমি ঢের রাতে ফিরিলাম ঘর
বুকে জাগে সেই দেশ : তারকেশ্বর
দেবতারে কে খুঁজেছে—সারাদিন ঘুরিয়াছি পথে
অবসন্ন ধুলোর জগতে
অসংখ্য ভিড়ের মাঝে আমি
একখানা মুখ দেখে গিয়েছি যে থামি
সিংহের মূর্তির কাছে তাহারে ফেলেছি দেখে
দেখিয়াছি কবে যেন দেবতার পায়ে তা’রে
এশিরিয়া ব্যাবিলনে আমি
দেখেছি মিশরে
ঈসিসের ঘরে
সারাদিন—দিনমান আজ এই তারকেশ্বরে
আবার তাহার মুখ দেখিলাম, (আহা,)
ধানসিড়ি নদীটির বিকেল বেলার মৌন জলে
বেতের ফলের মতো যেই চোখ, যেই রূপ
ধরা দেয় পৃথিবীর নীরব আঁচলে
দেখিলাম তাহা
আবার তাহার মুখ দেখিলাম, আহা।

কাব্যগ্রন্থ – রুপসী বাংলা

Bangla Kobita of Jibanananda Das #124

 

– জীবনানন্দ দাশ

শতাব্দীর এই ধূসর পথে এরা ওরা যে যার প্রতিহারী।
আলো অন্ধকারের ক্ষণে যে যার মনে সময়সাগরের
ক্লান্তিবিহীন শব্দ শোনে;
অথবা তা নাড়ীর রক্তস্রোতের মতন ধ্বনি
না শুনে শোনা যায়।

সময় গতির শব্দময়তাকে তবু ধীরে ধীরে যথাস্থানে রেখে
ট্রামের রোলে আরেক ভোরের সাড়া পেয়ে কেউ বা এখন শিশু,
কেউ বা যুবা, নটী, নাগর, দক্ষ-কন্যা, অজের মুণ্ড, অখল
পোলিটিশ্যান্‌
এদের হাতেই দিনের আলো নিজের সার্থকতা
খুঁজে বেড়ায়।

চারিদিকেতে শিশুরা সব অন্ধ এঁদো গলির অপার পরলোকে আজ
জগৎ-শিশুর প্রাণের আকাশ ভেবে
জানে না কবে নীলিমাকে হারিয়ে ফেলেছে।
শিশু-অমঙ্গলের সকল জনিতারা এই পৃথিবীর সকল নগরীর
আবছায়াতে ক্লান্ত-কলকাকলীর প্রেতের পরিভাষা
ছড়িয়ে কবে ফুরিয়ে আবার সহজ মানব-কণ্ঠে কথা ক’বে?
আকাশমর্ত্যে মহাজাতক সূর্য-গ্রহণ ছাড়া
কোথাও কোনো তিলেক বেশি আলো
রয়েছে জানে না কি?
তবুও সবাই তারা
অন্ধকারের ভিতর থেকে ক্রমে ক্রমে যার হয়ে কি আসছে আরো
বিশাল আলোতে?

কোথায় ট্রাম উধাও হয়ে চ’লেছে আলোকে।
কয়লা গ্যাসের নিরেস ঘ্রাণ ছড়িয়ে আলোকে
কোথায় এত বিমূঢ় প্রাণজন্তু নিয়ে অনন্ত বাস্‌, কার্‌,
এমন দ্রুত আবেগে চলেছে!
কোথাও দূরে দেবাত্মা পাহাড় রয়েছে কি?
ইতিহাসের ধারণাতীত সাগর নীলিমা?
চেনা জানা নকল আলোর আকাশ ছেড়ে সহজ সূর্য আছে।
নব নবীন নগর মেশিন প্রাণের বন্দর-
জলের বীথি আকাশী নীল রৌদ্রকণ্ঠী পাখি?
সেখানে প্রেমের বিচারসহ চোখের আলোয় গোলকধাঁধার থেকে
মুখ মানুষ নতুন সূর্য তারার পথের জ্যোতিধূর্লি-ধূসর হাসি দেখে
কি দীন, সহৃদয়?
জ্ঞান সেখানে অফুরন্ত প্যারাগ্রাফে ক্লান্তিহীন শব্দ যোজনায়
কিছুই নেই প্রমাণ করে শূন্যতাকে কুড়ায় নাক’ তবে?

পরস্পরের দাবির কাছে
অন্তরঙ্গ আত্মনিবেদনে
নবীন ‘রে পরিচিত হওয়ার পরে নতুন পৃথিবী
রয়েছে জেনে আজকে ওরা চলার পথে ইতিহাসের চরম চেতনা;-
মানব নামের কঠিন হিসাব হয়তো মেলাতেছে
কী এক নতুন জ্যোতির্দেশী সমাজ সময় শান্তি গড়ার নীল সাগরের তীরে।

চোখে যাদের চলতে দেখি তারা অনেক দেরী করে অনাথ মরু সাগর ঘুরে চলে;
মনের প্রয়াণ মোড় ঘুরে কি দেখেছে সরণি-
সাহস আলো প্রাণ যেখানে সবার তরে শুভ-
এই পৃথিবী ঘরণী।

Bangla Kobita of Jibanananda Das #125

 

– জীবনানন্দ দাশ

দুপুর রাতে ও কার আওয়াজ
গান কে গাহে, গান না!
কপোতবধূ ঘুমিয়ে আছে
নিঝুম ঝিঁঝির বুকের কাছে;
অস্তচাঁদের আলোর তলে
এ কার তবে কান্না!
গান কে গাহে, গান না!
সার্সি ঘরের উঠছে বেজে
উঠছে কেঁপে পর্দা!
বাতাস আজি ঘুমিয়ে আছে
জল-ডাহুরের বুকের কাছে;
এ কোন্‌ বাঁশি সার্সি বাজায়
এ কোন হাওয়া ফর্দা
দেয় কাঁপিয়ে পর্দা!
নূপুর কাহার বাজল রে ঐ!
কাঁকন কাহার কাঁদল
পুরের বধু ঘুমিয়ে আছে
দুধের শিশুর বুকের কাছে;
ঘরে আমার ছায়া-প্রিয়া
মায়ার মিলন ফাঁদল
কাঁকন যে তার কাঁদল!
খসখসাল শাড়ি কাহার!
উস্‌খুসাল চুল গো!
পুরের বধু ঘুমিয়ে আছে
দুধের শিশুর বুকের কাছে:
জুল্‌পি কাহার উঠল দুলে!
দুলল কাহার দুল গো!
উস্‌খুসাল চুল গো!
কাঁদছে পাখি পউষনিশির
তেপান্তরের বক্ষে!
ওর বিধবা বুকের মাঝে
যে গো কার কাঁদন বাজে!
ঘুম নাহি আজ চাঁদের চোখে,
নিদ্‌ নাহি মোর চক্ষে!
তেপান্তরের বক্ষে!
এল আমার ছায়া-প্রিয়া,
কিশোরবেলার সই গো!
পুরের বধূ ঘুমিয়ে আছে
দুধের শিশুর বুকের কাছে;
মনের মধূ-মনোরমা-
কই গো সে মোর কই গো!
কিশোরবেলার সই গো!
ও কার আওয়াজ হাওয়ায় বাজে!
গান কে গাহে, গান না!
কপোতবধূ ঘুমিয়ে আছে
বনের ছায়ায়-মাঠের কাছে;
অস্তচাঁদের আলোর তলে
এ কার তবে কান্না!
গান কে গাহে, গান না!