সুকুমার রায়

220px-Sukumar_Ray

Bangla Kobita of Sukumar Ray #1

 

– সুকুমার রায়

পর্ব ১

ছিল এ ভারতে এমন দিন
মানুষের মন ছিল স্বাধীন ;
সহজ উদার সরল প্রাণে
বিস্ময়ে চাহিত জগত পানে।
আকাশে তখন তারকা চলে,
নদী যায় ভেসে, সাগর টলে,
বাতাস ছুটিছে আপন কাজে,
পৃথিবী সাজিছে নানান সাজে ;
ফুলে ফলে ছয় ঋতুর খেলা,
কত রূপ কত রঙের মেলা;
মুখরিত বন পাখির গানে,
অটঁল পাহাড় মগন ধ্যানে;
নীলকাশে গন মেঘের ঘটাঁ,
তাহে ইন্দ্রধনু বিজলী ছঁটা,
তাহে বারিধারা পড়িছে ঝরি-
দেখিত মানুষ নয়ন ভরি।
কোথায় চলেছে কিসের টানে
কোথা হতে আসে, কেহ না জানে।
ভাবিত মানব দিবস-যামী,
ইহারি মাঝারে জাগিয়া আমি,
কিছু নাহি বুঝি কিছু নাহি জানি,
দেখি দেখি আর অবাক মানি।
কেন চলি ফিরি কিসের লাগি
কখন ঘুমাই কখন জাগি,
কত কান্না হাসি দুখে ও সুখে
ক্ষুধা তৃষ্ণা কত বাজিছে বুকে।
জন্ম লভি জীব জীবন ধরে,
কোথায় মিলায় মরণ পরে?
ভবিতে ভাবিতে আকুল প্রাণে
ডুবিত মানব গভীর ধ্যানে।
অকূল রহস্য তিমিরতলে,
জ্ঞানজ্যোতিময় প্রদীপ জ্বলে,
সমাহিত চিতে যতন করি
অচঞ্চল শিখা সে আলো ধরি
দিব্য জ্ঞানময় নয়ন লভি,
হেরিল নতুন জগত ছবি।
অনাদি নিয়মে অনাদি স্রোতে
ভাসিয়া চলেছে অকুল পথে
প্রতি ধুলিকণা নিখিল টানে
এক হতে ধায় একেরি পানে,
চলেছে একেরি শাসন মানি,
লোকে লোকান্তরে একেরি বাণী
এক সে অমৃতে হয়েছে হারা
নিখিল জীবন-মরণ ধারা।
সে অমৃতজ্যোতি আকাশ ঘেরি,
অন্তরে বাহিরে অমৃত হেরি।
যাঁহা হতে জীব জনম লভে,
যাহা হতে ধরে জীবন সবে,
যাহার মাঝারে মরণ পরে
ফিরি পুন সবে প্রবেশ করে,
তাহার জানিবে যতন ধরি।
তিনি ব্রহ্ম তারে প্রনাম করি।
আনন্দেতে জীব জনম লভে
আনন্দে জীবিত রয়েছে সবে;
আনন্দে বিরাম লভিয়া প্রাণ
আনন্দের মাঝে করে প্রয়াণ।
শুন বিশ্বলোক শুনহ বাণী
অমৃতের পুত্র সকল প্রাণী,
দিব্যধামিবাসী শুনহ সবে-
জেনেছি তাহারে, যিনি এ ভবে
মহান পুরুষ নিখিল গতি,
তমসার পরে পরম জ্যোতি :
তেজোময় রূপে হেরিয়া তাঁরে
স্তব্ধ হয় মন, বচন হারে।
বামে ও দখিনে উপরে নীচে,
ভিতরে বাহিরে সমুখে পিছে,
কিবা জলেস্থলে আকাশ পরে
আধারে আলোকে চেতনে জড়ে:
আমার মাঝারে আমারে ঘেরি
এক ব্রহ্মময় প্রকাশ হেরি।
সে আলোকে চাহি আপন পানে
আপনারে মন স্বরূপ জানে।
আমি আমি করি দিবস- যামী,
না জানি কেমন কোথা সে আমি
অজর অমর অরূপ রূপ
নহি আমি এই জড়ের স্তুপ
দেহ নহে মোর চির-নিবাস
দেহের বিনাশে নাহি বিনাশ।
বিশ্ব আত্মা মাঝে হয়ে মগন
আপন স্বরূপ হেরিলে মন
না থাকে সন্দেহ না থাকে ভয়
শোক তাপ মোহে নিমেষে লয়,
জীবনে মরণে না রহে ছেদ,
ইহা পরলোকে না রহে ভেদ।
ব্রহ্মানন্দময় পরম ধাম,
হেথা আসি সবে লভে বিরাম;
পরম সম্পদ পরম গতি,
লভ তাঁরে জীব যতনে অতি।

পর্ব ২

কালচক্রে হায় এমন দেশে
ঘোর দুঃখদিন আসিল শেষে।
দশদিকে হতে আঁধার আসি
ভারত আকাশ ফেলিল গ্রাসি।
কোথা সে প্রাচীন জ্ঞানের জ্যোতি,
সত্য অন্বেষণে গভীর মতি ;
কোথা ব্রহ্মজ্ঞান সাধন ধন,
কোথা ঋষিগণ ধ্যানে মগন;
কোথা ব্রহ্মচারী তাপস যত,
কোথা সে ব্রাহ্মণ সাধনা রত?
একে একে সবে মিলাল কোথা,
আর নাহি শুনি প্রাচীন কথা।
মহামূল্য নিধি ঠেলিয়া পায়
হেলায় মানুষ হারাল তায়।
আপন স্বরূপ ভুলিয়া মন
ক্ষুদ্রের সাধনে হল মগন।
ক্ষুদ্র চিন্তা মাঝে নিয়ত মজি,
ক্ষুদ্র স্বার্থ-সুখ জীবনে ভাজি;
ক্ষুদ্র তৃপ্তি লয়ে মূঢ়ের মত
ক্ষুদ্রের সেবায় হইল রত।
রচি নব নব বিধি-বিধান
নিগড়ে বাঁধিল মানব প্রাণ;
সহস্র নিয়ম নিষেধ শত ;
তাহে বদ্ধ নর জড়ের মত ;
লিখি দাসখত ললাটে তার
রুদ্ধ করি দিল মনের দ্বার।
জ্বলন্ত যাঁহার প্রকাশ ভাবে-
হায়রে তাঁহারে ভুলিল সবে;
কল্পনার পিছে ধাইল মন,
কল্পিত দেবতা হল সৃজন,
কল্পিত রূপের মূরতি গড়ি,
মিথ্যা পূজাচার রচন করি,
ব্যাখ্যা করি তার মহিমা শত,
মিথ্যা শাস্ত্রবাণী রচিল কত।
তাহে তৃপ্ত হয়ে অবোধ নরে
রহে উদাসীন মোহের ভরে।
না জাগে জিজ্ঞাসা অলস মনে,
দেখিয়া না দেখে পরম ধনে।
ব্রাহ্মণেরে লোকে দেবতা মানি
নির্বিচারে শুনে তাহারি বাণী।
পিতৃপুরুষের প্রসাদ বরে
বসি উচ্চাসনে গরব ভরে
পূজা-উপচার নিয়ত লভি
ভুলিল ব্রাহ্মণ নিজ পদবী।
কিসে নিত্যকালে এ ভারতভাবে
আপন শাসন অঁটুট রবে-
এই চিন্তা সদা করি বিচার
হল স্বার্থপর হৃদয় তার।
ভেদবুদ্ধিময় মানব মন
নব নব ভেদ করে সৃজন।
জাতিরে ভাঙিয়া শতধা করে,
তাহার উপরে সমাজ গড়ে;
নানা বর্ণ নানা শ্রেণীবিচার ,
নানা কুটবিধি হল প্রচার।
ভেদ বুদ্ধি কত জীবন মাঝে
অশনে বসেন সকল কাজে,
ধর্ম অধিকারে বিচার ভেদ
মানুষে মানুষে করে প্রভেদ।
ভেদ জনে জনে, নারী ও নরে,
জাতিতে জাতিতে বিচার ঘরে।
মিথ্যা অহংকারে মোহের বশে
জাতির একতা বাঁধন খসে:
হয়ে আত্মঘাতী ভারতভবে
আপন কল্যণ ভুলিল সবে।

পর্ব ৩

এখনও গভীর তমসা রাতি,
ভারত ভবনে নিভিছে বাতি –
মানুষ না দেখি ভারতভূমে,
সবাই মগন গভীর ঘুমে।
কত জাতি আজ হেলার ভরে
হেথায় আসিয়া বসতি করে।
ভারতের বুকে নিশান গাথি
বসেছে সবলে আসন পাতি।
নিজ ধনমান নিজ বিভব
বিদেশীর হাতে সঁপিয়া সব,
ভারতের মুখে না ফুটে বাণী,
মৌন রহে দেশ শরম মানি।
– হেনকালে শুন ভেদি আঁধার
সুগম্ভীর বানী উঠিল কার-
“ভাব সেই এক ভাবহ তারে,
জলে স্থলে শুন্যে হেরিছ যারে
নিয়ত যাহার স্বরূপ ধ্যানে
দিব্য জ্ঞান জাগে মানব প্রাণে।
ছাড় তুচ্ছ পূজা জড় সাধন,
মিথ্যা দেবসেবা ছাড়া এখন,
বেদান্তের বাণী স্মরণ কর,
ব্রহ্মজ্ঞান-শিখা হৃদয়ে ধর
সত্য মিথ্যা দেখে করি বিচার
খুলি দাও যত মনের দ্বার ।
মানুষের মত স্বাধীন প্রাণ
নির্ভয়ে তাকাও জগত পানে-
দিকে দিকে দেখ ঘুচিছে রাতি,
দিকে দিকে জাগে কত না জাতি;
দিকে দিকে লোক সাধনারত
জ্ঞানের ভান্ডার খুলেছে কত।
নাহি কি তোমার জ্ঞানের খনি ?
বেদান্ত রতন মুকুটমণি?
অসারে মজে কি ভুলেছ তুমি-
ধর্মে গরীয়ান ভারতভুমি?”
-শুনি মৃতদেশ পরান পায়,
বিস্ময়ে মানুষ ফিরিয়া চায়।
দেখে দিব্যরূপ পুরুষ বরে
কান্তি তেজোময় নয়ন হরে,
গবল শরীর সুঠাম অতি,
ললাট প্রসর, নয়নে জ্যোতি,
গম্ভীর স্বভাব,বচন ধীর,
সত্যের সংগ্রামে অজেয় বীর;
অতুল প্রখর প্রতিভা ধরে
নানা শাস্ত্র ভাষা বিচার করে।
রামমোহনের১ জীবন স্মরি,
কৃতজ্ঞতা ভরে প্রনাম করি।
দেশের দুর্গতি সকলখানে
হেরিয়া বাজিল রাজার প্রাণে ।
কত অসহায় অবোধ নারী
সতীত্বের নামে সকল ছাড়ি,
কেহ স্ব-ইচছায়, কেহবা ভয়ে,
শাসনে তাড়নে পিষিত হয়ে,
পতির চিতায় পুড়িয়া মরে-
শুনি কাদে প্রাণ তাদের তরে ।
নারীদুঃখ নাশ করিল পণ,
ঘুচিল নারীর সহমরণ ।
নিষ্কামকরম- যোগীর মত
দেশের কল্যাণ সাধনে রত,
নানা শাস্ত্রবাণী করে চয়ন,
দেশ দেশান্তের ঋষিবচন;
পশ্চিমের নব জ্ঞানের বাণী
দেশের সমুখে ধরিল আনি।
কিরূপেতে পুন এ ভারতভবে
ব্রহ্মজ্ঞান কথা প্রচার হবে ,
নিয়ত যতন তাহারি তরে,
কত শ্রম কত প্রয়াস করে ;
তর্ক আলোচনা কত বিচার
কত গ্রন্থ রচি’ করে প্রচার;
-ক্রমে বিনাশিতে জড় ধরম
‘ব্রহ্ম সমাজে’র হল জনম ।
শুনে দেশবাসি নুতন কথা,
মূরতিবিহীন পুজার প্রথা
উপাসনা -গৃহ দেখে নতুন-
যেথায় স্বদেশী বিদেশী জন
শুদ্র দ্বিজ আদি মিলিয়া সবে
নির্বিচারে সদা আসন লাভে।
মহাপুরুষের বিপুল শ্রমে
দেশে যুগান্তর আসিল ক্রমে।
স্বদেশের তার আকুল প্রাণ
প্রবাসেতে রাজা করে প্রয়ান;
সেথায় সুদুর বিলাতে হায়
অকালেতে রাজা ত্যজিল কায়।
অসমাপ্ত কাজ রহিল পড়ে,
ফিরে যায় লোকে নিরাশা ভরে;
একে একে সব যেতেছে চলে-
ভাসে রামচন্দ্র২ নয়নজলে।
রাজার জীবন নিয়ত স্মরি’
উপাসনা গৃহে রহে সে পড়ি,
নিয়ম ধরিয়া পূজার কালে
নিষ্ঠাভাবে সেথা প্রদীপ জ্বালে।
একা বসি ভাবে রাজার কাজ
এমন দুর্দিনে কে লবে আজ।

পর্ব ৪

ধনী যুবা এক শ্মশান ঘাটে
একা বসি তার রজনী কাটে।
অদূরে অন্তিম শয়নোপরি
দিদিমা তাহার আছেন পড়ি,
সম্মুখে পূর্ণিমা গগনতলে
পিছনে শ্মশানে আগুন জ্বলে,
তাহারি মাঝারে নদীর তীরে
হরিনাম ধ্বনি উঠিছে ধীরে।
একাকী যুবক বসিয়া কুলে
সহসা কি ভাবি আপনা ভুলে।
প্রসন্ন আকাশ চাঁদিম রাতি
ধরিল অপূর্ব নতুন ভাতি,
তুচ্ছ বোধ হল ধন – বিভব
বিলাস বাসনা অসার সব,
অজানা কি যেন সহসা স্মরি
পলকে পরান উঠিল ভরি।
আর কি সে মন বিরাম মানে?
গভীর পিপাসা জাগিল প্রাণে।
কোথা শান্তি পাবে ব্যাকুল তৃষা
শুধায় সবারে না পায় দিশা।
-সহসা একদা তাহার ঘরে
ছিন্নপত্র এক উড়িয়া পড়ে ;
কি যেন বচন লিখিত তায়
অর্থ তার যুবা ভাবি না পায়।
বিদ্যাবাগীশের নিকটে তবে
যুবা সে বাণীর মরম লভে-
“যাহা কিছু এই জগততলে
অনিত্যের স্রোতে ভাসিয়া চলে
রহ্মে আচ্ছাদিত জানিবে তায়-”
শুনিয়া যুবক প্রবোধ পায়।
শুনি মহাবাণী চমক লাগে,
আরো জানিব রে বাসনা জাগে
ব্রহ্মজ্ঞান লাভে পিপাসু মন
গভীর সাধনে হল মগন:
যত ডোবে আরো ডুবিতে চায়
ডুবি নব নব রতন পায়া।
হেনকালে হল অশনিপাত
যুবকের পিতা দ্বারকানাথ,
অতুল সম্পদ ধন বিভব
ঋণের পাথারে ডুবায়ে সব
কিছু না বুঝিতে জানিতে কেহ
অকালে সহসা ত্যজিল দেহ।
আত্মীয় -স্বজন কহিল সবে,
“যে উপায়ে হোক বাঁচিতে হবে-
কর অস্বীকার ঋণের দায়
নহিলে তোমার সকলি যায়।”
নাহি টলে তায় যুবার মন,
পিতৃঋণ শোধ করিল পণ,
হয়ে সর্বত্যাগী ফকির দীন
ছাড়ি দিল সব শোধিতে ঋণ।
উত্তমর্ণজনে অবাক মানি
কহে শ্রদ্ধাভারে অভয় বাণী,
“বিষয় বিভব থাকুক তব,
মোরা তাহা হতে কিছু না লব।
সাধুতা তোমার তুলনাহীন;
সাধ্যমত তুমি শোধিও ঋণ।”
বরষের পর বরষ যায়,
যুবক এখন প্রবীণ -প্রায়।
সংসারে বাসনা -বিগত মন,
ঋষি কল্পরুপ ধ্যানে মগ্ন,
ব্রহ্ম-ধ্যান -জ্ঞানে পুরিত প্রান ,
ব্রহ্মানন্দ রস করিছে পান;
বচনেতে যেন অমৃত ঝরে-
নমি নমি তাঁরে ভকতি ভরে।
ব্রাহ্মসমাজে আসন হতে
দীপ্ত অগ্নিয় বচন স্রোতে
ব্রহ্মজ্ঞান ধারা বহিয়া যায়,
কত শত লোকে শুনিতে ধায়।
“ব্রহ্মে কর প্রীতি নিয়ত সবে,
প্রিয়কার্য় তাঁর সাধহ ভবে।
হের তারে নিজ হৃদয় মাঝে,
সেথা ব্রজ্যেতি নিয়ত রাজে।
জ্ঞান সমুজ্জল বিমল প্রাণে ,
যে জানে তাহারে ধ্রুব সে জানে ।
জানিবার পথ নাহিক আর,
নহে শাসত্র বাণী প্রমান তাঁর ।
বহু তর্ক বহু বিচার বলে
বহু জপ তপ সাধন ফলে
বহু তত্ত্বকথা আলোড়ি চিতে
নাহি পায় সেই বচনাতীতে।”
ব্রহ্ম সমাজের অসাড় প্রাণে ,
মহর্ষির৩ বানী চেতনা আনে।
দলে দলে লোক সেথায় ছোটে
ঊৎসাহের স্রোতে আসিয়া জোটে।
মত্ত অনুরাগে কেশব৪ ধায়,
প্রতিভার জ্যোতি নয়নে ভায়;
আকুল আগ্রহে পরান খুলি
ঝাঁপ দিল স্রোতে আপনা ভুলি।
হেরি মহর্ষির পুলক বাড়ে
“ব্রহ্মনন্দ” নাম দিলেন তারে ।
লভি নব প্রানে সমাজ কায়
নব নব ভাবে বিকাশ পায় ;
ধর্ম গ্রন্থ নব,নব সাধন,
ব্রহ্ম উপাসনা বিধি নূতন
ধর্মপ্রান কত নারী ও নরে
তাহে নিমগন পুলক ভরে ।

পর্ব ৫

সমাজে সুদিন এল আবার,
ক্রমে প্রসারিল জীবন তার।
কেশব আপন প্রতিভা বলে
যতনে গঠিল যুবকদলে।
নগরে নগরে হল প্রচার-
“ধর্ম রাজ্যে নাহি জাতিবিচার;
নাহি ভেদ হেথা নারী ও নরে,
ভক্তি আছে যার সে যায় ত’রে।
জাতিবর্ণ- ভেদ কুরীতি যত
ভাঙি দাও চিরদিনের মত।
দেশ দেশান্তরে ধাঊক মন,
সর্বধর্মবাণী কর চয়ন;
ধর্মে ধর্মে নাহি বিরোধ রবে,
মহা সমম্বয় গঠিত হবে।”
পশিল সে বাণী দেশের প্রাণে,
মুগ্ধ নরনারী অবাক মানে ।
নগরে নগরে তুফান উঠে,
ঘরে ঘরে কত বাঁধন টুটে;
ব্রহ্ম নামে সবে ছুটিয়া চলে,
প্রাণ হতে প্রাণে আগুন জ্বলে।
আসিল গোঁসাই৫ ব্যাকুল হয়ে
প্রেমে ভরপূর ভকতি লয়ে।
আসিল প্রতাপ৬ স্বভাব ধীর,
গম্ভীর বচন জ্ঞানে গভীর।
স্বল্পভাষী সাধু অঘোরনাথ৭
যোগমগ্ন মন দিবসরাত।
গৌরগোবিন্দের৮ সাধক প্রাণ
হিন্দুশাস্ত্রে তাঁর অতুল জ্ঞান।
কান্তিচন্দ্র৯ সদা সেবায় রত
সেবাধর্ম তাঁর জীবন-ব্রত।
ত্রৈলোক্যনাথের১০ সরস গান
নব নব ভাবে মাতায় প্রাণ।
আরো কত সাধু ধরমমতি
বঙ্গচন্দ্র১১ আদি প্রচার-ব্রতী
একসাথে মিলি প্রেমের ভরে
প্রেমপরিবার গঠন করে।
কাল কিবা খাবে কেহ না জানে,
আকুল উৎসাহ সবার প্রাণে ।
নূতন মন্দির নব সমাজ
নব ভাবে কত নূতন কাজ।
দিনে দিনে নব প্রেরণা পায়,
উৎসাহের স্রোত বাড়িয়া যায়।
সমাজ-চালনা বিধি-বিচার
কেশবের হাতে সকল ভার;
কেশবপ্রেরণা সবার মূলে
তাঁর নামে সবে আপনা ভুলে।
ধন্য ব্রহ্মানন্দ যাঁহার বাণী
শিরে ধরে লোকে প্রমাণ মানি।
যাঁহার সাধনা আজিও হেরি
রয়েছে সমাজ জীবন ঘেরি ;
যাঁহার মূরতি স্মরণ করি,
যাঁহার জীবন হৃদয়ে ধরি,
শত শত লোক প্রেরণা পায়-
আজি ভক্তিভরে প্রণমি তাঁয়।
আবার বহিল নূতন ধারা,
সমাজের প্রাণে বাজিল সাড়া;
ভাসি বহুজনে সে নব স্রোতে
বাহির হাইল নূতন পথে।
মিলি অনুরাগে যতন ভরে
এই “সাধারণ” সমাজ গড়ে।
ওদিকে কেশব নূতন বলে
বাঁধিল আবার আপন দলে।
নব ভাবে “নববিধান” গড়ি,
নূতন সংহিতা রচনা করি,
ভগ্নদেহ লয়ে অবশপ্রায়,
খাটিতে খাটিতে ত্যজিল কায়।

পর্ব ৬

ধরি নব পথ নূতন ধারা
নবীন প্রেরণে আসিল যারা,
আজি তাঁহাদের চরণ ধরি
ভক্তিভরে সবে স্মরণ করি।
শাস্ত্রী শবনাথ সকল ফেলি
বিষয় বাসনা চরণে ঠেলি
বহু নির্যাতন বহিয়া শিরে,
অনুরাগে ভাসি নয়ন নীরে,
সর্বত্যাগী হয়ে ব্যাকুল প্রাণে
ছুটে আসে ওই কিসের টানে,
দেখ ওই চলে পাগলমত
ভক্তশ্রেষ্ট বীর বিনয়নত,
বিজয় গোঁসাই সরল প্রাণ-
হেরি আজি তাঁই প্রেম বয়ান।
সাধু রামতনু১২ জ্ঞানে প্রবীণ,
শিশুর মতন চির নবীন।
শিবচন্দ্র দেব সুধীর মন,
কর্মনিষ্ঠাময় সাধু জীবন ।
নগেন্দ্রনাথের১৩ যুকতি বানে
কূট তর্ক যত নিমেষে হানে ।
আনন্দমোহন১৪ মুরতি যার।
উমেশচন্দ্রের১৫ জীবণ মন ,
নীরব সাধনে সদা মগন।
দুর্গামোহনের১৬ জীবনগত
সমাজের সেবা দানের ব্রত।
দ্বারকানাথের১৭ স্মরন হয়
ন্যায়ধর্মে বীর অকুতোভয় ।
পূর্ব বঙ্গে হোথা সাধক কত
নবধর্ম বানী প্রচারে কত।
সংসারে নিলিপ্ত ভাবুক প্রাণ
স্বার্থক প্রচারে কালীনারা’ণ১৮
কত নাম কব কত যে জ্ঞানী
কত ভক্ত সাধু যোগী ও ধ্যানী;
কত মধুময় প্রেমিক মন
আড়ম্বহীন সেবকজন ;
আসিল হেথায় আকাশ ভরে
সবার যতনে সমাজ গড়ে।
এই যে মন্দির হেরিছ যার
ইটকাঠ ময় স্থুল আকার ;
ইহারি মাঝারে কত যেস্মৃতি,
কত আকিঞ্চন সমাজ প্রীতি,
ব্যাকুল ভাবনা দিবস রাত
বিনিদ্র সাধনে জীবন পাত ।
বহু কর্মময় এই সমাজ
সে সব কাহিনী না কব আজ,
আজিকে কেবল স্মরণে আনি
ব্রাহ্মসমাজের মহান বাণী ।
যে বাণী শুনুনু রাজার মুখে,
মহর্ষি যাহারে ধরিল বুকে,
কেশব যে বাণী প্রচার কারে-
স্মরি আজ তাহা ভকতি ভরে।
রক্তাক্ষরে লিখা যে বাণী রটে
এই সমাজের জীবনপটে-
“স্বাধীন মানবহৃদয়তলে
বিবেকের শিখা নিয়ত জ্বলে।
গুরুর আদেশ সাধুর বাণী
ইহার উপরে কারে না মানি?”
স্বাধীন মানে এই সমাজ
মুক্ত ধর্মলাভে ইহার কাজ।
হেথায় সকল বিরোধ গুচি
রবে নানা মত নানান্ রুচি
কাহারো রচিত বিধি বিধান
রুধিবে না হেথা কাহারো প্রাণ।
প্রতি জীবনের বিবেক ভাতি
সবার জীবনে জ্বলিবে বাতি।
নর নারী হেথা মিলিয়া সবে
সম অধিকারে আসন লাভে।
প্রেমেতে বিশাল জ্ঞানে গভীর
চরিত্রে সংযত করমে বীর ;
ঈশ্বরে ভক্তি মানবে প্রীতি,
হেথা মানুষের জীবন নীতি।
ফুরাল কি সব হেথায় আসি ?
আসিবে না প্রেম জড়তা নাশি?
জাগিবে না প্রাণ ব্যাকুল হয়ে,
নব নব বাণী জীবনে লয়ে ?
জ্বলিবে না নব সাধন শিখা ?
নব ইতিহাস হবে না লিখা ?
চিররুদ্ধ রবে পুজার দ্বার ?
আসিবে না নব পুজারী আর ?
কোথাও আশার আলো কি নাহি ?
শুধাই সবার বদন চাহি।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #2

 

– সুকুমার রায়

গভীর কালো মেঘের পরে রঙিন ধনু বাঁকা,
রঙের তুলি বুলিয়ে মেঘে খিলান যেন আঁকা!
সবুজ ঘাসে রোদের পাশে আলোর কেরামতি
রঙিন্ বেশে রঙিন্ ফুলে রঙিন্ প্রজাপতি!

অন্ধ মেয়ে দেখছে না তা – নাইবা যদি দেখে-
শীতল মিঠা বাদল হাওয়া যায় যে তারে ডেকে!
শুনছে সে যে পাখির ডাকে হরয কোলাকুলি
মিষ্ট ঘাসের গন্ধে তারও প্রাণ গিয়েছে ভুলি!
দুঃখ সুখের ছন্দে ভরা জগৎ তারও আছে,
তারও আঁধার জগৎখানি মধুর তারি কাছে।।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #3

 

– সুকুমার রায়

শুন্‌ছ দাদা! ঐ যে হোথায় বদ্যি বুড়ো থাকে,
সে নাকি রোজ খাবার সময় হাত দিয়ে ভাত মাখে?
শুন্‌ছি নাকি খিদেও পায় সারাদিন না খেলে?
চক্ষু নাকি আপনি বোজে ঘুমটি তেমন পেলে?

চল্‌তে গেলে ঠ্যাং নাকি তার ভূয়েঁর পরে ঠেকে?
কান দিয়ে সব শোনে নাকি? চোখ দিয়ে সব দেখে?
শোয় নাকি সে মুণ্ডটাকে শিয়র পানে দিয়ে?
হয় না কি হয় সত্যি মিথ্যা চল্‌ না দেখি গিয়ে!

Bangla Kobita of Sukumar Ray #4

 

– সুকুমার রায়

চুপ করে থাক্, তর্ক করার বদভ্যাসটি ভাল না,
এক্কেবারেই হয় না ওতে বুদ্ধিশক্তির চালনা।
দেখ্ ত দেখি আজও আমার মনের তেজটি নেভেনি-
এইবার শোন বলছি এখন- কি বলছিলাম ভেবেনি!
বলছিলাম কি, আমি একটা বই লিখেছি কবিতার,
উচু রকম পদ্যে লেখা আগাগোড়াই সবি তার ।
তাইতে আছে ‘দশমুখে চায়, হ জম করে দশোদর,
শ্মশানঘাটে শষপানি খায় শশব্যস্ত শশধর।’
এই কথাটার অর্থ যে কি ,ভাবছে না কেউ মোটেও-
বুঝছে না কেউ লাভ হবে কি, অর্থ যদি জোটেও।
এরই মধ্যে হাই তুলিস যে? পুতে ফেলব এখনি,
ঘুঘু দেখেই নাচতে শুরু, ফাঁদ ত বাবা দেখনি!
কি বললি তুই? সাতান্নবার শুনেছিস্ ঐ কথাটা?
এমন মিথ্যা কইতে পারিস্ লক্ষ্মীছাড়া বখাটা!
আমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাধ্যি নেই কো পেরোবার
হিসেব দেব বলেছি এই চোদ্দবার কি তেরোবার।
সাতান্ন তুই গুনতে পারিস? মিথ্যেবাদী! গুনে যা-
ও শ্যামাদাস! পালাস্ কেন? রাগ করিনি, শুনে যা।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #5

 

– সুকুমার রায়

এক যে ছিল সাহেব, তাহার
গুণের মধ্যে নাকের বাহার।
তার যে গাধা বাহন, সেটা
যেমন পেটুক তেমনি ঢ্যাঁটা।
ডাইনে বল্‌লে যায় সে বামে
তিন পা যেতে দুবার থামে ।
চল্‌তে চল্‌তে থেকে থেকে
খানায় খন্দে পড়ে বেঁকে।
ব্যাপার দেখে এম্নিতরো
সাহেব বললে ‘সবুর করো-
মাম্‌দোবাজি আমার কাছে?
এ রোগেরও ওষুধ আছে।’
এই না বলে ভীষন ক্ষেপে
গাধার পিঠে বস্‌ল চেপে
মুলোর ঝুটি ঝুলিয়ে নাকে
আর কি গাধা ঝিমিয়ে থাকে?
মুলোর গন্ধে টগবগিয়ে
দৌড়ে চলে লম্ফ দিয়ে –
যতই ছোটে ‘ধরব’ ব’লে
ততই মুলো এগিয়ে চলে !
খাবার লোভে উদাস প্রাণে
কেবল ছোটে মুলোর টানে –
ডাইনে বাঁয়ে মুলোর তালে
ফেরেন গাধা নাকের চালে।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #6

 

– সুকুমার রায়

সোনার মেঘে আল্‌তা ঢেলে সিঁদুর মেখে গায়
সকাল সাঁঝে সূর্যি মামা নিত্যি আসে যায়।
নিত্যি খেলে রঙের খেলা আকাশ ভ’রে ভ’রে
আপন ছবি আপনি মুছে আঁকে নূতন ক’রে।
ভোরের ছবি মিলিয়ে দিল দিনের আল জ্বেলে
সাঁঝের আঁকা রঙিন ছবি রাতের কালি ঢেলে।
আবার আঁকে আবার মোছে দিনের পরে দিন
আপন সাথে আপন খেলা চলে বিরামহীন।
ফুরায় নাকি সোনার খেলা? রঙের নাহি পার?
কেউ কি জানে কাহার সাথে এমন খেলা তার?
সেই খেলা, যে ধরার বুকে আলোর গানে গানে
উঠ্‌ছে জেগে- সেই কথা কি সুর্যিমামা জানে?

Bangla Kobita of Sukumar Ray #7

 

– সুকুমার রায়

কিসে কিসে ভাব নেই? ভক্ষক ও ভক্ষ্যে—
বাঘে ছাগে মিল হলে আর নেই রক্ষে।

শেয়ালের সাড়া পেলে কুকুরেরা তৈরি,
সাপে আর নেউলে ত চিরকাল বৈরী!

আদা আর কাঁচকলা মেলে কোনোদিন্ সে?
কোকিলের ডাক শুনে কাক জ্বলে হিংসেয়।

তেলে দেওয়া বেগুনের ঝগড়াটা দেখনি?
ছ্যাঁক্ ছ্যাঁক্ রাগ যেন খেতে আসে এখনি।

তার চেয়ে বেশি আড়ি পারি আমি কহিতে—
তোমাদের কারো কারো কেতাবের সহিতে।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #8

 

– সুকুমার রায়

যাদুরে আমার আদুরে গোপাল, নাকটি নাদুস থোপ্‌না গাল,
ঝিকিমিকি চোখ মিট্‌মিটি চায়, ঠোঁট দুটি তায় টাট্‌কা লাল ।
মোমের পুতুল ঘুমিয়ে থাকুক্‌ দাঁত মেলে আর চুল খুলে-
টিনের পুতুল চীনের পুতুল কেউ কি এমন তুলতুলে ?
গোব্‌দা গড়ন এমনি ধরন আব্‌দারে কেউ ঠোঁট ফুলোয় ?
মখমলি রং মিষ্টি নরম- দেখ্‌ছ কেমন হাত বুলোয় !
বল্‌বি কি বল্‌ হাব্‌লা পাগল আবোল তাবোল কান ঘেঁষে,
ফোক্‌লা গদাই যা বলবি তাই ছাপিয়ে পাঠাই “সন্দেশে” ।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #9

 

– সুকুমার রায়

যে আনন্দ ফুলের বাসে,
যে আনন্দ পাখির গানে,
যে আনন্দ অরুণ আলোয়,
যে আনন্দ শিশুর প্রাণে,
যে আনন্দ বাতাস বহে,
যে আনন্দ সাগরজলে,
যে আনন্দ ধুলির কণায়,
যে আনন্দ তৃণের দলে,
যে আনন্দ আকাশ ভরা,
যে আনন্দ তারায় তারায়,
যে আনন্দ সকল সুখে,
যে আনন্দ রক্তধারায়
সে আনন্দ মধুর হয়ে
তোমার প্রাণে পড়ুক ঝরি,
সে আনন্দ আলোর মত
থাকুক তব জীবন ভরি।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #10

 

– সুকুমার রায়

আয়রে ভোলা খেয়াল‐খোলা
স্বপনদোলা নাচিয়ে আয়,
আয়রে পাগল আবোল তাবোল
মত্ত মাদল বাজিয়ে আয়।
আয় যেখানে ক্ষ্যাপার গানে
নাইকো মানে নাইকো সুর,
আয়রে যেথায় উধাও হাওয়ায়
মন ভেসে যায় কোন সুদূর।…

আয় ক্ষ্যাপা‐মন ঘুচিয়ে বাঁধন
জাগিয়ে নাচন তাধিন্ ধিন্,
আয় বেয়াড়া সৃষ্টিছাড়া
নিয়মহারা হিসাবহীন।
আজগুবি চাল বেঠিক বেতাল
মাতবি মাতাল রঙ্গেতে—
আয়রে তবে ভুলের ভবে
অসম্ভবের ছন্দেতে॥

Bangla Kobita of Sukumar Ray #11

 

– সুকুমার রায়

মেঘ মুলুকে ঝাপ্সাা রাতে,
রামধনুকের আব্ছায়াতে,
তাল বেতালে খেয়াল সুরে,
তান ধরেছি কন্ঠ পুরে।
হেথায় নিষেধ নাইরে দাদা,
নাইরে বাঁধন নাইরে বাধা।
হেথায় রঙিন্ আকাশতলে
স্বপন দোলা হাওয়ায় দোলে,
সুরের নেশায় ঝরনা ছোটে,
আকাশ কুসুম আপনি ফোটে,
রাঙিয়ে আকাশ, রাঙিয়ে মন
চমক জাগে ক্ষণে ক্ষণ।
আজকে দাদা যাবার আগে
বল্‌ব যা মোর চিত্তে লাগে-
নাই বা তাহার অর্থ হোক্
নাইবা বুঝুক বেবাক্ লোক।
আপনাকে আজ আপন হতে
ভাসিয়ে দিলাম খেয়াল স্রোতে।

ছুট‌লে কথা থামায় কে?
আজকে ঠেকায় আমায় কে?
আজকে আমার মনের মাঝে
ধাঁই ধপাধপ তব্‌লা বাজে-
রাম-খটাখট ঘ্যাচাং ঘ্যাঁচ্
কথায় কাটে কথার প্যাঁচ্ ।
আলোয় ঢাকা অন্ধকার,
ঘন্টা বাজে গন্ধে তার।
গোপন প্রাণে স্বপন দূত,
মঞ্চে নাচেন পঞ্চ ভুত!
হ্যাংলা হাতী চ্যাং দোলা,
শূন্যে তাদের ঠ্যাং তোলা!
মক্ষিরাণী পক্ষীরাজ-
দস্যি ছেলে লক্ষ্মী আজ!
আদিম কালের চাঁদিম হিম
তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম।
ঘনিয়ে এল ঘুমের ঘোর,
গানের পালা সাঙ্গ মোর।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #12

 

– সুকুমার রায়

পুব গগনে রাত পোহাল,
ভোরের কোণে লাজুক আলো
নয়ন মেলে চায়।
আকাশতলে ঝলক জ্বলে,
মেঘের শিশু খেলার ছলে
আলোক মাখে গায়।।
সোনার আলো, রঙিন্‌ আলো,
স্বপ্নে আঁকা নবীন আলো-
আয়রে আলো আয়।
আয়রে নেমে আঁধার পরে,
পাষাণ কালো ধৌত ক’রে
আলোর ঝরণায়।।
ঘুম ভাঙান পাখির তানে
জাগ্‌রে আলো আকুল গানে
আকূল নীলিমায়।
আলসভরা আঁখির কোণে,
দুঃখ ভয়ে আঁধার মনে,
আয়রে আলো আয়।।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #13

 

– সুকুমার রায়

হোক্‌না কেন যতই কালো
এমন ছায়া নাইরে নাই-
লাগ্‌লে পরে রোদের আলো
পালায় না যে আপ্‌নি ভাই!..

শুষ্কমুখে আঁধার ধোঁয়া
কঠিন হেন কোথায় বল্‌,
লাগ্‌লে যাতে হাসির ছোঁয়া
আপ্‌নি গলে হয় না জল।।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #14

 

– সুকুমার রায়

নিরীহ কলম, নিরীহ কালি,
নিরীহ কাগজে লিখিল গালি–
“বাঁদর বেকুব আজব হাঁদা
বকাট্‌ ফাজিল অকাট্‌ গাধা।”
আবার লিখিল কলম ধরি
বচন মিষ্টি, যতন করি–
“শান্ত মানিক শিষ্ট সাধু
বাছারে, ধনরে লক্ষ্মী যাদু।”
মনের কথাটি ছিলো যে মনে,
রটিয়া উঠিল খাতার কোণে,
আঁচরে আঁকিতে আখর ক’টি
কেহ খুশি, কেহ উঠিল চটি!
রকম রকম কালির টানে
কারো কারো অশ্রু আনে,
মারে না, ধরে না, হাঁকে না বুলি
লোকে হাসে কাঁদে কি দেখি ভুলি?
শাদায় কালোয় কি খেলা জানে?
ভাবিয়া ভাবিয়া না পাই মানে।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #15

 

– সুকুমার রায়

হাসছি মোরা হাসছি দেখ,হাসছি মোরা আহাদী,
তিন জনেতে জট্লা ক’রে ফোক্‌লা হাসির পাল্লা দি।
হাসতে হাসতে আসছে দাদা ,আসছি আমি,আসছে ভাই,
হাসছি কেন কেউ জানে না, পাচ্ছে হাসি হাসছি তাই।
ভাবছি মনে, হাসছি কেন? থাকব হাসি ত্যাগ করে ,
ভাবতে গিয়ে ফিকফিকিয়ে ফেলছি হেসে ফ্যাক ক’রে ।
পাচ্ছে হাসি চাপতে গিয়ে, পাচেছ হাসি চোখ বুজে,
পাচ্ছে হাসি চিমটি কেটে নাকের ভিতর নোখ গুজে।
হাসছি দেখে চাঁদের কলা জোলার মাকু জেলের দাঁড়
নৌকা ফানুস পিপড়ে মানুষ রেলের গাড়ী তেলের ভাঁড়।
পড়তে গিয়ে ফেলছি হেসে ‘ক খ গ’ আর শ্লেট দেখে-
উঠ্‌ছে হাসি ভস্‌ভসিয়ে সোডার মতন পেট থেকে।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #16

 

– সুকুমার রায়

শিবঠাকুরের আপন দেশে,
আইন কানুন সর্বনেশে!
কেউ যদি যায় পিছলে প’ড়ে,
প্যায়দা এসে পাক্‌‌ড়ে ধরে,
কাজির কাছে হয় বিচার-
একুশ টাকা দন্ড তার।।
সেথায় সন্ধে ছটার আগে
হাঁচতে হলে টিকিট লাগে
হাঁচলে পরে বিন্ টিকিটে
দম্দলমাদম্ লাগায় পিঠে,
কোটাল এসে নস্যি ঝাড়ে-
একুশ দফা হাচিয়ে মারে।।
কারুর যদি দাতটি নড়ে,
চার্‌টি টাকা মাশুল ধরে ,
কারুর যদি গোঁফ গজায়,
একশো আনা ট্যাক্সো চায়-
খুঁচিয়ে পিঠে গুঁজিয়ে ঘাড়,
সেলাম ঠোকায় একুশ বার।।
চলতে গিয়ে কেউ যদি চায়
এদিক্ ওদিক্ ডাইনে বাঁয়,
রাজার কাছে খবর ছোটে,
পল্টনেরা লাফিয়ে ওঠে,
দুপুরে রোদে ঘামিয়ে তায়-
একুশ হাতা জল গেলায়।।
যে সব লোকে পদ্য লেখে,
তাদের ধরে খাঁচায় রেখে,
কানের কাছে নানান্ সুরে
নামতা শোনায় একশো উড়ে,
সামনে রেখে মুদীর খাতা-
হিসেব কষায় একুশ পাতা।।
হঠাৎ সেথায় রাত দুপুরে
নাক ডাকালে ঘুমের ঘোরে,
অম্‌‌নি তেড়ে মাথায় ঘষে,
গোবর গুলে বেলের কষে,
একুশটি পাক ঘুরিয়ে তাকে-
একুশ ঘন্টা ঝুলিয়ে রাখে।।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #17

 

– সুকুমার রায়

পড়তে বসে মুখের কাছে কাগজখানি থুয়ে
রমেশ ভায়া ঘুমোয় পড়ে আরাম ক’রে শুয়ে ।
শুনছ নাকি ঘড়র ঘড়র নাক ডাকার ধূম ?
সখ যে বড় বেজায় দেখি- দিনের বেলায় ঘুম !

বাতাস পোরা এই যে থলি দেখ্‌‌ছ আমার হাতে,
দুড়ম করে পিট্‌‌লে পরে শব্দ হবে তাতে ।
রমেশ ভায়া আঁৎ‌কে উঠে পড়্‌‌বে কুপোকাৎ‌
লাগাও তবে- ধূমধারাক্কা ! ক্যাবাৎ‌ ! ক্যাবাৎ‌ !

ও বাবারে ! এ কেরে ভাই ! মারবে নাকি চাঁটি ?
আমি ভাবছি রমেশ বুঝি ! সব করেছে মাটি !
আবার দেখ চোখ পাকিয়ে আস্‌‌ছে আমায় তেড়ে-
আর কেন ভাই ? দৌড়ে পালাই, প্রাণের আশা ছেড়ে !

Bangla Kobita of Sukumar Ray #18

 

– সুকুমার রায়

ছোট্ট সে একরতি ইঁদুরের ছানা,
ফোটে নাই চোখ তার, একেবারে কানা।
ভাঙা এক দেরাজের ঝুলমাখা কোণে
মার বুকে শুয়ে শুয়ে মার কথা শোনে।

যেই তার চোখ ফোটে সেই দেখে চেয়ে-
দেরাজের ভারি কাঠ চারিদিক ছেয়ে।
চেয়ে বলে মেলি তার গোল গোল আঁখি-
“ওরে বাবা! পৃথিবীটা এত বড় নাকি?”

Bangla Kobita of Sukumar Ray #19

 

– সুকুমার রায়

গিরিধি আরামপুরী, দেহ মন চিৎপাত,
খেয়ে শুয়ে হু হু করে কেটে যায় দিনরাত;
হৈ চৈ হাঙ্গামা হুড়োতাড়া হেথা নাই;
মাস বার তারিখের কোন কিছু ল্যাঠা নেই;
খিদে পেলে তেড়ে খাও, ঘুম পেলে ঘুমিও-
মোট কথা, কি আরাম, বুঝলে না তুমিও !
ভুলেই গেছিনু কোথা এই ধরা মাঝেতে
আছে যে শহর এক কলকাতা নামেতে-
হেন কালে চেয়ে দেখি চিঠি এক সমুখে,
চায়েতে অমুক দিন ভোজ দেয় অমুকে ।
‘কোথায়? কোথায়?’ বলে মন ওঠে লাফিয়ে
তাড়াতাড়ি চিঠিখানা তেড়ে ধরি চাপিয়ে,
ঠিকানাটা চেয়ে দেখি নীচু পানে ওধারে
লেখা আছে ‘কলিকাতা’ – সে আবার কোথারে !
স্মৃতি কয় ‘কলিকাতা ‘ রোস দেখি; তাই ত ,
কোথায় শুনেছি যেন , মনে ঠিক নাই ত,
বেগতিক শুধালেম সাধুরাম ধোপারে ;
সে কহিল, হলে হবে উশ্রীর ওপারে।
ওপারের জেলেবুড়ো মাথা নেড়ে কয় সে ,
‘হেন নাম শুনি নাই আমার এ বয়সে ।’
তারপরে পুছিলাম সরকারী মজুরে
তামাম মুলুক সে ত বাৎলায় ‘হুজুরে’
বেঙাবাদ বরাকর , ইদিকে পচম্বা ,
উদিকে পরেশনাথ ,পাড়ি দাও লম্বা ;
সব তার সড়গড় নেই কোন ভুল তায় –
‘কুলিকাতা কাঁহা’ বলি সেও মাথা চুলকায় !
অবশেষে নিরুপায় মাথা যায় ঘুলিয়ে ‘
‘টাইম টেবিল’ খুলি দেখি চোখ বুলয়ে ।
সেথায় পাটনা পুরী গয়া গোমো মাল্‌দ
বজবজ দমদম হাওড়া ও শ্যালদ –
ইত্যাদি কত নাম চেয়ে দেখি সামনেই
তার মাঝে কোন খানে কলিকাতা নাম নেই !!
-সব ফাঁকি বুজ্‌রুকী রসিকতা -চেষ্টা !
উদ্দেশে ‘শালা ‘ বলি গাল দিনু শেষটা।-
সহসা স্মৃতিতে যেন লাগিল কি ফুৎকার
উদিল কুমড়া হেন চাঁদপানা মুখ কার!
আশে পাশে ঢিপি ঢুপি পাহাড়ে পুঞ্জ,
মুখ চাঁচা ময়দান, মাঝে কিবা কুঞ্জ !
সে শোভা স্মরণে ঝরে নয়নের ঝরনা ;
গৃহিনীরে কহি ‘প্রিয়ে !মারা যাই ধর না ।
তার পরে দেখি ঘরে অতি ঘোর অনাচার –
রাখে না কো কেউ কোন তারিখের সমাচার !
তখনি আনিয়া পাঁজি দেখা গেল গণিয়া,
চায়ের সময় এল একেবারে ঘনিয়া !
হায়রে সময় নেই, মন কাদে হতাশে-
কোথায় চায়ের মেলা! মুখশশী কোথা সে !
স্বপন শূকায়ে যায় আধারিয়া নয়নে ,
কবিতায় গলি তাই গাহি শোক শয়নে।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #20

 

– সুকুমার রায়

ছিচ্‌কাঁদুনে মিচকে যারা সস্তা কেঁদে নাম কেনে,
ঘ্যাঁঙায় শুধু ঘ্যানর ঘ্যানর ঘ্যান্‌ঘ্যানে আর প্যানপ্যানে—
কুঁকিয়ে কাঁদে খিদের সময়, ফুঁপিয়ে কাঁদে ধম্‌কালে,
কিম্বা হঠাৎ লাগলে ব্যাথা, কিম্বা ভয়ে চম্‌কালে;
অল্পে হাসে অল্পে কাঁদে, কান্না থামায় অল্পেতেই;
মায়ের আদর দুধের বোতল কিম্বা দিদির গল্পেতেই—
তারেই বলি মিথ্যে কাঁদন, আসল কান্না শুনবে কে?
অবাক্ হবে থম্‌কে রবে সেই কাঁদনের গুণ দেখে!
নন্দঘোষের পাশের বাড়ী বুথ্ সাহেবের বাচ্চাটার
কান্নাখানা শুনলে বলি কান্না বটে সাচ্চা তার।
কাঁদবে না সে যখন তখন, রাখবে কেবল রাগ পুষে,
কাঁদবে যখন খেয়াল হবে খুন–কাদুনে রাক্ষুসে!
নাইকো কারণ নাইকো বিচার মাঝরাতে কি ভোরবেলা,
হঠাৎ শুনি অর্থবিহীন আকাশ–ফাটান জোর গলা।
হাঁকড়ে ছোটে কান্না যেমন জোয়ার বেগে নদীর বান,
বাপ মা বসেন হতাশ হয়ে শব্দ শুনে বধির কান।
বাসরে সে কি লোহার গলা? এক মিনিটও শান্তি নেই?
কাঁদন ঝরে শ্রাবণ ধারে, ক্ষান্ত দেবার নামটি নেই!
ঝুমঝুমি দাও পুতুল নাচাও, মিষ্টি খাওয়াও একশোবার,
বাতাস কর, চাপড়ে ধর, ফুটবে নাকো হাস্য তার।
কান্নাভরে উল্‌টে পড়ে কান্না ঝরে নাক দিয়ে,
গিলতে চাহে দালানবাড়ী হাঁ’খানি তার হাঁক্ দিয়ে,
ভূত–ভাগানো শব্দে লোকে ত্রাহি ত্রাহি ডাক ছাড়ে—
কান্না শুনে ধন্যি বলি বুথ্ সাহেবের বাচ্চারে।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #21

 

– সুকুমার রায়

প্রথম।
বাঃ – আমার নাম ‘বাঃ’,
বসে থাকি তোফা তুলে পায়ের উপর পা!
লেখাপড়ার ধার ধারিনে , বছর ভরে ছুটি,
হেসে খেলে আরাম ক’রে দুশো মজা লুটি।
কারে কবে কেয়ার করি , কিসের করি ডর?
কাজের নামে কম্প দিয়ে গায়ে আসে জ্বর।
গাধার মতন খাটিস্ তোরা মুখটা করে চুন-
আহাম্মুকি কান্ড দেখে হেসেই আমি খুন।

সকলে।
আস্ত একটি গাধা তুমি স্পষ্ট গেল দেখা,
হাস্‌ছ যত, কান্না তত কপালেতে লেখা।

দ্বিতীয়।
‘যদি’ বলে ডাকে আমায় নামটি আমার যদি –
আশায় আশায় বসে থাকি হেলনা দিয়ে গদি।
সব কাজেতে থাকতে যদি খেলার মত মজা,
লেখাপড়া হত যদি জলের মত সোজা –
স্যান্ডো সমান ষন্ডা হতাম যদি গায়ের জোরে,
প্রশংসাতে আকাশ পাতাল যদি যেত ভরে –
উঠে পড়ে গেলে যেতাম বাজে তর্ক ফেলে।
করতে পারি সবি – যদি সহজ উপায় মেলে।

সকলে।
হাতের কাছে সুযোগ, তবু যদির আশায় বসে
নিজের মাথা খাচ্ছ বাপু নিজের বুদ্ধি দোষে

তৃতীয়।
আমার নাম ‘বটে’ আমি সদাই আছি চটে-
কট্‌মটিয়ে তাকাই যখন, সবাই পালায় ছুটে।
চশমা পরে বিচার ক’রে চিরে দেখাই চুল-
উঠ্‌তে বস্‌তে কচ্ছে সবাই হাজার গন্ডা ভুল।
আমার চোখে ধুলো দেবে সাধ্যি আছে কার?
ধমক শুনে ভূতের বাবা হচ্ছে পগার পার।
হাসছ? বটে ভাবছ বুঝি মস্ত তুমি লোক,
একটি আমার ভেংচি খেলে উল্টে যাবে চোখ।

সকলে।
দিচ্ছ গালি, লোকের তাতে কিবা এল গেল?
আকাশেতে থুতু ছুঁড়ে – নিজেই গায়েই ফেল।

চতুর্থ।
আমার নাম ‘কিন্তু’ আমায় ‘কিন্তু’ বলে ডাকে,
সকল কাজে একটা কিছু গলদ লেগে থাকে।
দমটা কাজে লাগি কিন্তু আটটা করি মাটি,
ষোল আনা কথায় কিন্তু সিকি মাত্র খাঁটি।
লম্ফ ঝম্ফবহুৎ কিন্তু কাজের নাইকো ছিরি-
ফোস করে যাই তেড়ে – আবার ল্যাজ গুটিয়ে ফিরি।
পাঁচটা জিনিস গড়তে গেলে দশটা ভেঙে চুর –
বল্ দেখি ভাই কেমন আমি সাবাস বাহাদুর!

সকলে।
উচিত তোমায় বেধে রাখা নাকে দিয়ে দড়ি,
বেগারখাটা পশুকাজের মূল্য কানাকড়ি।

পঞ্চম।
আমার নাম ‘তবু’ তোমার কেউ কি আময়ি চেনো?
দেখতে ছোট তবু আমার সাহস আছে জেনো।
এতটুকু মানুষ তবু দ্বিধা নাইকো মনে,
যে কাজেতেই লাগি আমি খাটি প্রাণপণে।
এম্নি আমার জেদ, যখন অঙ্ক নিয়ে বসি,
একুশ বারে না হয় যদি বাইশ বারে কষি।
হাজার আসুক বাধা তবু উৎসাহ না কমে,
হাজার লোকে চোখ রাঙালে তবু না যাই দ’মে।

সকলে।
নিস্কম্মারা গেল কোথা,পালাল কোন দেশে?
কাজের মানুষ কারে বলে দেখুন এখন এসে।
হেসে খেলে, শুয়ে বসে কত সময় যায়,
সময়টা যে কাজে লাগায়,চালাক বলে তায়।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #22

 

– সুকুমার রায়

হাঁড়ি নিয়ে দাড়িমুখো কে–যেন কে বৃদ্ধ
রোদে বসে চেটে খায় ভিজে কাঠ সিদ্ধ ।
মাথা নেড়ে গান করে গুন্ গুন্ সঙ্গীত
ভাব দেখে মনে হয় না–জানি কি পণ্ডিত !
বিড়্ বিড়্ কি যে বকে নাহি তার অর্থ—
‘আকাশেতে ঝুল ঝোলে, কাঠে তাই গর্ত ।’
টেকো মাথা তেতে ওঠে গায়ে ছোটে ঘর্ম,
রেগে বলে, ‘কেবা বোঝে এ সবের মর্ম ?
আরে মোলো, গাধাগুলো একেবারে অন্ধ,
বোঝেনাকো কোনো কিছু খালি করে দ্বন্দ্ব ।
কোন্ কাঠে কত রস জানে নাকো তত্ত্ব,
একাদশী রাতে কেন কাঠে হয় গর্ত ?’

আশে পাশে হিজি বিজি আঁকে কত অঙ্ক
ফাটা কাঠ ফুটো কাঠ হিসাব অসংখ্য ;
কোন্ ফুটো খেতে ভালো, কোন্‌টা বা মন্দ,
কোন্ কোন্ ফাটলের কি রকম গন্ধ ।
কাঠে কাঠে ঠুকে করে ঠকাঠক শব্দ ।
বলে, ‘জানি কোন্ কাঠ কিসে হয় জব্দ ;
কাঠকুঠো ঘেঁটেঘুঁটে জানি আমি পষ্ট,
এ কাঠের বজ্জাতি কিসে হয় নষ্ট ।
কোন্ কাঠ পোষ মানে, কোন কাঠ শান্ত,
কোন্ কাঠ টিম্‌টিমে, কোন্‌টা বা জ্যান্ত ।
কোন্ কাঠে জ্ঞান নেই মিথ্যা কি সত্য,
আমি জানি কোন্ কাঠে কেন থাকে গর্ত ।’

Bangla Kobita of Sukumar Ray #23

 

– সুকুমার রায়

আর যেখানে যাও না রে ভাই সপ্তসাগর পার,
কাতুকুতু বুড়োর কাছে যেও না খবরদার!
সর্বনেশে বৃদ্ধ সে ভাই যেও না তার বাড়ি—
কাতুকুতুর কুলপি খেয়ে ছিঁড়বে পেটের নাড়ি।
কোথায় বাড়ি কেউ জানে না, কোন্‌ সড়কের মোড়ে,
একলা পেলে জোর ক’রে ভাই গল্প শোনায় প’ড়ে।
বিদ্‌ঘুটে তার গল্পগুলো না জানি কোন দেশী,
শুনলে পরে হাসির চেয়ে কান্না আসে বেশি।
না আছে তার মুণ্ডু মাথা না আছে তার মানে,
তবুও তোমায় হাসতে হবে তাকিয়ে বুড়োর পানে।
কেবল যদি গল্প বলে তাও থাকা যায় সয়ে,
গায়ের উপর সুড়সুড়ি দেয় লম্বা পালক লয়ে।
কেবল বলে, “হোঃ হোঃ হোঃ, কেষ্টদাসের পিসি—
বেচ্‌ত খালি কুমড়ো কচু হাঁসের ডিম আর তিসি।
ডিমগুলো সব লম্বা মতন, কুমড়োগুলো বাঁকা,
কচুর গায়ে রঙ‐বেরঙের আল্‌পনা সব আঁকা।
অষ্ট প্রহর গাইত পিসি আওয়াজ করে মিহি,
ম্যাও ম্যাও ম্যাও বাকুম বাকুম ভৌ ভৌ ভৌ চীঁহি।”
এই না বলে কুটুত্‍‌ ক’রে চিম্‌টি কাটে ঘাড়ে,
খ্যাংরা মতন আঙুল দিয়ে খোঁচায় পাঁজর হাড়ে।
তোমায় দিয়ে সুড়সুড়ি সে আপনি লুটোপুটি,
যতক্ষণ না হাসবে তোমার কিচ্ছুতে নাই ছুটি।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #24

 

– সুকুমার রায়

পুরাতন কালে ছিল দুই রাজা,
নাম ধাম নাহি জানা,
একজন তার খোড়া অতিশয়,
অপর ভূপতি কানা।
মন ছিল খোলা, অতি আলো ভোলা
ধরমেতে ছিল মতি,
পর ধনে সদা ছিল দোঁহাকার
বিরাগ বিকট অতি।
প্রতাপের কিছু নাহি ছিল ত্রুটি
মেজাজ রাজারি মত,
শুনেছি কেবল, বুদ্ধিটা নাকি
নাহি ছিল সরু তত,
ভাই ভাই মত ছিল দুই রাজা,
না ছিল ঝগড়াঝাঁটি,
হেনকালে আসি তিন হাত জমি
সকল করিল মাটি।
তিন হাত জমি হেন ছিল, তাহা
কেহ নাহি জানে কার,
কহে খোঁড়া রায় “এক চক্ষু যার
এ জমি হইবে তার”।’
শুনি কানা রাজা ক্রোধ করি কয়
“আরে অভাগার পুত্র,
এ জমি তোমারি- দেখ না এখনি
খুলিয়া কাগজ পত্র”।
নক্সা রেখেছে এক বছর
বাক্সে বাঁধিয়া আঁটি,
কীট কুটমতি কাটিয়া কাটিয়া
করিয়াছে তারে মাটি ;
কাজেই তর্ক না মিটিল হায়
বিরোধ বাধিল ভারি,
হইল য্দ্দু হদ্দ মতন
চৌদ্দ বছর ধরি।
মরিল সৈন্য, ভাঙিল অস্ত্র,
রক্ত চলিল বহি,
তিন হাত জমি তেমনি রহিল,
কারও হার জিত নাহি
তবে খোঁড়া রাজা কহে, হায় হায়,
তর্ক নাহিক মিটে,
ঘোরতর রণে অতি অকারণে
মরণ সবার ঘটে”
বলিতে বলিতে চঁটাৎ করিয়া
হঠাৎ মাথায় তার
অদ্ভুত এক বুদ্ধি আসিল
অতীব চমৎকার।
কহিল তখন খোঁড়া মহারাজ,
শুন মোর কানা ভাই,
তুচ্ছ কারণে রক্ত ঢালিয়া
কখনও সুযশ নাই।
তার চেয়ে জমি দান করে ফেল
আপদ শান্তি হবে।”
কানা রাজা কহে, খাসা কথা ভাই,
কারে দিই কহ তবে।”
কহেন খঞ্জ, ” আমার রাজ্যে
আছে তিন মহাবীর-
একটি পেটুক, অপর অলস,
তৃতীয় কুস্তিগীর।
তোমার মুলুক কে আছে এমন
এদের হারাতে পারে?-
সবার সমুখে তিন হাত জমি
বকশিস দিব তারে।
কানা রাজা কহে ভীমের দোসর
আছে ত মল্ল মম,
ফালাহারে পটু, পঁচাশি পেটুক
অলস কুমড়া সম।
দেখা যাবে কার বাহাদুরি বেশি
আসুক তোমার লোক;
যে জিতিবে সেই পাবে এই জমি-
খোড়া বলে, তাই হোক।
পড়িল নোটিস ময়দান মাঝে
আলিশান সভা হবে,
তামাসা দেখিতে চারিদিক হতে
ছুটিয়া আসিল সবে।
ভয়ানক ভিড়ে ভরে পথঘাট,
লোকে হল লোকাকার,
মহা কোলাহল দাড়াবার ঠাই
কোনোখানে নাহি আর।
তারপর ক্রমে রাজার হুকুমে
গোলমাল গেল থেমে,
দুইদিক হতে দুই পালোয়ান
আসরে আসিল নেমে।
লম্ফে ঝম্ফে যুঝিল মল্ল
গজ-কচ্ছপ হেন,
রুষিয়া মুষ্টি হানিল দোহায়-
বজ্র পড়িল যেন!
গুঁতাইল কত ভোঁতাইল নাসা
উপাড়িল গোফ দাড়ি,
যতেক দন্ত করিল অন্ত
ভীষণ চাপটি মারি
তারপরে দোঁহে দোঁহারে ধরিয়া
ছুঁড়িল এমনি জোরে,
গোলার মতন গেল গো উড়িয়া
দুই বীর বেগভরে।
কিহল তাদের কেহ নাহি জানে
নানা কথা কয় লোকে,
আজও কেহ তার পায়নি খবর,
কেহই দেখেনি চোখে।
যাহোক এদিকে, কুস্তির শেষে
এল পেটুকের পালা,
যেন অতিকায় ফুটবল দুটি,
অথবা ঢাকাই জালা।
ওজনেতে তারা কেহ নহে কম,
ভোজনেতে ততোধিক,
বপু সুবিপুল, ভুড়ি বিভীষন-
ভারি সাতমন ঠিক।
অবাক দেখিছে সভার সকলে
আজব কান্ড ভারি-
ধামা ধামা লুচি নিমেষে ফুরায়
দই ওঠে হাঁড়ি হাঁড়ি!
দাড়ি পাল্লায় মাপিয়া সকলে
দেখে আহারের পরে ,
দুজনেই ঠিক বেড়েছে ওজনে
সাড়ে তিন মন করে।
কানা রাজা বলে একি হল জ্বালা,
আক্কেল নাই কারো ,
কেহ কি বোঝেনা সোজা কথা এই,
হয় জেতো নয় হারো।”
তার পর এল কুঁড়ে দুই জন
ঝাকার উপর চড়ে,
সভামাঝে দোহে শুয়ে চিৎপাত
চুপ চাপ রহে পড়ে।
হাত নাহি নাড়ে, চোখ নাহি মেলে,
কথা নাই কারো মুখে,
দিন দুই তিন রহিল পড়িয়া,
নাসা গীত গাহি সুখে।
জঠরে যখন জ্বলিল আগুন,
পরান কণ্ঠাগত,
তখন কেবল মেলিয়া আনন
থাকিল মড়ার মত।
দয়া করে তবে সহৃদয় কেহ
নিকটে আসিয়া ছুটি
মুখের নিকটে ধরিল তাদের
চাটিম কদলি দুটি।
খঞ্জের লোকে কহিল কষ্টে,
“ছাড়িয়া দে নারে ভাই”
কানার ভৃত্য রহিল হা করে
মুখে তার কথা নাই ।
তখন সকলে কাষ্ঠ আনিয়া
তায় কেরোসিন ঢালি,
কুড়েদের গায়ে চাপাইয়া রোষে
দেশলাই দিল জ্বালি।
খোঁড়ার প্রজাটি বাপরে বলিয়া
লাফ দিয়া তাড়াতাড়ি
কম্পিত পদে চম্পট দিল
একেবারে সভা ছাড়ি।
দুয়ো বলি সবে দেয় করতালি
পিছু পিছু ডাকে “ফেউ”?
কানার অলস বলে কি আপদ
ঘুমুতে দিবিনা কেঊ?
শুনে সবে বলে “ধন্য ধন্য
কুঁড়ে-কুল চুড়ামণি!”
ছুটিয়া তাহারে বাহির করিল
আগুন হইতে টানি।
কানার লোকের গুণপনা দেখে
কানা রাজা খুসী ভারি,
জমিতে দিলেই আরও দিল কত,
টাকাকড়ি ঘরবাড়ি।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #25

 

– সুকুমার রায়

কানে খাটো বংশীধর যায় মামাবাড়ি,
গুনগুন গান গায় আর নাড়ে দাড়ি।।
চলেছে সে একমনে ভাবে ভরপুর,
সহসা বাজিল কানে সুমধুর সুর।।
বংশীধর বলে, ‘আহা, না জানি কি পাখি
সুদুরে মধুর গায় আড়ালেতে থাকি।।
দেখ, দেখ সুরে তার কত বাহাদুরি,
কালোয়াতি গলা যেন খেলে কারিকুরি।।’
এদিকে বেড়াল ভাবে, ‘এযে বড় দায়,
প্রাণ যদি থাকে তবে ল্যাজখানি যায়।।
গলা ছেড়ে এত চেঁচামেচি এত করি হায়
তবু যে ছাড়ে না বেটা, কি করি উপায়।।
আর তো চলে না সহা এত বাড়াবাড়ি,
যা থাকে কপালে, দেই এক থাবা মারি।।’
বংশীধর ভাবে, ‘একি! বেসুরা যে করে,
গলা গেছে ভেঙে তাই ‘ফ্যাঁস্‌’ সুর ধরে।।’
হেনকালে বেরসিক বেড়ালের চাঁটি,
একেবারে সব গান করে দিল মাটি।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #26

 

– সুকুমার রায়

সব লিখেছে এই কেতাবে দুনিয়ার সব খবর যত,
সরকারী সব অফিসখানার কোন্ সাহেবের কদর কত৷
কেমন ক’রে চাট্‌নি বানায়, কেমন ক’রে পোলাও করে,
হরেক্ রকম মুষ্টিযোগের বিধান লিখছে ফলাও ক’রে৷
সাবান কালি দাঁতের মাজন বানাবার সব কায়দা কেতা,
পূজা পার্বণ তিথির হিসাব শ্রাদ্ধবিধি লিখছে হেথা৷
সব লিখেছে, কেবল দেখ পাচ্ছিনেকো লেখা কোথায়—
পাগলা ষাঁড়ে কর্‌লে তাড়া কেমন ক’রে ঠেকাব তায়!

Bangla Kobita of Sukumar Ray #27

 

– সুকুমার রায়

কারোর কিছু চাই গো চাই ?
এই যে খোকা, কি নেবে ভাই?
জলছবি আর লাট্টু লাটাই
কেক বিস্কুট লাল দেশলাই
খেলনা বাঁশি কিংবা ঘুড়ি
লেড্‌ পেনসিল রবার ছুরি?
এসব আমার কিছুই নাই,
কারোর কিছু চাই গো চাই?

কারোর কিছু চাই গো চাই?
বৌমা কি চাও শুনতে পাই?
ছিটের কাপড় চিকন লেস্‌
ফ্যান্সি জিনিস ছুঁচের কেস্‌
আল্‌তা সিঁদুর কুন্তলীন
কাঁচের চুড়ি বোতাম পিন্‌?
আমার কাছে ওসব নাই,
কারোর কিছু চাই গো চাই?

কারোর কিছু চাই গো চাই?
আপনি কি চান কর্তামশাই?
পকেট বই কি খেলার তাস
চুলের কলপ জুতোর ব্রাশ্‌
কলম কালি গঁদের তুলি
নস্যি চুরুট সুর্তি গুলি?
ওসব আমার কিছুই নাই,
কারোর কিছু চাই গো চাই?

Bangla Kobita of Sukumar Ray #28

 

– সুকুমার রায়

বিদঘুটে জানোয়ার কিমাকার কিম্ভুত,
সারাদিন ধ’রে তার শুনি শুধু খুঁৎ খুঁৎ।
মাঠ পারে ঘাট পারে কেঁদে মরে খালি সে,
ঘ্যান্ ঘ্যান আব্দারে ঘন ঘন নালিশে।
এটা চাই সেটা চাই কত তার বায়না-
কি যে চায় তাও ছাই বোঝা কিছু যায়না ।
কোকিলের মত তার কন্ঠেতে সুর চাই,
গলা শুনে আপনার বলে, ‘উহু, দুর ছাই!’
আকাশেতে উড়ে যেতে পাখিদের মানা নেই-
তাই দেখে মরে কেঁদে- তার কোন ডানা নেই!
হাতিটার কি বাহার দাঁতে আর শুন্ডে-
ও রকম জুরে তার দিতে হবে মুন্ডে!
কাঙ্গারুর লাফ দেখে ভারি তার হিংসে-
ঠ্যাং চাই আজ থেকে ঢ্যাংঢেঙে চিমসে!
সিংহের কেশরের মত তার তেজ কৈ?
পিছে খাসা গোসাপের খাজ কাটা লেজ কৈ?
একলা সে সব হলে মেটে তার প্যাখনা;
যারে পায় তারে বলে, ‘মোর দশা দেখ্না!’
কেদেঁ কেদেঁ শেষটায়- আষাঢ়ের বাইশে
হল বিনা চেষ্টায় চেয়েছে যা তাই সে।
ভুলে গিয়ে কাঁদাকাটি আহ্লাদে আবেশে
চুপিচুপি একলাটি ব’সে ব’সে ভাবে সে-
লাফ দিয়ে হুশ্ করে হাতি কভু নাচে কি?
কলাগাছ খেলে পরে কাঙ্গারুটা বাঁচে কি ?
ভোঁতামুখে কুহুডাক শুনে লোকে কবে কি?
এই দেহে শুঁড়ো নাক খাপ ছাড়া হবে কি?
‘বুড়ো হাতি ওড়ে’ ব’লে কেউ যদি গালি দেয় ?
কান টেনে ল্যাজ মলে ‘দুয়ো’ ব’লে তালি দেয়?
কেউ যদি তেড়েমেরে বলে তার সামনেই-
কোথাকার তুই কেরে, নাম নেই ধাম নেই?
জবাব কি দেবে ছাই,আছে কিছু বলবার?
কাচুঁ মাচুঁ বসে তাই ,মনে শুধু তোলপার-
‘নই ঘোড়া,নই হাতি, নই সাপ বিচছু
মৌমাছি প্রজাপতি নই আমি কিচছু।
মাছ ব্যাং গাছপাতা জলমাটি ঢেউ নই,
নই জুতা নই ছাতা,আমি তবে কেউ নই!’

Bangla Kobita of Sukumar Ray #29

 

– সুকুমার রায়

(যদি) কুম্‌ড়োপটাশ নাচে—
খবরদার এসো না কেউ আস্তাবলের কাছে;
চাইবে নাকো ডাইনে বাঁয়ে চাইবে নাকো পাছে;
চার পা তুলে থাকবে ঝুলে হট্টমূলার গাছে!

(যদি) কুম্‌ড়োপটাশ কাঁদে—
খবরদার! খবরদার! বসবে না কেউ ছাদে;
উপুড় হয়ে মাচায় শুয়ে লেপ কম্বল কাঁধে;
বেহাগ সুরে গাইবে খালি ‘রাধে কৃষ্ণ রাধে’!

(যদি) কুম্‌ড়োপটাশ হাসে—
থাকবে খাড়া একটি ঠ্যাঙে রান্নাঘরের পাশে;
ঝাপ্‌সা গলায় ফার্সি কবে নিশ্বাসে ফিস্‌ফাসে;
তিনটি বেলায় উপোশ করে থাকবে শুয়ে ঘাসে!

(যদি) কুম্‌ড়োপটাশ ছোটে—
সবাই যেন তড়বড়িয়ে জানলা বেয়ে ওঠে;
হুঁকোর জলে আলতা গুলে লাগায় গালে ঠোঁটে;
ভুলেও যেন আকাশ পানে তাকায় না কেউ মোটে!

(যদি) কুম্‌ড়োপটাশ ডাকে—
সবাই যেন শাম্‌লা এঁটে গামলা চড়ে থাকে;
ছেঁচকি শাকের ঘন্ট বেটে মাথায় মলম মাখে;
শক্ত ইঁটের তপ্ত ঝামা ঘষতে থাকে নাকে!

তুচ্ছ ভেবে এ‐সব কথা করছে যারা হেলা,
কুম্‌ড়োপটাশ জানতে পেলে বুঝবে তখন ঠেলা।
দেখবে তখন কোন কথাটি কেমন করে ফলে,
আমায় তখন দোষ দিও না, আগেই রাখি বলে।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #30

 

– সুকুমার রায়

কেন সব কুকুরগুলো খামখা চ্যাঁচায় রাতে ?
কেন বল দাঁতের পোকা থাকেনা ফোক্‌লা দাঁতে ?
পৃথিবীর চ্যাপ্টা মাথা, কেন সে কাদের দোষে?-
এস ভাই চিন্তা করি দুজনে ছায়ায় বসে ।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #31

 

– সুকুমার রায়

খাই খাই করো কেন, এসো বসো আহারে—
খাওয়াব আজব খাওয়া, ভোজ কয় যাহারে।
যত কিছু খাওয়া লেখে বাঙালির ভাষাতে,
জড় করে আনি সব— থাক সেই আশাতে।
ডাল ভাত তরকারি ফল-মূল শস্য,
আমিষ ও নিরামিষ, চর্ব্য ও চোষ্য,
রুটি লুচি, ভাজাভুজি, টক ঝাল মিষ্টি,
ময়রা ও পাচকের যত কিছু সৃষ্টি,
আর যাহা খায় লোকে স্বদেশে ও বিদেশে—
খুঁজে পেতে আনি খেতে— নয় বড়ো সিধে সে!
জল খায়, দুধ খায়, খায় যত পানীয়,
জ্যাঠাছেলে বিড়ি খায়, কান ধরে টানিয়ো।
ফল বিনা চিঁড়ে দৈ, ফলাহার হয় তা,
জলযোগে জল খাওয়া শুধু জল নয় তা।

ব্যাঙ খায় ফরাসিরা (খেতে নয় মন্দ),
বার্মার ‘ঙাপ্পি’তে বাপ্ রে কি গন্ধ!
মান্দ্রাজী ঝাল খেলে জ্বলে যায় কণ্ঠ,
জাপানেতে খায় নাকি ফড়িঙের ঘণ্ট!
আরশুলা মুখে দিয়ে সুখে খায় চীনারা,
কত কি যে খায় লোকে নাহি তার কিনারা।
দেখে শুনে চেয়ে খাও, যেটা চায় রসনা;
তা না হলে কলা খাও— চটো কেন? বসো না—
সবে হল খাওয়া শুরু, শোনো শোনো আরো খায়—
সুদ খায় মহাজনে, ঘুষ খায় দারোগায়।
বাবু যান হাওয়া খেতে চড়ে জুড়ি-গাড়িতে,
খাসা দেখ ‘খাপ্ খায়’ চাপ্‌কানে দাড়িতে।
তেলে জলে ‘মিশ খায়’, শুনেছ তা কেও কি?
যুদ্ধে যে গুলি খায় গুলিখোর সেও কি?
ডিঙি চড়ে স্রোতে প’ড়ে পাক খায় জেলেরা,
ভয় পেয়ে খাবি খায় পাঠশালে ছেলেরা;
বেত খেয়ে কাঁদে কেউ, কেউ শুধু গালি খায়,
কেউ খায় থতমত— তাও লিখি তালিকায়।
ভিখারিটা তাড়া খায়, ভিখ্ নাহি পায় রে—
‘দিন আনে দিন খায়’ কত লোক হায় রে।
হোঁচটের চোট্ খেয়ে খোকা ধরে কান্না
মা বলেন চুমু খেয়ে, ‘সেরে গেছে, আর না।’
ধমক বকুনি খেয়ে নয় যারা বাধ্য
কিলচড় লাথি ঘুঁষি হয় তার খাদ্য।
জুতো খায় গুঁতো খায়, চাবুক যে খায় রে,
তবু যদি নুন খায় সেও গুণ গায় রে।
গরমে বাতাস খাই, শীতে খাই হিম্‌সিম্,
পিছলে আছাড় খেয়ে মাথা করে ঝিম্‌ঝিম্।

কত যে মোচড় খায় বেহালার কানটা,
কানমলা খেলে তবে খোলে তার গানটা।
টোল খায় ঘটি বাটি, দোল খায় খোকারা,
ঘাব্‌ড়িয়ে ঘোল খায় পদে পদে বোকারা।
আকাশেতে কাৎ হ’য়ে গোঁৎ খায় ঘুড়িটা,
পালোয়ান খায় দেখ ডিগ্‌বাজি কুড়িটা।
ফুটবলে ঠেলা খাই, ভিড়ে খাই ধাক্কা,
কাশীতে প্রসাদ খেয়ে সাধু হই পাক্কা।
কথা শোনো, মাথা খাও, রোদ্দুরে যেও না—
আর যাহা খাও বাপু বিষমটি খেয়ো না।
‘ফেল্’ ক’রে মুখ খেয়ে কেঁদেছিলে সেবারে,
আদা-নুন খেয়ে লাগো পাশ করো এবারে।
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ো নাকো; যেয়ো নাকো ভড়্‌কে,
খাওয়াদাওয়া শেষ হলে বসে খাও খড়্‌কে।
এত খেয়ে তবু যদি নাহি ওঠে মনটা—
খাও তবে কচুপোড়া খাও তবে ঘণ্টা।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #32

 

– সুকুমার রায়

হাঁস ছিল, সজারুও, (ব্যাকরণ মানি না),
হয়ে গেল ‘হাঁসজারু’ কেমনে তা জানি না ৷
বক কহে কচ্ছপে—’বাহবা কি ফুর্তি !
অতি খাসা আমাদের ‘বকচ্ছপ মূর্তি’ ৷’
টিয়ামুখো গিরগিটি মনে ভারি শঙ্কা—
পোকা ছেড়ে শেষে কিগো খাবে কাঁচা লঙ্কা ?
ছাগলের পেটে ছিল না জানি কি ফন্দি,
চাপিল বিছার ঘাড়ে, ধড়ে মুড়ো সন্ধি !
জিরাফের সাধ নাই মাঠে–ঘাটে ঘুরিতে,
ফড়িঙের ঢং ধরি সেও চায় উড়িতে ৷
গরু বলে, ‘আমারেও ধরিল কি ও রোগে ?
মোর পিছে লাগে কেন হতভাগা মোরগে ?’
‘হাতিমি’র দশা দেখ–তিমি ভাবে জলে যাই
হাতি বলে, ‘এই বেলা জঙ্গলে চল ভাই ৷’
সিংহের শিং নাই এই বড় কষ্ট—
হরিণের সাথে মিলে শিং হল পষ্ট ৷

Bangla Kobita of Sukumar Ray #33

 

– সুকুমার রায়

শুনেছ কি ব’লে গেলো

শুনেছ কি ব’লে গেলো সীতানাথ বন্দ্যো?
আকাশের গায়ে নাকি টকটক গন্ধ?
টকটক থাকে নাকো হ’লে পরে বৃষ্টি–
তখন দেখেছি চেটে একেবারে মিষ্টি।

বল্‌ব কি ভাই

বলব কি ভাই হুগলি গেলুম
বলছি তোমায় চুপি-চুপি–
দেখতে পেলাম তিনটে শুয়োর
মাথায় তাদের নেইকো টুপি।।

কহ ভাই কহ রে

কহ ভাই কহ রে, অ্যাঁকা চোরা শহরে,
বদ্যিরা কেন কেউ আলুভাতে খায় না?
লেখা আছে কাগজে আলু খেলে মগজে,
ঘিলু যায় ভেস্তিয়ে বুদ্ধি গজায় না।

ঢপ্‌ ঢপ্‌ ঢাক ঢোল

ঢপ্‌ ঢপ্‌ ঢাক ঢোল ভপ্‌ ভপ্‌ বাশিঁ
ঝন্‌ ঝন্‌ করতাল্‌ ঠন্‌ ঠন্‌ কাসিঁ।
ধুমধাম বাপ্‌ বাপ্‌ ভয়ে ভ্যাবাচ্যাকা
বাবুদের ছেলেটার দাঁত গেছে দেখা।
আকাশের গায়ে

আকাশের গায়ে কিবা রামধনু খেলে,
দেখে চেয়ে কত লোক সব কাজ ফেলে;
তাই দেখে খুঁৎ ধরা বুড়ো কয় চটে,
দেখছ কি, এই রং পাকা নয় মোটে।।

শোন শোন গল্প শোন

শোন শোন গল্প শোন,’এক যে ছিলো গুরু’,
এই আমার গল্প হলো শুরু।
যদু আর বংশীধর যমযজ ভাই তারা,
এই আমার গল্প হলো সারা।
মাসি গো মাসি

মাসি গো মাসি, পাচ্ছে হাসি
নিম গাছেতে হচ্ছে শিম্‌–
হাতীর মাথায় ব্যাঙের ছাতা
কাগের বাসায় বগের ডিম।।

ডাক্তার ফস্টার

ডাক্তার ফস্টার
ইস্কুল মাস্টার
বেত তার চটপট
ছাত্রেরা ছটফট–
ভয়ে সব পস্তায়,
বাড়ি ছেড়ে রাস্তায়,
গ্রাম ছেড়ে শহরে,
গয়া কাশী লাহোরে।
ফিরে আসে সন্ধ্যায়
পড়ে শোনে মন দেয়।।

বাসরে বাস! সাবাস বীর

বাসরে বাস! সাবাস বীর!
ধনুকখানি ধরে,
পায়রা দেখে মারলে তীর–
কাগটা গেল মরে!

বলছি ওরে, ছাগল ছানা

বলছি ওরে, ছাগল ছানা, উড়িস নে রে উড়িস নে।
জানিস তোদের উড়তে মানা– হাতপাগুলো ছুড়িস নে।।
তিন বুড়ো পণ্ডিত

তিন বুড়ো পণ্ডিত টাকচুড়ো নগরে
চড়ে এক গামলায় পাড়িড় দেয় সাগরে।
গামলাতে ছেদা ছিলো, আগে কেউ দেখেনি,
গানখানি তাই মোর থেমে গেল এখনি।।
রঙ হলো চিড়েতন

রঙ হল চিড়েতন, সব গেল গুলিয়ে,
গাধা যায় মামাবাড়ি, টাকে হাত বুলিয়ে
বেড়াল মরে বিষম খেয়ে চাঁদের ধরল মাথা,
হঠাৎ দেখি ঘরবাড়ি সব ময়দা দিয়ে গাথা ।।

চলে হন্ হন্

চলে হন্ হন্ ছোটে পন্ পন্
ঘোরে বন্ বন্ কাজে ঠন্ ঠন্
বায়ু শন্ শন্ শীতে কন্ কন্
কাশি খন্ খন্ ফোঁড়া টন্ টন্
মাছি ভন্ ভন্ থালা ঝন্ ঝন্

নাচন

নাচ্ছি মোরা মনের সাধে গাচ্ছি তেড়ে গান
হুলো মেনি যে যার গলায় কালোয়াতীর তান।
নাচ্ছি দেখে চাঁদা মামা হাসছে ভরে গাল
চোখটি ঠেরে ঠাট্টা করে, দেখনা বুড়ার চাল।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #34

 

– সুকুমার রায়

কল করেছেন আজবরকম চণ্ডীদাসের খুড়ো—
সবাই শুনে সাবাস বলে পাড়ার ছেলে বুড়ো।
খুড়োর যখন অল্প বয়স— বছর খানেক হবে—
উঠল কেঁদে ‘গুংগা’ বলে ভীষন অট্টরবে।
আর তো সবাই ‘মামা’ ‘গাগা’ আবোল তাবোল বকে,
খুড়োর মুখে ‘গুংগা’ শুনে চম্‌কে গেল লোকে।
বল্‌লে সবাই, “এই ছেলেটা বাঁচলে পরে তবে,
বুদ্ধি জোরে এ সংসারে একটা কিছু হবে।”
সেই খুড়ো আজ কল করেছেন আপন বুদ্ধি বলে,
পাঁচ ঘণ্টার রাস্তা যাবে দেড় ঘণ্টায় চলে।
দেখে এলাম কলটি অতি সহজ এবং সোজা,
ঘণ্টা পাঁচেক ঘাঁটলে পরে আপনি যাবে বোঝা।
বলব কি আর কলের ফিকির, বলতে না পাই ভাষা,
ঘাড়ের সঙ্গে যন্ত্র জুড়ে এক্কেবারে খাসা।

সামনে তাহার খাদ্য ঝোলে যার যেরকম রুচি—
মণ্ডা মিঠাই চপ্‌ কাট্‌লেট্‌ খাজা কিংবা লুচি।
মন বলে তায় ‘খাব খাব’, মুখ চলে তায় খেতে,
মুখের সঙ্গে খাবার ছোটে পাল্লা দিয়ে মেতে।
এমনি করে লোভের টানে খাবার পানে চেয়ে,
উত্সাহেতে হুঁস্ রবে না চলবে কেবল ধেয়ে।
হেসে খেলে দু‐দশ যোজন চলবে বিনা ক্লেশে,
খাবার গন্ধে পাগল হয়ে জিভের জলে ভেসে।
সবাই বলে সমস্বরে ছেলে জোয়ান বুড়ো,
অতুল কীর্তি রাখল ভবে চণ্ডীদাসের খুড়ো।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #35

 

– সুকুমার রায়

কোন্‌খানে কোন্‌ সুদূর দেশে, কোন্‌ মায়ের বুকে,
কাদের খোকা মিষ্টি এমন ঘুমায় মনের সুখে?
অজানা কোন্‌ দেশে সেথা কোন্‌খানে তার ঘর?
কোন্‌ সমুদ্র, কত নদী, কত দেশের পর?
কেমন সুরে, কি ব’লে মা ঘুমপাড়ানি গানে
খোকার চোখে নিত্যি সেথা ঘুমটি ডেকে আনে?
ঘুমপাড়ানি মাসীপিসী তাদেরও কি থাকে?
“ঘুমটি দিয়ে যাওগো” ব’লে মা কি তাদের ডাকে?
শেয়াল আসে বেগুন খেতে, বর্গি আসে দেশে?
ঘুমের সাথে মিষ্টি মধুর মায়ের সুরটি মেশে?
খোকা জানে মায়ের মুখটি সবার চেয়ে ভালো,
সবার মিষ্টি মায়ের হাসি, মায়ের চোখের আলো।
স্বপন মাঝে ছায়ার মত মায়ের মুখটি ভাসে,
তাইতে খোকা ঘুমের ঘোরে আপন মনে হাসে।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #36

 

– সুকুমার রায়

মোমের পুতুল লোমের পুতুল আগ্‌লে ধ’রে হাতে
তবুও কেন হাব্‌লা ছেলের মন ওঠে না তাতে?
একলা জেগে একমনেতে চুপ্‌টি ক’রে ব’সে,
আন্‌মনা সে কিসের তরে আঙুলখানি চোষে?
নাইকো হাসি নাইকো খেলা নাইকো মুখে কথা,
আজ সকালে হাব্‌লাবাবুর মন গিয়েছে কোথা?
ভাব্‌ছে বুঝি দুধের বোতল আস্‌ছে নাকো কেন?
কিংবা ভাবে মায়ের কিসে হচ্ছে দেরী হেন।
ভাব্‌ছে এবার দুধ খাবে না কেবল খাবে মুড়ি,
দাদার সাথে কোমন বেঁধে করবে হুড়োহুড়ি,
ফেল্‌বে ছুঁড়ে চামচটাকে পাশের বাড়ির চালে,
না হয় তেড়ে কামড়ে দেবে দুষ্টু ছেলের গালে।
কিংবা ভাবে একটা কিছু ঠুক্‌তে যদি পেতো—
পুতুলটাকে করত ঠুকে এক্কেবারে থেঁতো।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #37

 

– সুকুমার রায়

সিংহাসনে বস্‌ল রাজা বাজল কাঁসর ঘন্টা,
ছট্ফটিয়ে উঠল কেঁপে মন্ত্রীবুড়োর মনটা।
বললে রাজা, ‘মন্ত্রী, তোমার জামায় কেন গন্ধ?’
মন্ত্রী বলে, ‘এসেন্স দিছি- গন্ধ ত নয় মন্দ!’
রাজা বলেন, ‘মন্দ ভালো দেখুক শুঁকে বদ্যি,’
বদ্যি বলে, ‘আমার নাকে বেজায় হল সর্দি।’
রাজা হাঁকেন , ‘বোলাও তবে- রাম নারায়ণ পাত্র।’
পাত্র বলে, ‘নস্যি নিলাম এক্ষনি এইমাত্র-
নস্যি দিয়ে বন্ধ যে নাক, গন্ধ কোথায় ঢুকবে?’
রাজা বলেন, ‘কোটাল তবে এগিয়ে এস শুক্‌বে।’
কোটাল বলে, ‘পান খেয়েছি মশলা তাহে কর্পূর,
গন্ধে তারি মুন্ড আমার এক্কেবারে ভরপুর।’
রাজা বলেন, ‘আসুক তবে শের পালোয়ান ভীমসিং,’
ভমি বলে, ‘আজ কচ্ছে আমার সমস্ত গা ঝিম্ ঝিম্
রাত্রে আমার বোখার হল, বলছি হুজুর ঠিক বাৎ’-
ব’লেই শুল রাজসভাতে চক্ষু বুজে চিৎপাত।
রাজার শালা চন্দ্রেকেতু তারেই ধ’রে শেষটা
বল্ল রাজা, ‘তুমিই না হয় কর না ভাই চেষ্টা।’
চন্দ্র বলেন, ‘মারতে চাও ত ডাকাও নাকো জল্লাদ,
গন্ধ শুকে মর্‌তে হবে এ আবার কি আহ্লাদ?’
ছিল হাজির বৃদ্ধ নাজির বয়সটি তার নব্বই,
ভাব্‌ল মনে, ‘ভয় কেন আর একদিন তো মরবই-‘
সাহস করে বল্লে বুড়ো, ‘মিথ্যে সবাই বকছিস,
শুঁকতে পারি হুকুম পেলে এবং পেলে বক্‌শিস।’
রাজা বলেন, ‘হাজার টাকা ইনাম পাবে সদ্য,’
তাই না শুনে উৎসাহতে উঠ্ল বুড়ো মদ্দ।
জামার পরে নাক ঠেকিয়ে- শুক্‌ল কত গন্ধ,
রইল অটল, দেখ্ল লোকে বিস্ময়ে বাক্ বন্ধ।
রাজ্য হল জয় জয়কার বাজ্‌ল কাঁসর ঢক্কা,
বাপ্‌রে কি তেজ বুড়োর হাড়ে, পায় না সে যে অক্কা!

Bangla Kobita of Sukumar Ray #38

 

– সুকুমার রায়

‘এক যে রাজা’–’থাম্ না দাদা,
রাজা নয় সে, রাজ পেয়াদা৷’
‘তার যে মাতুল’–’মাতুল কি সে?—
সবাই জানে সে তার পিশে৷’
‘তার ছিল এক ছাগল ছানা’—
‘ছাগলের কি গজায় ডানা?’
‘একদিন তার ছাতের ‘পরে’—
‘ছাত কোথা হে টিনের ঘরে?’
‘বাগানের এক উড়ে মালী’—
‘মালী নয়তো! মেহের আলী৷’
‘মনের সাধে গাইছে বেহাগ’—
‘বেহাগ তো নয়! বসন্ত রাগ৷’

‘থও না বাপু ঘ্যাঁচা ঘেঁচি’—
‘আচ্ছা বল, চুপ করেছি৷’
‘এমন সময় বিছনা ছেড়ে,
হঠাৎ মামা আস্‌ল তেড়ে,
ধর্‌ল সে তার ঝুঁটির গোড়া’—
‘কোথায় ঝুঁটি? টাক যে ভরা৷’
‘হোক না টেকো তোর তাতে কি?
লক্ষীছাড়া মুখ্যু ঢেঁকি!
ধর্‌ব ঠেসে টুঁটির ‘পরে,
পিটব তোমার মুণ্ড ধ’রে—
কথার উপর কেবল কথা,
এখন বাপু পালাও কোথা?’

Bangla Kobita of Sukumar Ray #39

 

– সুকুমার রায়

গান জুড়েছেন গ্রীষ্মকালে ভীষ্মলোচন শর্মা—
আওয়াজখানা দিচ্ছে হানা দিল্লী থেকে বর্মা!
গাইছে ছেড়ে প্রাণের মায়া, গাইছে তেড়ে প্রাণপণ,
ছুটছে লোকে চারদিকেতে ঘুরছে মাথা ভন্‌ভন্।
মরছে কত জখম হয়ে করছে কত ছট্‌ফট্—
বলছে হেঁকে “প্রাণটা গেল, গানটা থামাও ঝট্‌পট্।”
বাঁধন‐ছেঁড়া মহিষ ঘোড়া পথের ধারে চিত্‍‌পাত;
ভীষ্মলোচন গাইছে তেড়ে নাইকো তাহে দৃক্‌পাত।
চার পা তুলি জন্তুগুলি পড়ছে বেগে মূর্ছায়,
লাঙ্গুল খাড়া পাগল পারা বলেছে রেগে “দূর ছাই!”

জলের প্রাণী অবাক মানি গভীর জলে চুপচাপ্,
গাছের বংশ হচ্ছে ধ্বংস পড়ছে দেদার ঝুপ্‌ঝাপ্।
শূন্য মাঝে ঘূর্ণা লেগে ডিগবাজি খায় পক্ষী,
সবাই হাঁকে, “আর না দাদা, গানটা থামাও লক্ষ্মী।”
গানের দাপে আকাশ কাঁপে দালান ফাটে বিল্‌কুল,
ভীষ্মলোচন গাইছে ভীষণ খোশমেজাজে দিল্ খুল্।
এক যে ছিল পাগলা ছাগল, এমনি সেটা ওস্তাদ,
গানের তালে শিং বাগিয়ে মারলে গুঁতো পশ্চাত্‍‌।
আর কোথা যায় একটি কথায় গানের মাথায় ডাণ্ডা,
‘বাপ রে’ বলে ভীষ্মলোচন এক্কেবারে ঠাণ্ডা।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #40

 

– সুকুমার রায়

হেড আফিসের বড়বাবু লোকটি বড় শান্ত,
তার যে এমন মাথার ব্যামো কেউ কখনো জান্‌ত?
দিব্যি ছিলেন খোসমেজাজে চেয়ারখানি চেপে,
একলা বসে ঝিম্‌ঝিমিয়ে হটাত্‍‌ গেলেন ক্ষেপে!
আঁত্‍‌কে উঠে হাত‐পা ছুঁড়ে চোখটি ক’রে গোল!
হটাত্‍‌ বলেন, “গেলুম গেলুম, আমায় ধ’রে তোল!”
তাই শুনে কেউ বদ্যি ডাকে, কেউ‐বা হাঁকে পুলিশ,
কেউ‐বা বলে, “কামড়ে দেবে সাবধানেতে তুলিস।”
ব্যস্ত সবাই এদিক‐ওদিক করছে ঘোরাঘুরি—
বাবু হাঁকেন, “ওরে আমার গোঁফ গিয়েছে চুরি!”
গোঁফ হারানো! আজব কথা! তাও কি হয় সত্যি?
গোঁফ জোড়া তো তেমনি আছে, কমে নি এক রত্তি।
সবাই তাঁরে বুঝিয়ে বলে, সামনে ধরে আয়না,
মোটেও গোঁফ হয় নি চুরি, কক্ষনো তা হয় না।

রেগে আগুন তেলে বেগুন, তেড়ে বলেন তিনি,
“কারো কথার ধার ধারি নে, সব ব্যাটাকেই চিনি।
নোংরা ছাঁটা খ্যাংরা ঝাঁটা বিচ্ছিরি আর ময়লা,
এমন গোঁফ তো রাখত জানি শ্যামবাবুদের গয়লা।
এ গোঁফ যদি আমার বলিস করব তোদের জবাই”—
এই না বলে জরিমানা কল্লেন তিনি সবায়।
ভীষণ রেগে বিষম খেয়ে দিলেন লিখে খাতায়—
“কাউকে বেশি লাই দিতে নেই, সবাই চড়ে মাথায়।
আফিসের এই বাঁদরগুলো, মাথায় খালি গোবর
গোঁফ জোড়া যে কোথায় গেল কেউ রাখে না খবর।
ইচ্ছে করে এই ব্যাটাদের গোঁফ ধরে খুব নাচি,
মুখ্যুগুলোর মুণ্ডু ধরে কোদাল দিয়ে চাঁচি।
গোঁফকে বলে তোমার আমার— গোঁফ কি কারো কেনা?
গোঁফের আমি গোঁফের তুমি, তাই দিয়ে যায় চেনা।”

Bangla Kobita of Sukumar Ray #41

 

– সুকুমার রায়

রৌদ্র ঝলে আকাশতলে অগ্নি জ্বলে জলেস্থলে।
ফেল্‌ছে আকাশ তপ্ত নিশাস ছুট্‌ছে বাতাস ঝলসিয়ে ঘাস,
ফুলের বিতান শুক্‌নো শ্মশান যায় বুঝি প্রাণ হায় ভগবান।
দারুণ তৃষায় ফির্‌ছে সবায় জল নাহি পায় হায় কি উপায়,
তাপের চোটে কথা না ফোটে হাঁপিয়ে ওঠে ঘর্ম ছোটে।
বৈশাখী ঝড় বাধায় রগড় করে ধড়্‌ফড়্‌ ধরার পাঁজর,
দশ দিক হয় ঘোর ধূলিময় জাগে মহাভয় হেরি সে প্রলয়,
করি তোলপাড় বাগান বাদাড় ওঠে বারবার ঘন হুঙ্কার,
শুনি নিয়তই থাকি থাকি ওই হাঁকে হৈ হৈ মাভৈ মাভৈঃ।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #42

 

– সুকুমার রায়

ঐ এল বৈশাখ, ঐ নামে গ্রীষ্ম,
খাইখাই রবে যেন ভয়ে কাঁপে বিশ্ব !
চোখে যেন দেখি তার ধুলিময় অঙ্গ,
বিকট কুটিলজটে ভ্রুকুটির ভঙ্গ,
রোদে রাঙা দুই আঁখি শুকায়েছে কোটরে,
ক্ষুধার আগুন যেন জ্বলে তার জঠরে !
মনে হয় বুঝি তার নিঃশ্বাস মাত্রে
তেড়ে আসে পালাজ্বর পৃথিবীর গাত্রে !
ভয় লাগে হয় বুঝি ত্রিভুবন ভস্ম-
ওরে ভাই ভয় নাই পাকে ফল শস্য !
তপ্ত ভীষণ চুলা জ্বালি নিজ বক্ষে
পৃথিবী বসেছে পাকে, চেয়ে দেখ চক্ষে,-
আম পাকে, জাম পাকে, ফল পাকে কত যে,
বুদ্ধি যে পাকে কত ছেলেদের মগজে !

Bangla Kobita of Sukumar Ray #43

 

– সুকুমার রায়

সর্বনেশে গ্রীষ্ম এসে বর্ষশেষে রুদ্রবেশে
আপন ঝোঁকে বিষম রোখে আগুন ফোঁকে ধরার চোখে।
তাপিয়ে গগন কাঁপিয়ে ভুবন মাত্‌ল তপন নাচল পবন।
রৌদ্র ঝলে আকাশতলে অগ্নি জ্বলে জলে স্থলে।
ফেল্‌ছে আকাশ তপ্ত নিশাস ছুটছে বাতাস ঝলসিয়ে ঘাস,
ফুলের বিতান শুকনো শ্মশান যায় বুঝি প্রাণ হায় ভগবান।
দারুণ তৃষায় ফিরছে সবায় জল নাহি পায় হায় কি উপায়,
তাপের চোটে কথা না ফোটে হাঁপিয়ে ওঠে ঘর্ম ছোটে।
বৈশাখী ঝড় বাধায় রগড় করে ধড়্‌ফড়্ ধরার পাঁজর,
দশ দিক হয় ঘোর ধুলিময় জাগে মহাভয় হেরি সে প্রলয়।
করি তোলপাড় বাগান বাদাড় ওঠে বারবার ঘন হুংকার,
শুনি নিয়তই থাকি থাকি ওই হাঁকে হৈ হৈ মাভৈ মাভৈঃ।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #44

 

– সুকুমার রায়

আরে ছি ছি! রাম রাম! ব’লো নাহে ব’লো না,
চল্‌ছে যা জুয়াচুরি, নাহি তার তুলনা!
যেই আমি দেই ঘুম টিফিনের আগেতে,
ভয়ানক ক’মে যায় খাবারের ভাগেতে!
রোজ দেখি খেয়ে গেছে, জানিনাকো কারা সে,
কালকে যা হ’য়ে গেল ডাকাতির বাড়া সে!
পাঁচখানা কাট্‌লেট‌, লুচি তিন গণ্ডা,
গোটা দুই জিবে গজা, গুটি দুই মণ্ডা,
আরো কত ছিল পাতে আলুভাজা ঘুঙ্‌নি—
ঘুম থেকে উঠে দেখি পাতাখানা শূন্যি!

তাই আজ ক্ষেপে গেছি—কত আর পার্‌ব?
এতদিন স’য়ে স’য়ে এইবারে মার্‌ব৷
খাড়া আছি সারাদিন হুঁশিয়ার পাহারা,
দেখে নেব রোজ রোজ খেয়ে যায় কাহারা৷
রামু হও, দামু হও, ওপাড়ার ঘোষ বোস্—
যেই হও, এইবারে থেমে যাবে ফোঁস্‌ফোঁস্৷
খাট্‌বে না জারিজুরি আঁটবে না মার্‌প্যাঁচ্
যারে পাব ঘাড়ে ধ’রে কেটে দেব ঘ্যাঁচ্‌ঘ্যাঁচ্৷
এই দেখ ঢাল নিয়ে খাড়া আছি আড়ালে,
এইবারে টের পাবে মুণ্ডুটা বাড়ালে৷

রোজ বলি ‘সাবধান!’ কানে তবু যায় না?
ঠেলাখানা বুঝ্‌বি তো এইবারে আয় না!

Bangla Kobita of Sukumar Ray #45

 

– সুকুমার রায়

ছবির টানে গল্প লিখি নেইক এতে ফাঁকি
যেমন ধারা কথায় শুনি হুবহু তাই আঁকি ।

পরীক্ষাতে গোল্লা পেয়ে
হাবু ফেরেন বাড়ি

চক্ষু দুটি ছানাবড়া
মুখখানি তার হাঁড়ি

রাগে আগুন হলেন বাবা
সকল কথা শুনে

আচ্ছা ক’রে পিটিয়ে তারে
দিলেন তুলো ধুনে

মারের চোটে চেঁচিয়ে বাড়ি
মাথায় ক’রে তোলে

শুনে মায়ের বুক ফেটে যায়
‘হায় কি হল’ ব’লে

পিসী ভাসেন চোখের জলে
কুট্‌নো কোটা ফেলে

আহ্লাদেতে পাশের বাড়ি
আটখানা হয় ছেলে ।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #46

 

– সুকুমার রায়

আজগুবি নয়, আজগুবি নয়, সত্যিকারের কথা—
ছয়ার সাথে কুস্তি করে গাত্রে হল ব্যথা ।
ছায়া ধরার ব্যাবসা করি তাও জানোনা বুঝি ?
রোদের ছায়া, চাঁদের ছায়া, হরেক রকম পুঁজি !
শিশির ভেজা সদ্য ছায়া, সকাল বেলায় তাজা,
গ্রীষ্মকালে শুকনো ছায়া ভীষণ রোদে ভাজা ।
চিলগুলো যায় দুপুরবেলায় আকাশ পথে ঘুরে,
ফাঁদ ফেলে তার ছায়ার উপর খাঁচায় রাখি পুরে ।
কাগের ছায়া বগের ছায়া কত ঘেঁটে
হাল্কা মেঘের পানসে ছায়া তাও দেখেছি চেটে।
কেউ জানে না এ–সব কথা কেউ বোঝে না কিছু,
কেউ ঘোরে না আমার মত ছায়ার পিছুপিছু।
তোমরা ভাব গাছের ছায়া অমনি লুটায় ভূঁয়ে,
অমনি শুধু ঘুমায় বুঝি শান্ত মত শুয়ে;
আসল ব্যাপার জানবে যদি আমার কথা শোনো,
বলছি যা তা সত্যি কথা, সন্দেহ নাই কোনো।
কেউ যবে তার রয়না কাছে, দেখতে নাহি পায়,
গাছের ছায়া ফটফটিয়ে এদিক ওদিক চায়।
সেই সময়ে গুড়গুড়িয়ে পিছন হতে এসে
ধামায় চেপে ধপাস করে ধরবে তারে ঠেসে।
পাতলা ছায়া, ফোকলা ছায়া, ছায়া গভীর কালো—
গাছের চেয়ে গাছের ছায়া সব রকমেই ভাল।

গাছ গাছালি শেকড় বাকল মিথ্যে সবাই গেলে,
বাপ্‌রে বলে পালায় ব্যামো ছায়ার ওষুধ খেলে।
নিমের ছায়া ঝিঙের ছায়া তিক্ত ছায়ার পাক,
যেই খাবে ভাই অঘোর ঘুমে ডাকবে তাহার নাক।
চাঁদের আলোয় পেঁপের ছায়া ধরতে যদি পারো,
শুঁকলে পরে সর্দিকাশি থাকবে না আর কারো।
আমড়া গাছের নোংরা ছায়া কামড়ে যদি খায়,
লাংড়া লোকের ঠ্যাং গজাবে সন্দেহ নেই তায়।
আষাঢ় মাসের বাদলা দিনে বাঁচতে যদি চাও,
তেঁতুল তলার তপ্ত ছায়া হপ্তা তিনেক খাও।
মৌয়া গাছের মিষ্টি ছায়া ‘ব্লটিং’ দিয়ে শুষে,
ধুয়ে মুছে সাবধানেতে রাখছি ঘরে পুষে!
পাক্কা নতুন টাট্‌কা ওষুধ এক্কেবারে দিশি—
দাম করেছি সস্তা বড় চোদ্দ আনা শিশি।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #47

 

– সুকুমার রায়

ঘুচবে জ্বালা পুঁথির পালা ভাবছি সারাক্ষণ-
পোড়া স্কুলের পড়ার পরে আর কি বসে মন ?
দশটা থেকেই নষ্ট খেলা, ঘণ্টা হতেই শুরু
প্রাণটা করে ‘পালাই পালাই’ মনটা উড়ু উড়ু-
পড়ার কথা খাতায়, পাতায়, মাথায় নাহি ঢোকে !
মন চলে না- মুখ চলে যায় আবোলতাবোল ব’কে !
কানটা ঘোরে কোন্‌ মুলুকে হুঁশ থাকে না তার,
এ কান দিয়ে ঢুকলে কথা, ও কান দিয়ে পার ।
চোখ থাকে না আর কিছুতেই, কেবল দেখে ঘড়ি ;
বোর্ডে আঁকা অঙ্ক ঠেকে আঁচড়কাটা খড়ি ।
কল্পনাটা স্বপ্নে চ’ড়ে ছুটছে মাঠে ঘাটে-
আর কি রে মন বাঁধন মানে ? ফিরতে কি চায় পাঠে ?
পড়ার চাপে ছট্‌ফটিয়ে আর কিরে দিন চলে ?
ঝুপ্‌ ক’রে মন ঝাঁপ দিয়ে পড়্‌ ছুটির বন্যাজলে ।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #48

 

– সুকুমার রায়

ছুটি! ছুটি! ছুটি!
মনের খুশি রয়না মনে হেসেই লুটোপুটি।
ঘুচল এবার পড়ার তাড়া অঙ্ক কাটাকুটি
দেখ্‌ব না আর পন্ডিতের ঐ রক্ত আঁখি দুটি।
আর যাব না স্কুলের পানে নিত্য গুটি গুটি
এখন থেকে কেবল খেলা কেবল ছুটোছুটি।
পাড়ার লোকের ঘুম ছুটিয়ে আয়রে সবাই জুটি
গ্রীষ্মকালের দুপুর রোদে গাছের ডালে উঠি
আয়রে সবাই হল্লা ক’রে হরেক মজা লুটি
একদিন নয় দুই দিন নয় দুই দুই মাস ছুটি।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #49

 

– সুকুমার রায়

পেটমোটা জালা কয়, “হেসে আমি মরিরে
কুঁজো তোর হেন গলা এতটুকু শরীরে!”
কুঁজো কয়, “কথা কস্ আপনাকে না চিনে,
ভুঁড়িখানা দেখে তোর কেঁদে আর বাঁচিনে।”
জালা কয়, “সাগরের মাপে গড়া বপুখান,
ডুবুরিরা কত তোলে তবু জল অফুরান।”
কুঁজো কয়, “ভালো কথা ! তবে যদি দৈবে,
ভুঁড়ি যায় ভেস্তিয়ে, জল কোথা রইবে?”
“নিজ কথা ভুলে যাস?” জালা কয় গর্জে,
“ঘাড়ে ধরে হেঁট ক’রে জল নেয় তোর যে।”
কুঁজো কয়, “নিজ পায়ে তবু খাড়া রই তো-
বিঁড়ে বিনা কুপোকাৎ, তেজ তোর ঐতো।”

Bangla Kobita of Sukumar Ray #50

 

– সুকুমার রায়

বিদ্যেবোঝাই বাবুমশাই চড়ি সখের বোটে
মাঝিরে কন , “বলতে পারিস্ সূর্যি কেন ওঠে?
চাঁদটা কেন বাড়ে কমে? জোয়ার কেন আসে?”
বৃদ্ধ মাঝি অবাক হয়ে ফ্যাল্‌ফেলিয়ে হাসে।
বাবু বলেন, “সারা জনম মরলিরে তুই খাটি,
জ্ঞান বিনা তোর জীবনটা যে চারি আনাই মাটি!”

খানিক বাদে কহেন বাবু,”বলত দেখি ভেবে
নদীর ধারা কেম্‌নে আসে পাহাড় হতে নেবে?
বলত কেন লবণপোরা সাগরভরা পানি?”
মাঝি সে কয়, “আরে মশাই , অত কি আর জানি?”
বাবু বলেন, “এই বয়সে জানিসনেও তা কি?
জীবনটা তোর নেহাৎ খেলো, অষ্ট আনাই ফাকি।”

আবার ভেবে কহেন বাবু, “বলতো ওরে বুড়ো,
কেন এমন নীল দেখা যায় আকাশের ঐ চুড়ো?
বল্‌তো দেখি সূর্য চাঁদে গ্রহণ লাগে কেন?”
বৃদ্ধ বলে, “আমায় কেন লজ্জা দেছেন হেন?”
বাবু বলেন, “বলব কি আর, বলব তোরে কি তা,-
দেখছি এখন জীবনটা তোর বারো আনাই বৃথা।”

খানিক বাদে ঝড় উঠেছে, ঢেউ উঠেছে ফুলে,
বাবু দেখেন নৌকাখানি ডুব্‌ল বুঝি দুলে।
মাঝিরে কন, “একি আপদ! ওরে ও ভাই মাঝি,
ডুবল নাকি নৌকো এবার ? মরব নাকি আজি?”
মাঝি শুধায়, “সাঁতার জানো? মাথা নাড়েন বাবু”
মুর্খ মাঝি বলে, “মশাই , এখন কেন কাবু?
বাঁচলে শেষে আমার কথা হিসেব কারো পিছে,
তোমার দেখি জীবনখানা ষোল আনাই মিছে!”

Bangla Kobita of Sukumar Ray #51

 

– সুকুমার রায়

টিক্‌ টিক্‌ চলে ঘড়ি, টিক্‌ টিক্‌ টিক্‌,
একটা ইঁদুর এল সে সময়ে ঠিক।
ঘড়ি দেখে একলাফে তাহাতে চড়িল,
টং করে অমনি ঘড়ি বাজিয়া উঠিল।
অমনি ইঁদুরভায়া ল্যাজ গুটাইয়া,
ঘড়ির উপর থেকে পড়ে লাফাইয়া।
ছুটিয়া পালায়ে গেল আর না আসিল,
টিক্‌ টিক্‌ টিক্‌ ঘড়ি চলিতে লাগিল।।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #52

 

– সুকুমার রায়

ট্যাঁশ্ গরু গরু নয়, আসলেতে পাখি সে;
যার খুশি দেখে এস হারুদের আফিসে।
চোখ দুটি ঢুলু ঢুলু, মুখখান মস্ত,
ফিট্‌ফাট্ কালোচুলে টেরিকাটা চোস্ত।
তিন-বাঁকা শিং তার ল্যাজখানি প্যাঁচান-
একটুকু ছোঁও যদি, বাপরে কি চ্যাঁচান!
লট্খটে হাড়গোড় খট্‌খট্ ন’ড়ে যায়,
ধম্‌কালে ল্যাগ্‌ব্যাগ চমকিয়ে প’ড়ে যায়।
বর্ণিতে রূপ গুণ সাধ্য কি কবিতার,
চেহারার কি বাহার- ঐ দেখ ছবি তার।
ট্যাঁশ্ গরু খাবি খায় ঠ্যাস্ দিয়ে দেয়ালে,
মাঝে মাঝে কেঁদে ফেলে না জানি কি খেয়ালে ;
মাঝে মাঝে তেড়ে ওঠে, মাঝে মাঝে রেগে যায়,
মাঝে মাঝে কুপোকাৎ দাঁতে দাঁত লেগে যায়।

খায় না সে দানাপানি- ঘাস পাতা বিচালি
খায় না সে ছোলা ছাতু ময়দা কি পিঠালি;
রুচি নাই আমিষেতে, রুচি নাই পায়েসে
সাবানের সুপ আর মোমবাতি খায় সে।
আর কিছু খেলে তার কাশি ওঠে খক্‌খক্,
সারা গায়ে ঘিন্ ঘিন্ ঠ্যাং কাঁপে ঠক্‌ঠক্।
একদিন খেয়েছিল ন্যাকড়ার ফালি সে-
তিন মাস আধমরা শুয়েছিল বালিশে।
কারো যদি শখ্ থাকে ট্যাঁশ গরু কিনতে ,
সস্তায় দিতে পারি,দেখ ভেবে চিন্তে।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #53

 

– সুকুমার রায়

আরে আরে জগমোহন- এস ,এস,এস-
বলতে পার কোথায় থাকে আদ্যনাথের মেশো?
আদ্যনাথের নাম শোননি? খগেনকে তো চেনো?
শ্যাম বাগচি খগেনেরই মামাশ্বশুর জেনো।
শ্যামের জামাই কেষ্টমোহন, তার যে বাড়ীওলা-
(কি যেন নাম ভুলে গেছি), তারই মামার শালা;
তারই পিশের খড়তুতো ভাই আদ্যনাথের মেশো-
লক্ষী দাদা ,ঠিকানা তার একটু জেনে এসো।
ঠিকানা চাও? বলছি শোন; আমড়াতলার মোড়ে
তিন-মুখো তিন রাস্তা গেছে তারি একটা ধ’রে,
চলবে সিধে নাক বরাবর, ডান দিকে চোখ রেখে;
চলতে চলতে দেখবে শেষে রাস্তা গেছে বেঁকে।
দেখবে সেথায় ডাইনে বায়ে পথ গিয়াছে কত,
তারি ভিতর ঘুরবে খানিক গোলকধাঁধাঁর মত।
তারপরেতে হঠাৎ বেঁকে ডাইনে মোচর মেরে ,
ফিরবে আবার বাঁয়ের দিকে তিনটে গলি ছেড়ে।
তবেই আবার পড়বে এসে আমড়া তলার মোড়ে-
তারপরে যাও যেথায় খুশি- জ্বালিয়ে নাকো মোরে ।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #54

 

– সুকুমার রায়

বাপ্‌রে কি ডানপিটে ছেলে!-
কোন দিন ফাঁসি যাবে নয় যাবে জেলে।
একটা সে ভুত সেজে আঠা মেখে মুখে,
ঠাঁই ঠাই শিশি ভাঙে শ্লেট দিয়ে ঠুকে।
অন্যটা হামা দিয়ে আলমারি চড়ে,
খাট থেকে রাগ ক’রে দুম্‌দাম্ পড়ে।

বাপরে কি ডানপিটে ছেলে!-
শিলনোড়া খেতে চায় দুধভাত ফেলে!
একটার দাঁত নেই, জিভ দিয়ে ঘষে,
একমনে মোমবাতি দেশলাই চোষে!
আরজন ঘরময় নীল কালি গুলে,
কপ্ কপ্ মাছি ধরে মুখে দেয় তুলে!

বাপরে কি ডানপিটে ছেলে!-
খুন হ’ত টম্ চাচা ওই রুটি খেলে!
সন্দেহে শুঁকে বুড়ো মুখে নাহি তোলে,
রেগে তাই দুই ভাই ফোঁস্ ফোঁস্ ফোলে!
নেড়াচুল খাড়া হয়ে রাঙা হয় রাগে,
বাপ্ বাপ্ ব’লে চাচা লাফ দিয়ে ভাগে।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #55

 

– সুকুমার রায়

চলে খচ্‌খচ্ রাগে গজ্‌গজ্ জুতো মচ্‌মচ্ তানে,
ভুরু কট্‌মট্ ছড়ি ফট্‌ফট্ লাথি চট্‌পট্ হানে।
দেখে বাঘ-রাগ লোকে ‘ভাগ ভাগ’ করে আগভাগ থেকে,
বয়ে লাফ ঝাঁপ বলে ‘বাপ্ বাপ্’ সবে হাবভাব দেখে।
লাথি চার চার খেয়ে মার্জার ছোটে যার যার ঘরে,
মহা উৎপাত ক’রে হুটপাট্ চলে ফুটপাথ্ পরে।
ঝাড়ু–বর্দার হারুসর্দার ফেরে ঘরদ্বার ঝেড়ে,
তারি বালতিএ- দেখে ফাল্ দিয়ে আসে পালটিয়ে তেড়ে।
রেগে লালমুখে হেঁকে গাল রুখে মারে তাল ঠুকে দাপে,
মারে ঠন্‌ঠন্ হাড়ে টন্‌টন্ মাথা ঝন ঝন কাঁপে!
পায়ে কলসিটে! কেন বাল্‌তিতে মেরে চাল দিতে গেলে?
বুঝি ঠ্যাং যায় খোঁড়া ল্যাংচায় দেখে ভ্যাংচায় ছেলে।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #56

 

– সুকুমার রায়

ছুটছে মটর ঘটর ঘটর ছুটছে গাড়ী জুড়ি,
ছুটছে লোকে নানান্ ঝোঁকে করছে হুড়োহুড়ি;
ছুটছে কত ক্ষ্যাপার মতো পড়ছে কত চাপা,
সাহেবমেমে থমকে থেমে বলছে ‘মামা পাপা!’
আমরা তবু তবলা ঠুকে গাচ্ছি কেমন তেড়ে
‘দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম্! দেড়ে দেড়ে দেড়ে!’
বর্ষাকালে বৃষ্টিবাদল রাস্তা জুড়ে কাদা,
ঠাণ্ডা রাতে সর্দিবাতে মরবি কেন দাদা?
হোক্ না সকাল হোক্ না বিকাল
হোক্ না দুপুর বেলা,
থাক্ না তোমার আপিস যাওয়া
থাক্ না কাজের ঠেলা—
এই দেখ না চাঁদনি রাতের গান এনেছি কেড়ে,
‘দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম্! দেড়ে দেড়ে দেড়ে!’

মুখ্যু যারা হচ্ছে সারা পড়ছে ব’সে একা,
কেউবা দেখ কাঁচুর মাচুর
কেউ বা ভ্যাবাচ্যাকা৷
কেউ বা ভেবে হদ্দ হল, মুখটি যেন কালি
কেউ বা ব’সে বোকার মতো মুণ্ডু নাড়ে খালি৷
তার চেয়ে ভাই, ভাবনা ভুলে গাওনা গলা ছেড়ে,
‘দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম্! দেড়ে দেড়ে দেড়ে!’
বেজার হয়ে যে যার মতো করছ সময় নষ্ট,
হাঁটছ কত খাটছ কত পাচ্ছ কত কষ্ট!
আসল কথা বুঝছ না যে, করছ না যে চিন্তা,
শুনছ না যে গানের মাঝে তবলা বাজে ধিন্‌তা?
পাল্লা ধরে গায়ের জোরে গিটকিরি দাও ঝেড়ে,
‘দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম্! দেড়ে দেড়ে দেড়ে!’

Bangla Kobita of Sukumar Ray #57

 

– সুকুমার রায়

চুপ কর্ শোন্ শোন্, বেয়াকুফ হোস্ নে
ঠেকে গেছি বাপ্ রে কি ভয়ানক প্রশ্নে!
ভেবে ভেবে লিখে লিখে বসে বসে দাঁড়েতে
ঝিম্‌ঝিম্ টন্‌টন্ ব্যথা করে হাড়েতে।
এক ছিল দাঁড়ি মাঝি— দাড়ি তার মস্ত,
দাড়ি দিয়ে দাঁড়ি তার দাঁড়ে খালি ঘষ্‌ত।
সেই দাঁড়ে একদিন দাঁড়কাক দাঁড়াল,
কাঁকড়ার দাঁড়া দিয়ে দাঁড়ি তারে তাড়াল।
কাক বলে রেগেমেগে, “বাড়াবাড়ি ঐতো!
না দাঁড়াই দাঁড়ে তবু দাঁড়কাক হই তো?
ভারি তোর দাঁড়িগিরি, শোন্ বলি তবে রে—
দাঁড় বিনা তুই ব্যাটা দাঁড়ি হোস্ কবে রে?
পাখা হলে ‘পাখি’ হয় ব্যাকরণ বিশেষে—
কাঁকড়ার দাঁড়া আছে, দাঁড়ি নয় কিসে সে?
দ্বারে বসে দারোয়ান, তারে যদি ‘দ্বারী’ কয়,
দাঁড়ে-বসা যত পাখি সব তবে দাঁড়ি হয়!
দূর দূর! ছাই দাঁড়ি! দাড়ি নিয়ে পাড়ি দে!”
দাঁড়ি বলে, “বাস্ বাস্! ঐখেনে দাঁড়ি দে।”

Bangla Kobita of Sukumar Ray #58

 

– সুকুমার রায়

দাদা গো দাদা, সত্যি তোমার সুরগুলো খুব খেলে!
এম্‌‌নি মিঠে- ঠিক যেন কেউ গুড় দিয়েছে ঢেলে!
দাদা গো দাদা, এমন খাসা কণ্ঠ কোথায় পেলে?-
এই খেলে যা! গান শোনাতে আমার কাছেই এলে?
দাদা গো দাদা, পায়ে পড়ি তোর, ভয় পেয়ে যায় ছেলে-
গাইবে যদি ঐখেনে গাও, ঐ দিকে মুখ মেলে ।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #59

 

– সুকুমার রায়

ভোর না হতে পাখিরা জোটে গানের চোটে ঘুমটি ছোটে-
চোখ্‌টি খোলো, গাত্র তোলো আরে মোলো সকাল হলো।
হায় কি দশা পড়্‌তে বসা অঙ্ক কষা, কলম ঘষা।
দশটা হলে হট্টগোলে দৌড়ে চলে বই বগলে!
স্কুলের পড়া বিষম তাড়া, কানটি নাড়া বেঞ্চে দাঁড়া
মরে কি বাঁচে! সমুখে পাছে বেত্র নাচে নাকের কাচে।।
খেলতে যে চায় খেল্‌বে কি ছাই বৈকেলে হায় সময় কি পায়?
খেলাটি ক্রমে যেম্‌নি জমে দখিনে বামে সন্ধ্যা নামে;
ভাঙ্‌ল মেলা সাধের খেলা- আবার ঠেলা সন্ধ্যাবেলা-
মুখ্‌টি হাঁড়ি তাড়াতাড়ি দিচ্ছে পাড়ি যে যার বাড়ি।
ঘুমের ঝোঁকে ঝাপ্‌সা চোখে ক্ষীণ আলোকে অঙ্ক টোকে ;
ছুটি পাবার সুযোগ আবার আয় রবিবার হপ্তা কাবার!

Bangla Kobita of Sukumar Ray #60

 

– সুকুমার রায়

হঠাৎ কেন দুপুর রোদে চাদর দিয়ে মুড়ি,
চোরের মত নন্দগোপাল চলছে গুড়ি গুড়ি?
লুকিয়ে বুঝি মুখোশখানা রাখছে চুপি চুপি?
আজকে রাতে অন্ধকারে টেরটা পাবেন গুপি!

আয়না হাতে দাঁড়িয়ে গুপি হাসছে কেন খালি?
বিকট রকম পোশাক করে মাখছে মুখে কালি!
এম্মি করে লম্ফ দিয়ে ভেংচি যখন দেবে
নন্দ কেমন আঁৎকে যাবে -হাস্‌ছে সে তাই ভেবে।

আঁধার রাতে পাতার ফাঁকে ভূতের মতন কে রে?
ফন্দি এঁটে নন্দগোপাল মুখোশ মুখে ফেরে!
কোথায় গুপি, আসুক না সে ইদিক্ পানে ঘুরে-
নন্দদাদার হুঙ্কারে তার প্রাণটি যাবে উড়ে।

হেথায় কে রে মূর্তি ভীষণ মুখটি ভরা গোঁফে?
চিমটে হাতে জংলা গুপি বেড়ায় ঝাড়ে ঝোপে!
নন্দ যখন বাড়ির পথে আসবে গাছের আড়ে,
“মার্ মার্ মার কাট্‌রে”লে পড়বে তাহার ঘাড়ে।

নন্দ চলেন এক পা দু পা আস্তে ধীরে গতি,
টিপ্‌টিপিয়ে চলেন গুপি সাবধানেতে অতি-
মোড়ের মুখে ঝোপের কাছে মার্‌তে গিয়ে উকি
দুই সেয়ানে এক্কেবারে হঠাৎ মুখোমুখি!

নন্দ তখন ফন্দি ফাঁদন কোথায় গেল ভুলি
কোথায় গেল গুপির মুখে মার্ মার্ মার্ বুলি।
নন্দ পড়েন দাঁতকপাটি মুখোশ টুখোশ ছেড়ে
গুপির গায়ে জ্বরটি এল কম্প দিয়ে তেড়ে
গ্রামের লোকে দৌড়ে তখন বদ্যি আনে ডেকে,
কেউ বা নাচে কেউ বা কাঁদে রকম সকম দেখে।
নন্দগুপির মন্দ কপাল এম্‌নি হল শেষে,
দেখ্‌লে তাদের লুটোপুটি সবাই মেরে হেসে।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #61

 

– সুকুমার রায়

নাচ্ছি মোরা মনের সাধে গাচ্ছি তেড়ে গান
হুলো মেনী যে যার গলার কালোয়াতীর তান।
নাচ্ছি দেখে চাঁদা মামা হাস্‌ছে ভরে গাল
চোখটি ঠেরে ঠাট্টা করে দেখ্‌না বুড়োর চাল।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #62

 

– সুকুমার রায়

বয়স হল অষ্টআশি, চিমসে গায়ে ঠুন্‌কো হাড়,
নাচছে বুড়ো উল্টোমাথায়- ভাঙলে বুঝি মুন্ডু ঘাড়!
হেঁইয়ো ব’লে হাত পা ছেড়ে পড়ছে তেড়ে চিৎপটাং,
উঠছে আবার ঝট্পটিয়ে এক্কেবারে পিঠ সটান্।
বুঝিয়ে বলি, ‘বৃদ্ধ তুমি এই বয়েসে কর্‌ছ কি?
খাও না খানিক মশলা গুলে হুঁকোর জল আর হরতকী।
ঠান্ডা হবে মাথায় আগুন, শান্ত হবে ছটফ্‌টি-‘
বৃদ্ধ বলে, ‘থাম্ না বাপু সব তাতে তোর পট্‌পটি!
ঢের খেয়েছি মশ্‌লা পাঁচন, ঢের মেখেছি চর্বি তেল,
তুই ভেবেছিস আমায় এখন চাল্ মেরে তুই করবি ফেল?’
এই না ব’লে ডাইনে বাঁয়ে লম্ফ দিয়ে হুশ ক’রে
হঠাৎ খেয়ে উল্টোবাজি ফেললে আমায় ‘পুশ’ করে।
‘নাচলে অমন উল্টো রকম, আবার বলি বুঝিয়ে তায়,
রক্তগুলো হুড়হুড়িয়ে মগজ পানে উজিয়ে যায়।’
বললে বুড়ো, ‘কিন্তু বাবা, আসল কথা সহজ এই-
ঢের দেখেছি পরখ্ করে কোথাও আমার মগজ নেই।
তাইতে আমরা হয় না কিছু- মাথায় যে সব ফক্কিফাঁক-
যতটা নাচি উল্টো নাচন, যতই না খাই চর্কিপাক।

বলতে গেলাম ‘তাও কি হয়’- অম্নি হঠাৎ ঠ্যাং নেড়ে
আবার বুড়ো হুড়মুড়িয়ে ফেললে আমায় ল্যাং মেরে।
ভাবছি সবে মারব ঘুঁষি এবার বুড়োর রগ্ ঘেঁষে,
বললে বুড়ো ‘করব কি বল্ ? করায় এ সব অভ্যেসে।
ছিলাম যখন রেল-দারোগা চড়্‌তে হত ট্রেইনেতে
চলতে গিয়ে ট্রেনগুলো সব পড়ত প্রায়ই ড্রেইনেতে।
তুব্‌ড়ে যেত রেলের গাড়ি লাগত গুঁতো চাক্কাতে,
ছিটকে যেতাম যখন তখন হঠাৎ এক এক ধাক্কাতে।
নিত্যি ঘুমাই এক চোখে তাই, নড়লে গাড়ি- অম্নি ‘বাপ্-
এম্-নি ক’রে ডিগ্‌বাজিতে এক্কেবারে শুন্য লাফ।
তাইতে হল নাচের নেশা, হঠাৎ হঠাৎ নাচন পায়,
বসতে শুতে আপ্‌নি ভুলে ডিগ্‌বাজি খাই আচম্কােয়!
নাচতে গিয়ে দৈবে যদি ঠ্যাং লাগে তোর পাজরাতে,
তাই বলে কি চটতে হবে? কিম্বা রাগে গজ্‌রাতে?’
আমিও বলি, ‘ঘাট হয়েছে তোমার খুরে দন্ডবৎ!
লাফাও তুমি যেমন খুশি, আমরা দেখি অন্য পথ।’

Bangla Kobita of Sukumar Ray #63

 

– সুকুমার রায়

“হ্যাঁরে হ্যাঁরে তুই নাকি কাল, সাদাকে বলছিলি লাল?
(আর) সেদিন নাকি রাত্রি জুড়ে, নাক ডেকেছিস্ বিশ্রী সুরে?
(আর) তোদের পোষা বেড়ালগুলো, শুন্‌ছি নাকি বেজায় হুলো?
(আর) এই যে শুনি তোদের বাড়ি, কেউ নাকি রাখে না দাড়ি?
ক্যান্ রে ব্যাটা ইসটুপিড? ঠেঙিয়ে তোরে করব ঢিট্!”
“চোপরাও তুম্ স্পিকটি নট্, মার্‌ব রেগে পটাপট্-
ফের যদি ট্যারাবি চোখ, কিম্বা আবার কর্‌বি রোখ,
কিম্বা যদি অম্‌নি ক’রে, মিথ্যেমিথ্যি চ্যাঁচাস জোরে-
আই ডোন্ট কেয়ার কানাকড়ি- জানিস্ আমি স্যান্ডো করি?”
“ফের লাফাচ্ছিস্! অল্‌রাইট, কামেন্ ফাইট ! কামেন্ ফাইট!”
“ঘুঘু দেখেছ, ফাঁদ দেখনি, টেরটা পাবে আজ এখনি!
আজকে যদি থাক্‌ত মামা, পিটিয়ে তোমায় করত ধামা।”
“আরে! আরে! মার্‌বি নাকি? দাঁড়া একটা পুলিশ ডাকি!”
“হাঁহাঁহাঁহাঁ! রাগ করো না, করতে চাও কি তাই বল না!”
“হাঁ হাঁ তাতো সত্যি বটেই, আমি তো চটিনি মোটেই!
মিথ্যে কেন লড়তে যাবি? ভেরি- ভেরি সরি মশলা খাবি?”
“শেক্হ্যান্ড আর দাদা বল, সব শোধ বোধ ঘরে চল।”
“ডোন্ট পরোয়া অল্ রাইট্, হাউ ডু য়ু ডু গুড্ নাইট।”

Bangla Kobita of Sukumar Ray #64

 

– সুকুমার রায়

গোপালটা কি হিংসুটে মা! খাবার দিলেম ভাগ করে,
বল্লে নাকো মুখেও কিছু, ফেল্লে ছুঁড়ে রাগ করে।
জ্যেঠাইমা যে মেঠাই দিলেন, ‘দুই ভায়েতে খাও বলে’−
দশটি ছিল, একটি তাহার চাখতে দিলেম ফাও বলে,
আর যে নটি, ভাগ করে তায় তিনটে দিলেম গোপালকে−
তবুও কেবল হ্যাংলা ছেলে আমার ভাগেই চোখ রাখে।
বুঝিয়ে বলি, কাঁদিস কেন? তুই যে নেহাৎ কনিষ্ঠ,
বয়স বুঝে, সামলে খাবি, তা নইলে হয় অনিষ্ট।
তিনটি বছর তফাৎ মোদের, জ্যায়দা হিসাব গুণতি তাই,
মোদ্দা আমার ছয়খানি হয়, তিন বছরে তিনটি পাই,
তাও মানে না কেবল কাঁদে, স্বার্থপরের শয়তানি,
শেষটা আমার মেঠাইগুলো খেতেই হলো সবখানি।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #65

 

– সুকুমার রায়

বসি বছরের পয়লা তারিখে
মনের খাতায় রাখিলাম লিখে-
“সহজ উদরে ধরিবে যেটুক্,
সেইটুকু খাব হব না পেটুক।”
মাস দুই যেতে খাতা খুলে দেখি,
এরি মাঝে মন লিখিয়াছে একি!
লিখিয়াছে, “যদি নেমন্তন্নে
কেঁদে ওঠে প্রাণ লুচির জন্যে,
উচিত হবে কি কাঁদান তাহারে?
কিম্বা যখন বিপুল আহারে ,
তেড়ে দেয় পাতে পোলাও কালিয়া
পায়েস অথবা রাবড়ি ঢালিয়া-
তখন কি করি, আমি নিরূপায়!
তাড়াতে না পারি, বলি আয় আয়,
ঢুকে আয় মুখে দুয়ার ঠেলিয়া
উদার রয়েছি উদর মেলিয়া!”

Bangla Kobita of Sukumar Ray #66

 

– সুকুমার রায়

‘নূতন বছর ! নূতন বছর !’ সবাই হাঁকে সকাল সাঁঝে
আজকে আমার সূর্যি মামার মুখটি জাগে মনের মাঝে ।
মুস্কিলাসান করলে মামা, উস্কিয়ে তার আগুনখানি,
ইস্কুলেতে লাগ্‌ল তালা, থাম্‌ল সাধের পড়ার ঘানি ।
এক্‌জামিনের বিষম ঠেলা চুক্‌ল রে ভাই ঘুচ্ল জ্বালা,
নূতন সালের নূতন তালে হোক্‌ তবে আস ‘হকির’ পালা ।
কোন্‌খানে কোন্‌ মেজের কোণে, কলম কানে, চশমা নাকে,
বিরামহারা কোন্‌ বেচারা দেখেন কাগজ, ভয় কি তাঁকে ?
অঙ্কে দিবেন হকির গোলা, শঙ্কা ত নাই তাহার তরে,
তঙ্কা হাজার মিলুক তাঁহার, ডঙ্কা মেরে চলুন ঘরে ।
দিনেক যদি জোটেন খেলায় সাঁঝের বেলায় মাঠের মাঝে,
‘গোল্লা’ পেয়ে ঝোল্লা ভরে আবার না হয় যাবেন কাজে !
আয় তবে আয়, নবীন বরষ ! মলয় বায়ের দোলায় দুলে,
আয় সঘনে গগন বেয়ে, পাগলা ঝড়ের পালটি তুলে ।
আয় বাংলার বিপুল মাঠে শ্যামল ধানের ঢেউ খেলিয়ে,
আয়রে সুখের ছুটির দিনে আম-কাঁটালের খবর নিয়ে !
আয় দুলিয়ে তালের পাখা, আয় বিছিয়ে শীতল ছায়া,
পাখির নীড়ে চাঁদের হাটে আয় জাগিয়ে মায়ের মায়া ।
তাতুক না মাঠ, ফাটুক না কাঠ, ছুটুক না ঘাম নদীর মত,
জয় হে তোমার, নূতন বছর ! তোমার যে গুণ, গাইব কত ?
পুরান বছর মলিন মুখে যায় সকলের বালাই নিয়ে,
ঘুচ্‌ল কি ভাই মনের কালি সেই বুড়োকে বিদায় দিয়ে ?
নূতন সালে নূতন বলে, নূতন আশায়, নুতন সাজে,
আয় দয়ালের নাম লয়ে ভাই, যাই সকলে যে যার কাজে !

Bangla Kobita of Sukumar Ray #67

 

– সুকুমার রায়

রোদে রাঙা ইঁটের পাঁজা তার উপরে বসল রাজা—
ঠোঙাভরা বাদামভাজা খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না৷
গায়ে আঁটা গরম জামা পুড়ে পিঠ হচ্ছে ঝামা;
রাজা বলে, ‘বৃষ্টি নামা— নইলে কিচ্ছু মিলছে না৷’
থাকে সারা দুপুর ধ’রে ব’সে ব’সে চুপটি ক’রে,
হাঁড়িপানা মুখটি ক’রে আঁকড়ে ধ’রে শ্লেটটুকু;
ঘেমে ঘেমে উঠছে ভিজে ভ্যাবাচ্যাকা একলা নিজে,
হিজিবিজি লিখছে কি যে বুঝছে না কেউ একটুকু৷
ঝাঁ ঝাঁ রোদ আকাশ জুড়ে, মাথাটার ঝাঁঝ্‌রা ফুঁড়ে,
মগজেতে নাচছে ঘুরে রক্তগুলো ঝনর্‌ ঝন্‌;
ঠাঠা–পড়া দুপুর দিনে, রাজা বলে, ‘আর বাঁচিনে,
ছুটে আন্‌ বরফ কিনে ক’চ্ছে কেমন গা ছন্‌ছন্‌৷’
সবে বলে, ‘হায় কি হল! রাজা বুঝি ভেবেই মোলো!
ওগো রাজা মুখটি খোল–কওনা ইহার কারণ কি?
রাঙামুখ পান্‌সে যেন তেলে ভাজা আম্‌সি হেন,
রাজা এত ঘামছে কেন–শুনতে মোদের বারণ কি?’

রাজা বলে, ‘কেইবা শোনে যে কথাটা ঘুরছে মনে,
মগজের নানান্‌ কোণে– আনছি টেনে বাইরে তায়,
সে কথাটা বলছি শোন, যতই ভাব যতই গোণ,
নাহি তার জবাব কোনো কূলকিনারা নাইরে হায়!
লেখা আছে পুঁথির পাতে, ‘নেড়া যায় বেলতলাতে,’
নাহি কোনো সন্দ তাতে–কিন্তু প্রশ্ন ‘কবার যায়?’
এ কথাটা এদ্দিনেও পারোনিকো বুঝতে কেও,
লেখেনিকো পুস্তকেও, দিচ্ছে না কেউ জবাব তায়৷
লাখোবার যায় যদি সে যাওয়া তার ঠেকায় কিসে?
ভেবে তাই না পাই দিশে নাই কি কিচ্ছু উপায় তার?’
এ কথাটা যেমনি বলা রোগা এক ভিস্তিওলা
ঢিপ্‌ ক’রে বাড়িয়ে গলা প্রণাম করল দুপায় তার৷
হেসে বলে, ‘আজ্ঞে সে কি? এতে আর গোল হবে কি?
নেড়াকে তো নিত্যি দেখি আপন চোখে পরিষ্কার—
আমাদেরি বেলতলা সে নেড়া সেথা খেলতে আসে
হরে দরে হয়তো মাসে নিদেন পক্ষে পঁচিশ বার৷’

Bangla Kobita of Sukumar Ray #68

 

– সুকুমার রায়

এই দেখ পেনসিল্, নোটবুক এ–হাতে,
এই দেখ ভরা সব কিল্‌বিল্ লেখাতে।
ভালো কথা শুনি যেই চট্‌পট্ লিখি তায়—
ফড়িঙের ক’টা ঠ্যাং, আরশুলা কি কি খায়;
আঙুলেতে আটা দিলে কেন লাগে চট্‌চট্,
কাতুকুতু দিলে গরু কেন করে ছট্‌ফট্।
দেখে শিখে প’ড়ে শুনে ব’সে মাথা ঘামিয়ে
নিজে নিজে আগাগোড়া লিখে গেছি আমি এ।
কান করে কট্ কট্ ফোড়া করে টন্‌টন্—
ওরে রামা ছুটে আয়, নিয়ে আয় লন্ঠন।
কাল থেকে মনে মোর লেগে আছে খট্‌কা,
ঝোলাগুড় কিসে দেয়? সাবান না পট্‌কা?
এই বেলা প্রশ্নটা লিখে রাখি গুছিয়ে,
জবাবটা জেনে নেব মেজদাকে খুঁচিয়ে।
পেট কেন কাম্‌ড়ায় বল দেখি পার কে?
বল দেখি ঝাঁজ কেন জোয়ানের আরকে?
তেজপাতে তেজ কেন? ঝাল কেন লঙ্কায়?
নাক কেন ডাকে আর পিলে কেন চমকায়?
কার নাম দুন্দুভি? কার নাম অরণি?
বল্‌বে কি, তোমরা তো নোটবই পড়নি।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #69

 

– সুকুমার রায়

ফিরল সবাই ইস্কুলেতে সাঙ্গ হল ছুটি—
আবার চলে বই বগলে সবাই গুটি গুটি।
পড়ার পরে কার কি রকম মনটি ছিল এবার,
সময় এল এখন তারই হিসেবখানা দেবার।
কেউ পড়েছেন পড়ার পুঁথি, কেউ পড়েছেন গল্প,
কেউ পড়েছেন হদ্দমতন, কেউ পড়েছেন অল্প।
কেউ-বা তেড়ে গড়গড়িয়ে মুখস্থ কয় ঝাড়া,
কেউ-বা কেবল কাঁচুমাচু মোটে না দেয় সাড়া।
গুরুমশাই এসেই ক্লাসে বলেন, ‘ওরে গদাই,
এবার কিছু পড়লি? নাকি খেলতি কেবল সদাই?’
গদাই ভয়ে চোখ পাকিয়ে ঘাবড়ে গিয়ে শেষে
বল্লে, ‘এবার পড়ার ঠেলা বেজায় সর্বনেশে—
মামার বাড়ি যেম্নি যাওয়া অম্নি গাছে চড়া,
এক্কেবারে অম্নি ধপাস্— পড়ার মতো পড়া!’

Bangla Kobita of Sukumar Ray #70

 

– সুকুমার রায়

‘পরি’পূর্বক ‘বিষ’ধাতু তাহে ‘অনট্’ ব’সে
তবে ঘটায় পরিবেষণ, লেখে অমরকোষে।
—অর্থাৎ ভোজের ভাণ্ড হাতে লয়ে মেলা
ডেলা ডেলা ভাগ করি পাতে পাতে ফেলা।
এই দিকে এসো তবে লয়ে ভোজভাণ্ড
সমুখে চাহিয়া দেখ কি ভীষণ কাণ্ড!
কেহ কহে “দৈ আন” কেহ হাঁকে “লুচি”
কেহ কাঁদে শূন্য মুখে পাতখানি মুছি।
কোথা দেখি দুই প্রভু পাত্র লয়ে হাতে
হাতাহাতি গুঁতাগুঁতি দ্বন্দরণে মাতে।
কেবা শোনে কার কথা সকলেই কর্তা—
অনাহারে কতধারে হল প্রাণ হত্যা।
কোনো প্রভু হস্তিদেহ ভুঁড়িখানা ভারী
উর্ধ্ব হতে থপ্ করি খাদ্য দেন্ ছাড়ি।

কোনো চাচা অন্ধপ্রায় (‘মাইনাস কুড়ি’)
ছড়ায় ছোলার ডাল পথঘাট জুড়ি।
মাতব্বর বৃদ্ধ যায় মুদি চক্ষু দুটি,
“কারো কিছু চাই” বলি তড়্ বড়্ ছুটি—
সহসা ডালের পাঁকে পদার্পণ মাত্রে
হুড়্ মুড়্ পড়ে কার নিরামিষ পাত্রে।
বীরোচিত ধীর পদে এসো দেখি ত্রস্তে—
ঐ দিকে খালি পাত, চল হাঁড়ি হস্তে।

তবে দেখো, খাদ্য দিতে অতিথির থালে
দৈবাৎ না ঢোকে কভু যেন নিজ গালে!
ছুটো নাকো ওরকম মিছে খালি হাতে
দিয়ো না মাছের মুড়া নিরামিষ পাতে।
অযথা আক্রোশে কিম্বা অন্যায় আদরে
ঢেলো না অম্বল কারো নূতন চাদরে।
বোকাবৎ দন্তপাটি করিয়া বাহির
কোরো না অকারণে কৃতিত্ব জাহির।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #71

 

– সুকুমার রায়

আম পাকে বৈশাখে, কুল পাকে ফাগুনে,
কাঁচা ইট পাকা হয় পোড়ালে তা আগুনে।
রোদে জলে টিকে রঙ পাকা কই তাহারে।
ফলারটি পাকা হয় লুচি দই আহারে।
হাত পাকে লিখে লিখে, চুল পাকে বয়সে,
জ্যাঠামিতে পাকা ছেলে বেশি কথা কয় সে।
লোকে কয় কাঁঠাল সে পাকে নাকি কিলিয়ে?
বুদ্ধি পাকিয়ে তোলে লেখাপড়া গিলিয়ে!
কান পাকে ফোড়া পাকে, পেকে করে টন্‌টন্-
কথা যার পাকা নয়, কাজে তার ঠন্‌ঠন্
রাঁধুনী বসিয়া পাকে পাক দেয় হাঁড়িতে,
সজোরে পাকালে চোখ ছেলে কাঁদে বাড়িতে।
পাকায়ে পাকায়ে দড়ি টান হয়ে থাকে সে।
দুহাতে পাকালে গোফঁ তবু নাহি পাকে সে।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #72

 

– সুকুমার রায়

খেলার ছলে ষষ্ঠিচরণ হাতী লোফেন যখন তখন,
দেহের ওজন উনিশটি মন, শক্ত যেন লোহার গঠন।
একদিন এক গুন্ডা তাকে বাঁশ বাগিয়ে মারল বেগে-
ভাঙল সে বাঁশ শোলার মত মট্ ক’রে তার কনুই লেগে।
এইত সে দিন রাস্তা দিয়ে চল্‌‌‌তে গিয়ে দৈব বশে,
উপর থেকে প্রকান্ড ইট পড়্ল তাহার মাথায় খ’সে।
মুন্ডুতে তার যেম্‌‌নি ঠেকা অম্‌‌নি সে ইট এক নিমিষে
গুঁড়িয়ে হ’ল ধুলোর মত, ষষ্ঠি চলেন মুচকি হেসে।
ষষ্ঠি যখন ধমক হাঁকে কাঁপ্‌‌‌তে থাকে দালান বাড়ী,
ফুঁয়ের জোরে পথের মোড়ে উল্টে পড়ে গরুর গাড়ী।
ধুম্‌‌সো কাঠের তক্তা ছেঁড়ে মোচড় মেরে মুহূর্তেকে,
একশো জালা জল ঢালে রোজ স্নানের সময় পুকুর থেকে।
সকাল বেলার জল পানি তার তিনটি ধামা পেস্তা মেওয়া,
সঙ্গেতে তার চৌদ্দ হাঁড়ি দৈ কি মালাই মুড়কি দেওয়া ।
দুপুর হ’লে খাবার আসে কাতার দিয়ে ডেক্‌‌চি ভ’রে,
বরফ দেওয়া উনিশ কুঁজো সরবতে তার তৃষ্ণা হরে।
বিকাল বেলা খায়না কিছু গন্ডা দশেক মন্ডা ছাড়া,
সন্ধ্যা হলে লাগায় তেড়ে দিস্তা দিস্তা লুচির তাড়া ।
রাত্রে সে তার হাত পা টেপায় দশটি চেলা মজুত থাকে,
দুম্‌দুমাদুম্ সবাই মিলে মুগুর দিয়ে পেটায় তাকে।
বললে বেশি ভাব্‌‌বে শেষে এসব কথা ফেনিয়ে বলা-
দেখবে যদি আপন চোখে যাওনা কেন বেনিয়াটোলা।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #73

 

– সুকুমার রায়

প্যাঁচা কয় প্যাঁচানী,
খাসা তোর চ্যাঁচানি
শুনে শুনে আন্‌মন
নাচে মোর প্রাণমন!
মাজা–গলা চাঁচা–সুর
আহলাদে ভরপুর!
গলা–চেরা ধমকে
গাছ পালা চমকে,
সুরে সুরে কত প্যাঁচ
গিট্‌কিরি ক্যাঁচ্ ক্যাঁচ্!
যত ভয় যত দুখ
দুরু দুরু ধুক্ ধুক্,
তোর গানে পেঁচি রে
সব ভুলে গেছি রে,
চাঁদমুখে মিঠে গান
শুনে ঝরে দু’নয়ান৷

Bangla Kobita of Sukumar Ray #74

 

– সুকুমার রায়

দেখ বাবাজি দেখবি নাকি দেখরে খেলা দেখ চালাকি,
ভোজের বাজি ভেল্কি ফাঁকি পড়্ পড়্ পড়্ পড়বি পাখি – ধপ্!
লাফ দিয়ে তাই তালটি ঠুকে তাক করে যাই তীর ধনুকে,
ছাড়ব সটান উর্ধ্বমুখে হুশ করে তোর লাগবে বুকে – খপ্!
গুড়্ গুড়্ গুড়্ গুড়িয়ে হামা খাপ্ পেতেছেন গোষ্ঠ মামা
এগিয়ে আছেন বাগিয়ে ধামা এইবার বাণ চিড়িয়া নামা – চট্!
ঐ যা! গেল ফস্কে ফেঁসে – হেই মামা তুই ক্ষেপলি শেষে?
ঘ্যাচঁ করে তোর পাঁজর ঘেঁষে লাগ্‌ল কি বাণ ছটকে এসে- ফট্?

Bangla Kobita of Sukumar Ray #75

 

– সুকুমার রায়

গাছের গোড়ায় গর্ত করে ব্যাং বেঁধেছেন বাসা,
মনের সুখে গাল ফুলিয়ে গান ধরেছেন খাসা।
রাজার হাতি হাওদা -পিঠে হেলে দুলে আসে-
বাপরে ব’লে ব্যাং বাবাজি গর্তে ঢোকেন ত্রাসে!
রাজার হাতি মেজাজ ভারি হাজার রকম চাল ;
হঠাৎ রেগে মটাং করে ভাঙল গাছের ডাল।
গাছের মাথায় চড়াই পাখি অবাক হ’য়ে কয়-
বাসরে বাস! হাতির গায়ে এমন জোরও হয়!
মুখ বাড়িয়ে ব্যাং বলে, ভাই তাইত তোরে বলি-
“আমরা, অর্থাৎ চার-পেয়েরা, এন্মি ভাবেই চলি”।।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #76

 

– সুকুমার রায়

শুন্‌ছ দাদা! ঐ যে হোথায় বদ্যি বুড়ো থাকে ,
সে নাকি রোজ খাবার সময় হাত দিয়ে ভাত মাখে?
শুন্‌ছি নাকি খিদেও পায় সারাদিন না খেলে ?
চক্ষু নাকি আপনি বোজে ঘুমটি তেমন পেলে ?
চলতে গেলে ঠ্যাং নাকি তার ভুয়েঁর পরে ঠেকে?
কান দিয়ে সব শোনে নাকি? চোখ দিয়ে সব দেখে?
শোয় নাকি সে মুন্ডুটাকে শিয়র পানে দিয়ে?
হয় না কি হয় সত্যি মিথ্যা চল না দেখি গিয়ে!

Bangla Kobita of Sukumar Ray #77

 

– সুকুমার রায়

বর্ষ গেল বর্ষ এল গ্রীষ্ম এলেন বাড়ি-
পৃথ্বী এলেন চক্র দিয়ে এক বছরের পাড়ি ।
সত্যিকারের এই পৃথিবীর বয়স কেবা জানে,
লক্ষ হাজার বছর ধরে চল্‌ছে একই টানে ।
আপন তালে আকাশ পথে আপনি চলে বেগে,
গ্রীষ্মকালের তপ্তরোদে বর্ষাকালের মেঘে,
শরৎকালের কান্নাহাসি হাল্কা বাদল হাওয়া,
কুয়াশা-ঘেরা পর্দা ফেলে হিমের আসা যাওয়া-
শীতের শেষে রিক্ত বেশে শূন্য করে ঝুলি,
তার প্রতিশোধ ফুলে ফলে বসন্তে লয় তুলি ।
না জানি কোন নেশার ঝোঁকে যুগযুগান্ত ধরে,
ছয়টি ঋতু দ্বারে দ্বারে পাগল হয়ে ঘোরে !
না জানি কোন ঘূর্ণীপাকে দিনের পর দিন,
এমন ক’রে ঘোরায় তারে নিদ্রাবিরামহীন !
কাঁটায় কাঁটায় নিয়ম রাখে লক্ষযুগের প্রথা,
না জানি তার চাল চলনের হিসাব রাখে কোথা !

Bangla Kobita of Sukumar Ray #78

 

– সুকুমার রায়

শুন রে আজব কথা, শুন বলি ভাইরে-
বছরের আয়ু দেখ বেশিদিন নাই রে ।
ফেলে দিয়ে পুরাতন জীর্ণ এ খোলসে
নূতন বরষ আসে, কোথা হতে বল সে !
কবে যে দিয়েছে চাবি জগতের যন্ত্রে,
সেই দমে আজও চলে না জানি কি মন্ত্রে !
পাকে পাকে দিনরাত ফিরে আসে বার বার,
ফিরে আসে মাস ঋতু- এ কেমন কারবার ।
কোথা আসে কোথা যায় নাহি কোন উদ্দেশ,
হেসে খেলে ভেসে যায় কত দূর দূর দেশ ।
রবি যায় শশী যায় গ্রহ তারা সব যায়,
বিনা কাঁটা কম্পাসে বিনা কল কব্জায় ।
ঘুরপাকে ঘুরে চলে, চলে কত ছন্দে,
তালে তালে হেলে দুলে চলে রে আনন্দে ।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #79

 

– সুকুমার রায়

কাগজ কলম লয়ে বসিয়াছি সদ্য,
আষাঢ়ে লিখিতে হবে বরষার পদ্য।
কি যে লিখি কি যে লিখি ভাবিয়া না পাই রে,
হতাশে বসিয়া তাই চেয়ে থাকি বাইরে।
সারাদিন ঘনঘটা কালো মেঘ আকাশে,
ভিজে ভিজে পৃথিবীর মুখ খানা ফ্যাকাশে।
বিনা কাজে ঘরে বাঁধা কেটে যায় বেলাটা,
মাটি হল ছেলেদের ফুটবল খেলাটা।
আপিসের বাবুদের মুখে নাই ফুর্তি,
ছাতা কাঁধে জুতা হাতে ভ্যাবাচ্যাকা মূর্তি।
কোনখানে হাটু জল কোথা ঘন কর্দম –
চলিতে পিছল পথে পড়ে লোকে হর্‌দম।
ব্যাঙেদের মহাসভা আহ্লাদে গদ্‌গদ্,
গান করে সারারাত অতিশয় বদ্‌খদ্।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #80

 

– সুকুমার রায়

অতি খাসা মিহি সূতি
ফিনফিনে জামা ধুতি,
চরণে লপেটা জুতি জরিদার ।
এ হাতে সোনার ঘড়ি,
ও হাতে বাঁকান ছড়ি,
আতরের ছড়াছড়ি চারিধার ।
চক্‌চকে চুল ছাঁটা
তায় তোফা টেরিকাটা-
সোনার চশমা আঁটা নাসিকায় ।
ঠোঁট দুটি এঁকে বেঁকে
ধোঁয়া ছাড়ে থেকে থেকে,
হালচাল দেখে দেখে হাসি পায় ।

ঘোষেদের ছোট মেয়ে
পিক্‌ ফেলে পান খেয়ে,
নিচু পানে নাহি চায় হায়রে ।
সেই পিক থ্যাপ ক’রে
লেগেছে চাদর ভরে
দেখে বাবু কেঁদে মরে যায়রে ।
ওদিকে ছ্যাকরাগাড়ি
ছুটে চলে তাড়াতাড়ি
ছিট্‌কিয়ে কাঁড়ি কাঁড়ি ঘোলাজল ।
সহসা সে জল লাগে
জামার পিছন বাগে,
বাবু করে মহারাগে কোলাহল ।।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #81

 

– সুকুমার রায়

বাবুরাম সাপুড়ে,
কোথা যাস্‌ বাপুরে?
আয় বাবা দেখে যা,
দুটো সাপ রেখে যা!
যে সাপের চোখ্‌ নেই,
শিং নেই নোখ্‌ নেই,
ছোটে নাকি হাঁটে না,
কাউকে যে কাটে না,
করে নাকো ফোঁস ফাঁস,
মারে নাকো ঢুঁশ্‌ ঢাঁশ্‌,
নেই কোন উৎপাত,
খায় শুধু দুধভাত–
সেই সাপ জ্যাম্ত
গোটা দুই আনত?
তেড়ে মেরে ডাণ্ডা
ক’রে দেই ঠাণ্ডা।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #82

 

– সুকুমার রায়

ইঁদুর দেখে মাম্‌দো কুকুর বল্‌লে তেড়ে হেঁকে-
‘বলব কি আর, বড়ই খুশি হলেম তোরে দেখে।
আজকে আমার কাজ কিছু নেই, সময় আছে মেলা,
আয় না খেলি দুইজনাতে মোকদ্দমা খেলা ।
তুই হবি চোর তোর নামেতে করব নালিশ রুজু’-
‘জজ্ কে হবে?’ বল্লে ইঁদুর ,বিষম ভয়ে জুজু,
‘কোথায় উকিল প্যায়দা পুলিশ , বিচার কিসে হবে?’
মাম্‌দো বলে ‘তাও জানিসনে ? শোন বলে দেই তবে!
আমিই হব উকিল হাকিম , আমিই হব জুরি,
কান ধরে তোর বলব ব্যাটা, ফের করেছিস চুরি?
সটান দেব ফাসির হুকুম অমনি একেবারে-
বুঝবি তখন চোর বাছাধন বিচার বলে কারে।’

Bangla Kobita of Sukumar Ray #83

 

– সুকুমার রায়

আয় তোর মুণ্ডুটা দেখি, আয় দেখি ‘ফুটোস্কোপ’ দিয়ে,
দেখি কত ভেজালের মেকি আছে তোর মগজের ঘিয়ে।
কোন দিকে বুদ্ধিটা খোলে, কোন দিকে থেকে যায় চাপা,
কতখানি ভস্ ভস্ ঘিলু, কতখানি ঠক্‌ঠকে ফাঁপা।
মন তোর কোন দেশে থাকে, কেন তুই ভুলে যাস্ কথা—
আয় দেখি কোন ফাঁক দিয়ে, মগজেতে ফুটো তোর কোথা।
টোল–খাওয়া ছাতাপড়া মাথা, ফাটা–মতো মনে হয় যেন,
আয় দেখি বিশ্লেষ ক’রে–চোপ্‌রাও ভয় পাস্ কেন?
কাৎ হয়ে কান ধ’রে দাঁড়া, জিভখানা উল্‌টিয়ে দেখা,
ভালো ক’রে বুঝে শুনে দেখি–বিজ্ঞানে যে–রকম লেখা।
মুণ্ডুতে ‘ম্যাগনেট’ ফেলে, বাঁশ দিয়ে ‘রিফ্‌লেক্‌ট’ ক’রে,
ইঁট দিয়ে ‘ভেলসিটি’ ক’ষে দেখি মাথা ঘোরে কি না ঘোরে।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #84

 

– সুকুমার রায়


করে তাড়াহুড়ো বিষম চোট্‌
কিনেছি হ্যাট্‌ পরেছি কোট্‌,
পেয়েছি passage এসেছে boat,
বেঁধেছি তল্পি তুলেছি মোট্‌,
বলেছে সবাই, “তা হলে ওঠ্‌,
আসান্‌ এবার বিলেতে ছোট্‌।”
তাই সভা হবে, বিদায় ভোট্‌,
কাঁদ কাঁদ ভাবে ফুলিয়ে ঠোট্‌
হেথায় সকলে করিবে জোট্‌
(প্রোগ্রামটুকু করিও Note)।

প্রোগ্রাম-
শুক্র সন্ধ্যা সঠিক সাত-
আহার, আমোদ, উল্কাপাত।


আসছে কাল, শনিবার
অপরাহ্ণ সাড়ে চার,
আসিয়া মোদের বাড়ি,
কৃতার্থ করিলে সবে
টুলুপুষু খুশি হবে।


(হুবহু) নকল করি
লেখাটি আমার
সভায় (বাহবা) নিল
লজ্জা নাহি তার।
ধনীরা (খামখা) কেন
ধন লয়ে যায়।
যে ধন (বিলাবি) যেন
দুখী জনে পায়।

[বন্ধনীর ভিতরের শব্দগুলি যে-দিক থেকেই পড়া যাক অপরিবর্তিত থাকে। ]


লর্ড কার্জন অতি দুর্জন বঙ্গগগন শনি
কূট নিঠুর চক্রী চতুর উগ্র গরল ফণী। …


আমরা দিশি পাগলার দল,
দেশের জন্য ভেবে ভেবে হয়েছি পাগল,
(যদিও) দেখতে খারাপ, টিকবে কম, দামটা একটু বেশি
(তাহোক) এতে দেশেরই মঙ্গল।


আজকে আমার প্রদীপখানি ম্লান হয়েছে আঁধার মাঝে
আজকে আমার প্রাণের সুরে ক্ষণে ক্ষণে বেসুর বাজে
আজকে আমার আশার বাণী মৌন আছে সংশয়েতে
…[অসমাপ্ত]


সৃষ্টি যখন সদ্য কাঁচা, অনেকখানি ফাঁকা
বিশ্বকর্মা নিলেন ছুটি একটি বছর ছাঁকা।
ঘুম জমে না, পায় না ক্ষিদে, শরীর কেমন করে,
ডাক্তারেরা দিলেন হুকুম বিশ্রামেরি তরে।
আইন মাফিক নোটিশ নোটিশ দিয়ে অগ্রহায়ণ মাসে
গেলেন তিনি মর্তলোকে স্বাস্থ্য লাভের আশে।


বৃষ্টি বেগ ভরে রাস্তা গেল ডুবিয়ে
ছাতা কাঁধে, জুতা হাতে, নোংরা ঘোলা কালো,
হাঁটু জল ঠেলি চলে যত লোকে।
রাস্তাতে চলা দুষ্কর মুস্কিল বড়
অতি পিচ্ছিল, অতি পিচ্ছিল, অতি পিচ্ছিল, বিচ্ছিরি রাস্তা,
ধরণী মহা-দুর্গম কর্দম-গ্রস্তা
যাওয়া দুষ্কর মুস্কিল রে ইস্কুলে,
সর্দি জ্বর, বৃদ্ধি বড়, নিত্যি লোকে বদ্যি ডেকে
তিক্ত বড়ি খায়।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #85

 

– সুকুমার রায়

কর্তা চলেন, গিন্নী চলেন, খোকাও চলেন সাথে,
তড়্‌বড়িয়ে বুক ফুলিয়ে শুতে যাচ্ছেন রাতে ।
তেড়ে হন্‌হন্‌ চলে তিনজন যেন পল্টন চলে,
সিঁড়ি উঠ্‌‌তেই, একি কাণ্ড ! এ আবার কি বলে !
ল্যাজ লম্বা, কান গোল্‌ গোল্‌, তিড়িং বিড়িং ছোটে,
চোখ্‌ মিট্‌মিট্‌, কুটুস্‌ কাটুস্‌- এটি কোন্‌জন বটে !
হেই ! হুস্‌ ! হ্যাস্‌ ! ওরে বাস্‌‌রে মতলবখানা কিরে,
করলে তাড়া যায় না তবু, দেখ্‌‌ছে আবার ফিরে ।
ভাবছে বুড়ো, করবো গুঁড়ো ছাতার বাড়ি মেরে,
আবার ভাবে ফস্‌‌কে গেলে কাম্‌‌ড়ে দেবে তেড়ে ।
আরে বাপ্‌‌রে ! বস্‌ল দেখ দুই পায়ে ভর ক’রে,
বুক দুর দুর বুড়ো ভল্লুর, মোমবাতি যায় প’ড়ে ।
ভীষণ ভয়ে দাঁত কপাটি তিন মহাবীর কাঁপে,
গড়িয়ে নামে হুড়মুড়িয়ে সিঁড়ির ধাপে ধাপে ।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #86

 

– সুকুমার রায়

মাথায় কত প্রশ্ন আসে, দিচ্ছে না কেউ জবাব তার—
সবাই বলে “মিথ্যে বাজে বকিস নে আর খবরদার!”
অমন ধারা ধমক দিলে কেমন করে শিখব সব?
বলবে সবাই, “মুখ্যু ছেলে”, বলবে আমায় “গো-গর্দভ!”
কেউ কি জানে দিনের বেলায় কোথায় পালায় ঘুমের ঘোর?
বর্ষা হলেই ব্যাঙের গলায় কোত্থেকে হয় এমন জোর?
গাধার কেন শিং থাকে না? হাতির কেন পালক নেই?
গরম তেলে ফোড়ন দিলে লাফায় কেন তা ধেই-ধেই?
সোডার বোতল খুল্লে কেন ফঁসফঁসিয়ে রাগ করে?
কেমন করে রাখবে টিকি মাথায় যাদের টাক পড়ে?
ভূত যদি না থাকবে তবে কোত্থেকে হয় ভূতের ভয়?
মাথায় যাদের গোল বেধেছে তাদের কেন “পাগোল” কয়?
কতই ভাবি এ-সব কথা, জবাব দেবার মানুষ কই?
বয়স হলে কেতাব খুলে জানতে পাব সমস্তই।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #87

 

– সুকুমার রায়

এমনি পড়ায় মন বসেছে, পড়ার নেশায় টিফিন ভোলে।
সাম্‌নে গিয়ে উৎসাহ দেই মিষ্টি দুটো বাক্য বলে।

পড়্‌ছ বুঝি? বেশ বেশ বেশ! এক মনেতে পড়্‌লে পরে
“লক্ষ্মীছেলে– সোনার ছেলে” বলে সবাই আদর করে।

এ আবার কি? চিত্র নাকি? বাঁদর পাজি লক্ষ্মীছাড়া–
আমায় নিয়ে রংতামাসা! পিটিয়ে তোমায় কর্‌ছি খাড়া।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #88

 

– সুকুমার রায়

ও শ্যামাদাস! আয়তো দেখি, বোস তো দেখি এখেনে,
সেই কথাটা বুঝিয়ে দেব পাঁচ মিনিটে, দেখে নে৷
জ্বর হয়েছে? মিথ্যে কথা! ওসব তোদের চালাকি—
এই যে বাবা চেঁচাচ্ছিলি, শুনতে পাইনি? কালা কি?
মামার ব্যামো? বদ্যি ডাকবি? ডাকিস না হয় বিকেলে
না হয় আমি বাৎলে দেব বাঁচবে মামা কি খেলে!
আজকে তোকে সেই কথাটা বোঝাবই বোঝাব—
না বুঝবি তো মগজে তোর গজাল মেরে গোঁজাব৷
কোন্ কথাটা? তাও ভুলেছিস্? ছেড়ে দিছিস্ হাওয়াতে?
কি বলছিলেম পরশু রাতে বিষ্টু বোসের দাওয়াতে?
ভুলিসনি তো বেশ করেছিস্, আবার শুনলে ক্ষেতি কি?
বড় যে তুই পালিয়ে বেড়াস্, মাড়াস্‌নে যে এদিক্‌ই!
বলছি দাঁড়া, ব্যস্ত কেন? বোস্ তাহলে নিচুতেই—
আজকালের এই ছোক্‌রাগুলোর তর্ সয়না কিছুতেই৷
আবার দেখ! বসলি কেন? বইগুলো আন্ নামিয়ে—
তুই থাক্‌তে মুটের বোঝা বইতে যাব আমি এ?
সাবধানে আন্, ধরছি দাঁড়া–সেই আমাকেই ঘামালি,
এই খেয়ছে! কোন্ আক্কেলে শব্দকোষটা নামালি?
ঢের হয়েছে! আয় দেখি তুই বোস্ তো দেখি এদিকে—
ওরে গোপাল গোটাকয়েক পান দিতে বল্ খেঁদিকে৷

বলছিলাম কি, বস্তুপিণ্ড সূক্ষ্ম হতে স্থূলেতে,
অর্থাৎ কিনা লাগ্‌ছে ঠেলা পঞ্চভূতের মূলেতে—
গোড়ায় তবে দেখতে হবে কোত্থেকে আর কি ক’রে,
রস জমে এই প্রপঞ্চময় বিশ্বতরুর শিকড়ে৷
অর্থাৎ কিনা, এই মনে কর্, রোদ পড়েছে ঘাসেতে,
এই মনে কর্, চাঁদের আলো পড়লো তারি পাশেতে—
আবার দেখ! এরই মধ্যে হাই তোলবার মানে কি?
আকাশপানে তাকাস্ খালি, যাচ্ছে কথা কানে কি?
কি বল্লি তুই? এ সব শুধু আবোল তাবোল বকুনি?
বুঝতে হলে মগজ লাগে, বলেছিলাম তখুনি৷
মগজভরা গোবর তোদের হচ্ছে ঘুঁটে শুকিয়ে,
যায় কি দেওয়া কোন কথা তার ভিতেরে ঢুকিয়ে?—
ও শ্যামাদাস! উঠলি কেন? কেবল যে চাস্ পালাতে!
না শুনবি তো মিথ্যে সবাই আসিস্ কেন জ্বালাতে?
তত্ত্বকথা যায় না কানে যতই মরি চেঁচিয়ে—
ইচ্ছে করে ডান্‌পিটেদের কান ম’লে দি পেঁচিয়ে৷

Bangla Kobita of Sukumar Ray #89

 

– সুকুমার রায়

গালভরা হাসিমুখে চালভাজা মুড়ি,
ঝুরঝুরে প’ড়ো ঘরে থুর্‌থুরে বুড়ী৷
কাঁথাভরা ঝুলকালি, মাথাভরা ধুলো,
মিট্‌মিটে ঘোলা চোখ, পিট খানা কুলো৷
কাঁটা দিয়ে আঁটা ঘর—আঠা দিয়ে সেঁটে,
সূতো দিয়ে বেঁধে রাখে থুতু দিয়ে চেটে৷
ভর দিতে ভয় হয় ঘর বুঝি পড়ে,
খক্‌ খক্ কাশি দিলে ঠক্ ঠক্ নড়ে৷
ডাকে যদি ফিরিওয়ালা, হাঁকে যদি গাড়ী,
খসে পড়ে কড়িকাঠ ধসে পড়ে বাড়ী৷
বাঁকাচোরা ঘরদোর ফাঁকা ফাঁকা কত,
ঝাঁট দিলে ঝরে প’ড়ে কাঠকুটো যত৷
ছাদগুলো ঝুলে পড়ে বাদ্‌লায় ভিজে,
একা বুড়ী কাঠি গুঁজে ঠেকা দেয় নিজে৷
মেরামত দিনরাত কেরামত ভারি,
থুর্‌থুরে বুড়ী তার ঝুর্‌ঝুরে বাড়ী৷৷

Bangla Kobita of Sukumar Ray #90

 

– সুকুমার রায়

বাহবা বাবুলাল ! গেলে যে হেসে !
বগলে কাতুকুতু কে দিল এসে ?
এদিকে মিটিমিটি দেখ কি চেয়ে ?
হাসি যে ফেটে পড়ে দু’গাল বেয়ে !
হাসে যে রাঙা ঠোঁট দন্ত মেলে
চোখের কোণে কোণে বিজলী খেলে ।
হাসির রসে গ’লে ঝরে যে লালা
কেন এ খি-খি-খি-খি হাসির পালা ?
যে দেখে সেই হাসে হাহাহা হাহা
বাহবা বাবুলাল বাহবা বাহা !

Bangla Kobita of Sukumar Ray #91

 

– সুকুমার রায়

ও হাড়্‌গিলে, হাড়্‌গিলে ভাই, খাপ্পা বড্ড আজ!
ঝগড়া কি আর সাজে তোমার? এই কি তোমার যোগ্য কাজ?
হোম্‌রা চোম্‌রা মান্য তোমরা বিদ্যেবুদ্ধি মর্যাদায়
ওদের সঙ্গে তর্ক করছ- নাই কি কোন লজ্জা তায়?
জান্‌ছ নাকি বলছে ওরা? ‘কিচির মিচির কিচ্চিরি,’
অর্থাৎ কিনা, তোমার নাকি চেহারাটা বিচ্ছিরি!
বল্‌ছে আচ্ছা বলুক, তাতে ওদেরই তো মুখ ব্যথা,
ঠ্যাঁটা লোকের শাস্তি যত, ওরাই শেষে ভুগবে তা।
ওরা তোমায় খোঁড়া বল্‌ছে? বেয়াদব তো খুব দেখি!
তোমার পায়ে বাতের কষ্ট- ওরা সেসব বুঝবে কি?
তাই বলে কি নাচবে রাগে? উঠ্‌বে চটে চট্‌ ক’রে?
মিথ্যে আরো ত্যাক্ত হবে ওদের সাথে টক্করে।
ঐ শোন কি বলছে আবার, কচ্ছে কত বক্তৃতা-
বলছে তোমার ন্যাড়া মাথায় ঘোল ঢালবে- সত্যি তা?
চড়াই পাখির বড়াই দেখ তোমায় দিচ্ছে টিট্‌কিরি-
বল্‌ছে, তোমার মিষ্টি গলায় গান ধরতে গিট্‌কিরি।
বল্‌ছে, তোমার কাঁথাটাকে ‘রিফুকর্ম’ করবে কি?
খোঁড়া ঠ্যাঙে নামবে জলে? আর কোলা ব্যাঙ করবে কি?
আর চ’টো না, আর শুনো না, ঠ্যাঁটা মুখের টিপ্পনি,
ওদের কথায় কান দিতে নেই, স’রে পড় এক্ষনি।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #92

 

– সুকুমার রায়

এসব কথা শুনলে তোদের লাগবে মনে ধাঁধাঁ,
কেউ বা বুঝে পুরোপুরি, কেউ বা বুঝে আধা।

কারে বা কই কিসের কথা, কই যে দফে দফে,
গাছের ‘পরে কাঁঠাল দেখে তেল মেখ না গোঁফে।

একটি একটি কথায় যেন সদ্য দাগে কামান,
মন বসনের ময়লা ধুতে তত্ত্বকথাই সাবান।

বেশ বলেছ, ঢের বলেছ, ঐখেনে দাও দাঁড়ি,
হাটের মাঝে ভাঙ্‌বে কেন বিদ্যে বোঝাই হাঁড়ি!

Bangla Kobita of Sukumar Ray #93

 

– সুকুমার রায়

কেউ কি জান সদাই কেন বোম্বাগড়ের রাজা-
ছবির ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখে আমসত্ত্ব ভাজা?
রানীর মাথায় অষ্টপ্রহর কেন বালিশ বাঁধা?
পাঁউরুটিতে পেরেক ঠোকে কেন রানীর দাদা?
কেন সেথায় সর্দি হলে ডিগবাজি খায় লোকে?
জোছ্নাথ রাতে সবাই কেন আলতা মাথায় চোখে?
ওস্তাদেরা লেপ মুড়ি দেয় কেন মাথায় ঘাড়ে?
টাকের পরে পন্ডিতেরা ডাকের টিকিট মারে।
রাত্রে কেন ট্যাঁক্‌ঘড়িটা ডুবিয়ে রাখে ঘিয়ে।
কেন রাজার বিছ্‌না পাতে শিরীষ কাগজ দিয়ে?
সভায় কেন চেঁচায় রাজা “হুক্কা হুয়া” বলে?
মন্ত্রী কেন কলসী বাজায় বসে রাজার কোলে?

সিংহাসনে ঝোলায় কেন ভাঙা বোতল শিশি?
কুমড়ো নিয়ে ক্রিকেট খেলে কেন রাজার পিসী?
রাজার খুড়ো নাচেন কেন হুঁকোর মালা পরে?
এমন কেন ঘটছে তা কেউ বলতে পার মোরে?

Bangla Kobita of Sukumar Ray #94

 

– সুকুমার রায়

ভয় পেয়ো না, ভয় পেয়ো না, তোমায় আমি মারব না—
সত্যি বলছি কুস্তি ক’রে তোমার সঙ্গে পারব না।
মনটা আমার বড্ড নরম, হাড়ে আমার রাগটি নেই,
তোমায় আমি চিবিয়ে খাব এমন আমার সাধ্যি নেই!
মাথায় আমার শিং দেখে ভাই ভয় পেয়েছ কতই না—
জানো না মোর মাথার ব্যারাম, কাউকে আমি গুঁতোই না?
এস এস গর্তে এস, বাস ক’রে যাও চারটি দিন,
আদর ক’রে শিকেয় তুলে রাখব তোমায় রাত্রিদিন।
হাতে আমার মুগুর আছে তাই কি হেথায় থাকবে না?
মুগুর আমার হাল্‌কা এমন মারলে তোমায় লাগবে না।
অভয় দিচ্ছি, শুনছ না যে? ধরব নাকি ঠ্যাং দুটা?
বসলে তোমার মুণ্ডু চেপে বুঝবে তখন কাণ্ডটা!
আমি আছি, গিন্নী আছেন, আছেন আমার নয় ছেলে—
সবাই মিলে কামড়ে দেব মিথ্যে অমন ভয় পেলে।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #95

 

– সুকুমার রায়

এই নেয়েছ, ভাত খেয়েছ, ঘন্টাখানেক হবে-
আবার কেন হঠাৎ হেন নামলে এখন টবে?
একলা ঘরে ফুর্তি ভরে লুকিয়ে দুপুরবেলা,
স্নানের ছলে ঠান্ডা জলে জল ছপ্‌ছপ্ খেলা।
জল ছিটিয়ে, টব পিটিয়ে, ভাবছ, ‘আমোদ ভারি-
কেউ কাছে নাই, যা খুশি তাই করতে এখন পারি।’
চুপ্ চুপ্ চুপ্- ঐ দুপ্ দুপ্! ঐ জেগেছে মাসি,
আসছে ধেয়ে, শুনতে পেয়ে দুষ্ট মেয়ের হাসি।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #96

 

– সুকুমার রায়

মাগো!
প্রসন্নটা দুষ্টু এমন! খাচ্ছিল সে পরোটা
গুড় মাখিয়ে আরাম ক’রে বসে –
আমায় দেখে একটা দিল ,নয়কো তাও বড়টা,
দুইখানা সেই আপনি খেল ক’ষে!
তাইতে আমি কান ধরে তার একটুখানি পেঁচিয়ে
কিল মেরেছি ‘হ্যাংলা ছেলে’ বলে-
অম্‌‌নি কিনা মিথ্যা করে ষাঁড়ের মত চেচিয়ে
গেল সে তার মায়ের কাছে চলে!

মাগো!
এম্‌‌নিধারা শয়তানি তার, খেলতে গেলাম দুপুরে,
বল্‌ল, ‘এখন খেলতে আমার মানা’-
ঘন্টাখানেক পরেই দেখি দিব্যি ছাতের উপরে
ওড়াচ্ছে তার সবুজ ঘুড়ি খানা।
তাইতে আমি দৌড়ে গিয়ে ঢিল মেরে আর খুঁচিয়ে
ঘুড়ির পেটে দিলাম করে ফুটো-
আবার দেখ বুক ফুলিয়ে সটান মাথা উঁচিয়ে
আনছে কিনে নতুন ঘুড়ি দুটো!

Bangla Kobita of Sukumar Ray #97

 

– সুকুমার রায়

দাদা গো! দেখ্ছি ভেবে অনেক দূর
এই দুনিয়ার সকল ভাল,
আসল ভাল নকল ভাল,
সস্তা ভাল দামীও ভাল,
তুমিও ভাল আমিও ভাল,
হেথায় গানের ছন্দ ভাল,
হেথায় ফুলের গন্ধ ভাল,
মেঘ-মাখানো আকাশ ভাল,
ঢেউ- জাগানো বাতাস ভাল,
গ্রীষ্ম ভাল বর্ষা ভাল,
ময়লা ভাল ফরসা ভাল,
পোলাও ভাল কোর্মা ভাল,
মাছপটোলের দোলমা ভাল,
কাঁচাও ভাল পাকাও ভাল,
সোজাও ভাল বাঁকাও ভাল,
কাঁসিও ভাল ঢাকও ভাল,
টিকিও ভাল টাক্ও ভাল,
ঠেলার গাড়ী ঠেলতে ভাল,
খাস্তা লুচি বেলতে ভাল,
গিট্কিরি গান শুনতে ভাল,
শিমুল তুলো ধুনতে ভাল,
ঠান্ডা জলে নাইতে ভাল।
কিন্তু সবার চাইতে ভাল-
পাঁউরুটি আর ঝোলা গুড়।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #98

 

– সুকুমার রায়

পরশু রাতে পষ্ট চোখে দেখনু বিনা চশমাতে,
পান্তভূতের জ্যান্ত ছানা করছে খেলা জোছনাতে৷
কচ্ছে খেলা মায়ের কোলে হাত পা নেড়ে উল্লাসে,
আহলাদেতে ধুপধুপিয়ে কচ্ছে কেমন হল্লা সে৷
শুনতে পেলাম ভূতের মায়ের মুচকি হাসি কট্‌কটে—
দেখছে নেড়ে ঝুন্‌টি ধ’রে বাচ্চা কেমন চট্‌পটে৷
উঠছে তাদের হাসির হানা কাষ্ঠ সুরে ডাক ছেড়ে,
খ্যাঁশ্‌ খ্যাঁশানি শব্দে যেন করাত দিয়ে কাঠ চেরে!
যেমন খুশি মারছে ঘুঁষি, দিচ্ছে কষে কানমলা,
আদর করে আছাড় মেরে শূন্যে ঝোলে চ্যাং দোলা৷
বলছে আবার, ‘আয়রে আমার নোংরামুখো সুঁটকো রে,
দেখনা ফিরে প্যাখনা ধরে হুতোম–হাসি মুখ করে!

ওরে আমার বাঁদর–নাচন আদর–গেলা কোঁত্‌কা রে!
অন্ধবনের গন্ধ–গোকুল, ওরে আমার হোঁত্‌কা রে!
ওরে আমার বাদলা রোদে জষ্টি মাসের বিষ্টি রে,
ওরে আমার হামান–ছেঁচা যষ্টিমধুর মিষ্টি রে৷
ওরে আমার রান্না হাঁড়ির কান্না হাসির ফোড়নদার,
ওরে আমার জোছনা হাওয়ার স্বপ্নঘোড়ার চড়নদার৷
ওরে আমার গোবরা গণেশ ময়দাঠাসা নাদুস্‌ রে,
ছিঁচকাঁদুনে ফোক্‌লা মানিক, ফের যদি তুই কাঁদিস রে—’
এই না ব’লে যেই মেরেছে কাদার চাপটি ফট্‌ ক’রে,
কোথায় বা কি, ভূতের ফাঁকি মিলিয়ে গেল চট্‌ ক’রে!

Bangla Kobita of Sukumar Ray #99

 

– সুকুমার রায়

কান্না হাসির পোঁটলা বেঁধে, বর্ষভরা পুঁজি,
বৃদ্ধ বছর উধাও হ’ল ভূতের মুলুক খুঁজি।
নূতন বছর এগিয়ে এসে হাত পাতে ঐ দ্বারে,
বল্‌ দেখি মন মনের মতন কি দিবি তুই তারে?
আর কি দিব?- মুখের হাসি, ভরসাভরা প্রাণ,
সুখের মাঝে দুখের মাঝে আনন্দময় গান।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #100

 

– সুকুমার রায়


সম্পাদক বেয়াকুব
কোথা যে দিয়েছে ডুব-
এদিকেতে হায় হায়
ক্লাবটি তো যায় যায়।

তাই বলি সোমবারে
মদগৃহে গড়পারে
দিলে সবে পদধূলি
ক্লাবটিরে ঠেলে তুলি।

রকমারি পুঁথি কত
নিজ নিজ রুচিমত
আনিবেন সাথে সবে
কিছু কিছু পাঠ হবে

করযোড়ে বারবার
নিবেদিছে সুকুমার।


কেউ বলেছে খাবো খাবো,
কেউ বলেছে খাই
সবাই মিলে গোল তুলেছে-
আমি তো আর নাই।

ছোটকু বলে, রইনু চুপে
ক’মাস ধরে কহিল রূপে!
জংলি বলে “রামছাগলের
মাংস খেতে চাই।”

যতই বলি “সবুর কর” –
কেউ শোনে না কালা,
জীবন বলে কোমর বেধে,
কোথায় লুচির থালা?

খোদন বলে রেগেমেগে
ভীষণ রোষে বিষম লেগে-
বিষ্যুতে কাল গড়পারেতে
হাজির যেন পাই।


শনিবার ১৭ ই
সাড়ে পাঁচ বেলা,
গড়পারে হৈ হৈ
সরবতী মেলা।

অতএব ঘড়ি ধরে
সাবকাশ হয়ে
আসিবেন দয়া করে
হাসিমুখে লয়ে।

সরবৎ সদালাপ
সঙ্গীত – ভীতি
ফাঁকি দিলে নাহি মাপ,
জেনে রাখ-ইতি।


আমি,অর্থাৎ সেক্রেটারি,
মাসতিনেক কল‌কেতা ছাড়ি
যেই গিয়েছি অন্য দেশে
অমনি কি সব গেছে ফেঁসে।

বদলে গেছে ক্লাবের হাওয়া,
কাজের মধ্যে কেবল খাওয়া!
চিন্তা নেইক গভীর বিষয়
আমার প্রাণে এসব কি সয়?

এখন থেকে সমঝে রাখ
এ সমস্ত চলবে নাকো,
আমি আবার এইছি ঘুরে
তান ধরেছি সাবেক সুরে।

শুনবে এস সুপ্রবন্ধ
গিরিজার বিবেকানন্দ,
মঙ্গলবার আমার বাসায়।
(আর থেক না ভোজের আশায়)

Bangla Kobita of Sukumar Ray #101

 

– সুকুমার রায়

কুরুকুলে পিতামহ ভীষ্মমহাশয়
ভুবন বিজয়ী বীর, শুন পরিচয়-
শান্তনু রাজার পুত্র নাম সত্যব্রত
জগতে সার্থক নাম সত্যে অনুরত।
স্বয়ং জননী গঙ্গা বর দিলা তাঁরে-
নিজ ইচ্ছা বিনা বীর না মরে সংসারে।
বুদ্বিভ্রংশ ঘটে হায় শান্তনু রাজার,
বিবাহের লাগি বুড়া করে আবদার।
মৎস্যরাজকন্যা আছে নামে সত্যবতী,
তারে দেখি শান্তনুর লুপ্ত হল মতি।
মৎস্যরাজ কহে, ‘রাজা, কর অবধান,
কিসের আশায় কহ করি কন্যাদান?
সত্যব্রত জ্যেষ্ঠ সেই রাজ্য অধিকারী,
আমার নাতিরা হবে তার আজ্ঞাচারি,
রাজমাতা কভু নাহি হবে সত্যবতী,
তেঁই এ বিবাহ- কথা অনুচিত অতি।’
ভগ্ন মনে হস্তিনায় ফিরিল শান্তনু
অনাহারে অনিদ্রয় জীর্ন তার তনু।
মন্ত্রী মুখে সত্যব্রত শুনি সব কথা
মৎস্যরাজপুরে গিয়া কহিল বারতা-
রাজ্যে মম সাধ নাহি, করি অঙ্গীকার
জন্মিলে তোমার নাতি রাজ্য হবে তার।’
রাজা কহে, ‘সাধুতুমি, সত্য তব বাণী,
তোমার সন্তান হতে তবু ভয় মানি।
কে জানে ভবিষ্যকথা, দৈবগতিধারা-
প্রতিবাদী হয় যদি রাজ্যলাভে তারা?’
সত্যব্রত কহে, ‘শুন প্রতিজ্ঞা আমার,
বংশ না রহিবে মম পৃথিবী মাঝার।
সাক্ষী রহ চন্দ্র সূর্য লোকে লোকান্তরে
এই জন্মে সত্যব্রত বিবাহ না করে।’
শুনিয়া অদ্ভুত বাণী ধন্য কহে লোকে,
স্বর্গ হতে পুষ্পধারা ঝরিল পলকে।
সেই হতে সত্যব্রত খ্যাত চরাচরে
ভীষণ প্রতিজ্ঞাবলে ভীষ্ম নাম ধরে।
ঘুচিল সকল বাধা, আনন্দিত চিতে
সত্যবতী রাণী হয় হস্তিনাপুরীতে।
ক্রমে হলে বর্ষ গত শান্তনুর ঘরে
জন্ম নিল নব শিশু, সবে সমাদরে।
রাখিল বিচিত্রবীর্য নামটি তাহার
শান্তনু মরিল তারে দিয়া রাজ্যভার।
অকালে বিচিত্রবীর্য মুদিলেন আঁখি
পাণ্ডু আর ধৃতরাষ্ট্র দুই পুত্র রাখি।।
হস্তিরায় চন্দ্রবংশ কুরুরাজকুল
রাজত্ব করেন সুখে বিক্রমে অতুল।
সেই কুলে জন্মি তবু দৈববশে হায়
অন্ধ বলি ধৃতরাস্ট্র রাজ্য নাহি পায়।
কনিষ্ঠ তাহার পাণ্ডু, রাজত্ব সে করে,
পাঁচটি সন্তান তার দেবতার বরে।
জ্যেষ্ঠপুত্র যুধিষ্ঠির ধীর শান্ত মন
‘সাক্ষাৎ ধর্মের পুত্র’ কহে সর্বজন।
দ্বিতীয় সে মহাবলী ভীম নাম ধরে,
পবন সমান তেজ পবনের বরে।
তৃতীয় অর্জুন বীর, ইন্দ্রের কৃপায়
রুপেগুণে শৌর্যেবীর্যে অতুল ধরায়।
এই তিন সহোদর কুন্তীর কুমার,
বিমাতা আছেন মাদ্রী দুই পুত্র তাঁর-
নকুল ও সহদেব সুজন সুশীল
এক সাথে পাঁচজনে বাড়ে তিল তিল।
অন্ধরাজ ধৃতরাষ্ট্র শতপুত্র তার,
অভিমানী দুর্যোধন জ্যেষ্ঠ সবাকার।
পাণ্ডবেরা পাঁচ ভাই নষ্ট হয় কিসে,
এই চিন্তা করে দুষ্ট জ্বলি হিংসাবিষে।
হেনকালে সর্বজনে ভাসাইয়া শোকে
মাদ্রীসহ পান্ডরাজা যায় পরলোকে।
‘পান্ডু গেল’, মনে মনে ভাবে দুর্যোধন,
এই বারে যুধিষ্ঠির পাবে সিংহাসন!
ইচ্ছা হয় এই দণ্ডে গিয়া তারে মারি-
ভীমের ভয়েতে কিছু করিতে না পারি।
আমার কৌশলে পাকে ভীম যদি মরে
অনায়াসে যুধিষ্ঠিরে মারি তারপরে।’
কুচক্র করিয়া তবে দুষ্ট দুর্যোধন
নদীতীরে উৎসবের করে আয়োজন-
একশত পাঁচ ভাই মিলি একসাথে
আমোদ আহ্লাদে ভোজে মহানন্দে মাতে।
হেন ফাঁকে দুর্যোধন পরম যতনে
বিষের মিষ্টান্ন দেয় ভীমের বদনে।
অচেতন হল ভীম বিষের নেশায়,
সুযোগ বুঝিয়া দুষ্ট ধরিল তাহায়,
গোপনে নদীর জলে দিল ভাসাইয়া,
কেহ না জানিল কিছু উৎসবে মাতিয়া।।
এদিকে নদীর জলে ডুবিয়া অতল তলে
ভীমের অবশ দেহে ,কেমনে জানে না কেহ,
কোথায় ঠেকিল শেষে বাসুকী নাগের দেশে।
ভীমের বিশাল চাপে নাগের বসতি কাঁপে
দেহ ভারে কত মরে, কত পলাইল ডরে ,
কত নাগ দলে বলে ভীমেরে মারিতে চলে
দংশিয়া ভীমের গায় মহাবিষ ঢালে তায়।
অদ্ভুত ঘটিল তাহে ভীম চক্ষু মেলি চাহে ,
বিষে হয় বিষক্ষয় মুহুর্তে চেতনা হয়,
দেখে ভীম চারিপাশে নাগেরা ঘেরিয়া আসে
দেখিয়া ভীষণ রাগে ধরি শত শত নাগে
চূর্ণ করে বাহুবলে, মহাভয়ে নাগে দলে
ছুটে যায় হাহাকরে বাসুকী রাজার দ্বারে।
বাসুকী কহেন, ‘শোন আর ভয় নাহি কোন,
তুষি তারে সুবচনে আন হেথা সযতনে।’
রাজার আদেশে তবে আবার ফিরিয়া সবে
করে গিয়া নিবেদন বাসুকীর নিমন্ত্রণ !
শুনি ভীম কুতুহলে রাজার পুরীতে চলে ,
সেথায় ভরিয়া প্রাণ ,করিয়া অমৃত পান
বিষের যাতনা আর কিছু না রহিল তার ,
মহাঘুমে ভরপুর সব ক্লান্তি হল দুর
তখন বাসুকী তারে স্নেহভরে বারে বারে
আশিস করিয়া তায় পাঠাইল হস্তিনায় ।
সেথা ভাই চারিজনে আছে শোকাকুল মনে
কুন্তীর নয়নজল ঝরে সেথা অবিরল ,
মগন গভীর দুখে ফিরে সবে ম্লান মুখে ।
হেন কালে হারানিধি সহসা মিলালো বিধি
বিষাদ হইল দুর জাগিল হস্তিনাপুর ,
উলসিত কলরবে আনন্দে মাতিল সবে।।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #102

 

– সুকুমার রায়

মাকড়সা
সান্‌-বাঁধা মোর আঙিনাতে
জাল বুনেছি কালকে রাতে,
ঝুল ঝেড়ে সব সাফ করেছি বাসা।
আয় না মাছি আমার ঘরে,
আরাম পাবি বসলে পরে,
ফরাশ পাতা দেখবি কেমন খাসা!

মাছি
থাক্‌ থাক্‌ থাক্‌ আর বলে না,
আন্‌কথাতে মন গলে না-
ব্যবসা তোমার সবার আছে জানা।
ঢুক্‌লে তোমার জালের ঘেরে
কেউ কোনদিন আর কি ফেরে?
বাপ্‌রে! সেথায় ঢুক্‌তে মোদের মানা।

মাকড়সা
হাওয়ায় দোলে জালের দোলা
চারদিকে তার জান্‌লা খোলা
আপ্‌নি ঘুমে চোখ যে আসে জুড়ে!
আয় না হেথা হাত পা ধুয়ে
পাখ্‌না মুড়ে থাক্‌ না শুয়ে-
ভন্‌ ভন্‌ ভন্‌ মরবি কেন উড়ে?

মাছি
কাজ নেই মোর দোলায় দুলে,
কোথায় তোমার কথায় ভুলে
প্রাণটা নিয়ে টান্‌ পড়ে ভাই শেষে।
তোমার ঘরে ঘুম যদি পায়
সে ঘুম কভু ভাঙবে না হায়-
সে ঘুম নাকি এমন সর্বনেশে!

মাকড়সা
মিথ্যে কেন ভাবিস্‌ মনে?
দেখ্‌না এসে ঘরের কোণে
ভাঁড়ার ভরা খাবার আছে কত!
দে-টাপাটপ ফেলবি মুখে
নাচ্‌বি গাবি থাক্‌বি সুখে
ভাবনা ভুলে বাদ্‌শা-রাজার মতো।

মাছি
লোভ দেখালেই ভুলবে ভবি,
ভাবছ আমায় তেমনি লোভী!
মিথ্যে দাদা ভোলাও কেন খালি,
করব কি ছাই ভাড়ার দেখে?
প্রণাম করি আড়াল থেকে-
আজকে তোমার সেই গুড়ে ভাই বালি।

মাকড়সা
নধর কালো বদন ভরে
রূপ যে কত উপচে পড়ে!
অবাক দেখি মুকুটমালা শিরে!
হাজার চোখে মানিক জ্বলে!
ইন্দ্রধনু পাখার তলে!
ছয় পা ফেলে আয় না দেখি ধীরে।

মাছি
মন ফুর্‌ফুর্‌ ফুর্তি নাচে-
একটুখানি যাই না কাছে!
যাই যাই যাই- বাপ্‌রে একি বাঁধা।
ও দাদা ভাই রক্ষে কর!
ফাঁদ পাতা এ কেমন তরো।
পড়ে হাত পা হল বাঁধা।

দুষ্টুলোকের মিষ্টি কথায়
দুষ্টুলোকের মিষ্টি কথায়
নাচলে লোকের স্বস্তি কোথায়?
এমনি দশাই তার কপালে লেখা।
কথার পাকে মানুষ মেরে
মাকড়জীবী ঐ যে ফেরে,
গড় করি তার অনেক তফাৎ থেকে।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #103

 

– সুকুমার রায়

সাগর যেথা লুটিয়ে পড়ে নতুন মেঘের দেশে-
আকাশ-ধোয়া নীল যেখানে সাগর জলে মেশে ।
মেঘের শিশু ঘুমায় সেথা আকাশ-দোলায় শুয়ে-
ভোরের রবি জাগায় তারে সোনার কাঠি ছুঁয়ে ।
সন্ধ্যা সকাল মেঘের মেলা- কুলকিনারা ছাড়ি
রং বেরঙের পাল তুলে দেয় দেশবিদেশে পাড়ি ।
মাথায় জটা, মেঘের ঘটা আকাশ বেয়ে ওঠে,
জোছনা রাতে চাঁদের সাথে পাল্লা দিয়ে ছোটে ।
কোন্‌ অকুলের সন্ধানেতে কোন্‌ পথে যায় ভেসে-
পথহারা কোন্‌ গ্রামের পরে নাম-জানা-নেই-দেশে ।
ঘূর্ণীপথের ঘোরের নেশা দিক্‌বিদিকে লাগে,
আগল ভাঙা পাগল হাওয়া বাদল রাতে জাগে ;
ঝড়ের মুখে স্বপন ছুটে আঁধার আসে ঘিরে !
মেঘের প্রাণে চমক হানে আকাশ চিরে চিরে !
বুকের মাঝে শঙ্খ বাজে- দুন্দুভি দেয় সাড়া !
মেঘের মরণ ঘনিয়ে নামে মত্ত বাদল ধারা ।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #104

 

– সুকুমার রায়

আকাশের ময়দানে বাতাসের ভরে,
ছোট বড় সাদা কালো কত মেঘ চরে।
কচি কচি থোপা থোপা মেঘেদের ছানা
হেসে খেলে ভেসে যায় মেলে কচি ডানা।
কোথা হতে কোথা যায় কোন্‌ তালে চলে,
বাতাসের কানে কানে কত কথা বলে।
বুড়ো বুড়ো ধাড়ি মেঘ ঢিপি হয়ে উঠে-
শুয়ে ব’সে সভা করে সারাদিন জুটে।
কি যে ভাবে চুপ্‌চাপ, কোন ধ্যানে থাকে,
আকাশের গায়ে গায়ে কত ছবি আঁকে।
কত আঁকে কত মোছে, কত মায়া করে,
পলে পলে কত রং কত রূপ ধরে।
জটাধারী বুনো মেঘ ফোঁস ফোঁস ফোলে,
গুরুগুরু ডাক ছেড়ে কত ঝড় তোলে।
ঝিলিকের ঝিকিমিকি চোখ করে কানা,
হড়্‌ হড়্‌ কড়্‌ কড়্‌ দশদিকে হানা।
ঝুল্‌ কালো চারিধার, আলো যায় ঘুচে,
আকাশের যত নীল সব দেয় মুছে।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #105

 

– সুকুমার রায়

রামগরুড়ের ছানা হাসতে তাদের মানা,
হাসির কথা শুনলে বলে,
“হাসব্ না-না, না-না”।
সদাই মরে ত্রাসে- ঐ বুঝি কেউ হাসে!
এক চোখে তাই মিট্‌মিটিয়ে
তাকায় আশে পাশে।
ঘুম নাহি তার চোখে আপনি বকে বকে
আপনারে কয়, “হাসিস্ যদি
মারব কিন্তু তোকে!”
যায় না বনের কাছে, কিম্বা গাছে গাছে,
দখিন হাওয়ার সুড়সুড়িতে
হাসিয়ে ফেলে পাছে!
সোয়াস্তি নেই মনে- মেঘের কোণে কোণে
হাসির বাষ্প উঠ্‌ছে ফেঁপে
কান পেতে তাই শোনে।
ঝোপের ধারে ধারে রাতের অন্ধকারে
জোনাক্ জ্বলে আলোর তালে
হাসির ঠারে ঠারে ।
হাসতে হাসতে যারা হচ্ছে কেবল সারা
রামগরুড়ের লাগছে ব্যথা
বুঝছে না কি তারা?
রামগরুড়ের বাসা ধমক দিয়ে ঠাসা,
হাসির হাওয়া বন্ধ সেথায়
নিষেধ সেথায় হাসা।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #106

 

– সুকুমার রায়

হাত -পা- ভাঙ্গা নোংরা পুতুল মুখটি ধুলোয় মাখা,
গাল দুটি তার খাবলা মতন চোখ দুটি তার ফাঁকা-
কোথায় বা তার চুল বিনুনি, কোথায় বা তার মাথা,
আধখানি তার ছিন্ন জামা,গায় দিয়েছে কাঁথা।
পুতুলের মা ব্যস্ত কেবল তার সেবাতেই রত,
খাওয়ান শোয়ান আদর করেন ঘুম ডেকে দেন কত।
বলতে গেলাম “বিশ্রী পুতুল” অমনি বলেন রেগে –
“লক্ষ্মী পুতুল জ্বর হয়েছে তাইত এখন জেগে।”
দ্বিগুন জোরে চাপড়ে দিল “আয় আয় আয়” ব’লে-
নোংরা পুতুল লক্ষ্মী হ’য়ে পড়ল ঘুমে ঢুলে!

Bangla Kobita of Sukumar Ray #107

 

– সুকুমার রায়

ওই আমাদের পাগলা জগাই, নিত্যি হেথায় আসে;
আপন মনে গুন্ গুনিয়ে মুচ্‌কি হাসি হাসে ।
চলতে গিয়ে হঠাৎ যেন ধমক লেগে থামে;
তড়াক্ করে লাফ দিয়ে যায় ডাইনে থেকে বামে।
ভীষন রোখে হাত গুটিয়ে সামলে নিয়ে কোচাঁ ;
“এইয়ো” বলে ক্ষ্যাপার মতো শুন্যে মারে খোচাঁ ।
চেঁচিয়ে বলে ,”ফাদঁ পেতেছ ? জগাই কি তায় পড়ে?
সাত জার্মান, জগাই একা, তবুও জগাই লড়ে।”
উৎসাহেতে গরম হয়ে তিড়িং বিড়িং নাচে,
কখনও যায় সামনে তেড়ে, কখনও যায় পাছে।
এলোপাতাড়ি ছাতার বাড়ি ধুপুস ধাপুস্ কত!
চক্ষু বুজে কায়দা খেলায় চর্কিবাজির মত।
লাফের চোটে হাঁপিয়ে ওঠে গায়েতে ঘাম ঝরে,
দুড়ুম ক’রে মাটির পরে লম্বা হয়ে পড়ে।
হাত পা ছুঁড়ে চেঁচায় খালি চোখ্‌টি ক’রে ঘোলা,
“জগাই মেলো হঠাৎ খেয়ে কামানের এক গোলা”!
এই না বলে মিনিট খানেক ছট্ফটিয়ে খুব,
মড়ার মত শক্ত হ’য়ে এক্কেবারে চুপ !
তার পরেতে সটান্ বসে চুলকে খানিক মাথা,
পকেট থেকে বার করে তার হিসেব লেখার খাতা।
লিখলে তাতে- “শোনরে জগাই, ভীষন লড়াই হলো
পাচ ব্যাটাকে খতম করে জগাই দাদা মোলো।”

Bangla Kobita of Sukumar Ray #108

 

– সুকুমার রায়

কি ভেবে যে আপন মনে
হাসি আসে ঠোঁটের কোণে,-

আধ আধ ঝাপসা বুলি
কোন কথা কয়না খুলি ।

বসে বসে একলা নিজে
লোভী ছেলে ভাবেন কি যে-

শুধু শুধু চামচ চেটে
মনে মনে সাধ কি মেটে ?

একটুখানি মিষ্টি দিয়ে
রাখ আমায় চুপ করিয়ে,

নইলে পরে চেঁচিয়ে জোরে
তুলব বাড়ি মাথায় ক’রে ।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #109

 

– সুকুমার রায়

ঠাস্‌ ঠাস্‌ দ্রুম দ্রাম,শুনে লাগে খটকা–
ফুল ফোটে? তাই বল! আমি ভাবি পট্‌কা!
শাঁই শাঁই পন্‌ পন্‌, ভয়ে কান বন্ধ–
ওই বুঝি ছুটে যায় সে-ফুলের গন্ধ?
হুড়মুড় ধুপধাপ–ওকি শুনি ভাইরে!
দেখ্‌ছনা হিম পড়ে– যেও নাকো বাইরে।
চুপ চুপ ঐ শোন্‌! ঝুপ ঝাপ্‌ ঝপা-স!
চাঁদ বুঝি ডুবে গেল? গব্‌ গব্‌ গবা-স!
খ্যাঁশ্‌ খ্যাঁশ্‌ ঘ্যাঁচ্‌ ঘ্যাঁচ্‌ , রাত কাটে ঐরে!
দুড়দাড় চুরমার–ঘুম ভাঙে কই রে!
ঘর্ঘর ভন্‌ ভন্‌ ঘোরে কত চিন্তা!
কত মন নাচ শোন্‌–ধেই ধেই ধিন্‌তা!
ঠুংঠাং ঢংঢং, কত ব্যথা বাজেরে–
ফট্‌ ফট্‌ বুক ফাটে তাই মাঝে মাঝে রে!
হৈ হৈ মার্ মার্ “বাপ্‌ বাপ্‌” চিৎকার–
মালকোঁচা মারে বুঝি? সরে পড়্ এইবার।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #110

 

– সুকুমার রায়

চশমা-আঁটা পণ্ডিতে কয় শিশুর দেহ দেখে-
‘হাড়ের পরে মাংস দিয়ে, চামড়া দিয়ে ঢেকে,
শিরার মাঝে রক্ত দিয়ে, ফুসফুসেতে বায়ু,
বাঁধল দেহ সুঠাম করে পেশী এবং স্নায়ু।’
কবি বলেন, ‘শিশুর মুখে হেরি তরুণ রবি,
উৎসারিত আনন্দে তার জাগে জগৎ ছবি।
হাসিতে তার চাঁদের আলো, পাখির কলকল,
অশ্রুকণা ফুলের দলে শিশির ঢলঢল।’
মা বলেন, ‘এই দুরুদুরু মোর বুকেরই বাণী,
তারি গভীর ছন্দে গড়া শিশুর দেহখানি।
শিশুর প্রাণে চঞ্চলতা আমার অশ্রুহাসি,
আমার মাঝে লুকিয়েছিল এই আনন্দরাশি।
গোপনে কোন্‌ স্বপ্নে ছিল অজানা কোন আশা,
শিশুর দেহে মূর্তি নিল আমার ভালবাসা।’

Bangla Kobita of Sukumar Ray #111

 

– সুকুমার রায়

শুনেছ কি বলে গেল সীতানাথ বন্দ্যো?
আকাশের গায়ে নাকি টকটক গন্ধ?
টকটক থাকে নাকো হ’লে পরে বৃষ্টি-
তখনও দেখেছি চেটে একেবারে মিষ্টি।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #112

 

– সুকুমার রায়

জল ঝরে জল ঝরে সারাদিন সারারাত-
অফুরান্‌ নামতায় বাদলের ধারাপাত ।
আকাশের মুখ ঢাকা, ধোঁয়ামাখা চারিধার,
পৃথিবীর ছাত পিটে ঝামাঝম্‌ বারিধার ।
স্নান করে গাছপালা প্রাণখোলা বরষায়,
নদীনালা ঘোলাজল ভরে ওঠে ভরসায় ।
উৎসব ঘনঘোর উন্মাদ শ্রাবণের
শেষ নাই শেষ নাই বরষার প্লাবনের ।
জলেজলে জলময় দশদিক্‌ টলমল্‌,
অবিরাম একই গান, ঢালো জল ঢালো জল ।
ধুয়ে যায় যত তাপ জর্জর গ্রীষ্মের,
ধুয়ে যায় রৌদ্রের স্মৃতিটুকু বিশ্বের ।
শুধু যেন বাজে কোথা নিঃঝুম ধুক্‌ধুক্‌,
ধরণীর আশাভয় ধরণীর সুখদুখ ।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #113

 

– সুকুমার রায়

আমি অর্থাৎ শ্রীগোবিন্দ মানুষটি নই বাঁকা!
যা বলি তা ভেবেই বলি, কথায় নেইক ফাঁকা।
এখনকার সব সাহেবসুবো, সবাই আমায় চেনে
দেখ্তে চাও ত দিতে পারি সাটিফিকেট এনে।
ভাগ্য আমায় দেয়নি বটে করতে বি-এ পাশ,
তাই বলে কি সময় কাটাই কেটে ঘোড়ার ঘাস?
লোকে যে কয় বিদ্যে আমার ‘কথামালা’ই শেষ-
এর মধ্যে সত্যি কথা নেইক বিন্দুলেশ।
ওদের পাড়ার লাইব্রেরিতে কেতাব আছে যত
কেউ পড়েছে তন্নতন্ন করে আমায় মতো?
আমি অর্থাৎ শ্রীগোবিন্দ এমনি পড়ার যম
পড়াশুনো নয়ক আমার কারুর চেয়ে কম।
কতকটা এই দেখেশিখে কতক পড়েশুনে,
কতক হয়ত স্বাভাবিকী প্রতিভারই গুণে
উন্নতিটা করছি যেমন আশ্চর্য তা ভারি,
নিজের মুখে সব কথা তার বলতে কি আর পারি?
বলে গেছেন চন্ডীপতি কিংবা অন্য কেউ
“আকাশ জুড়ে মেঘের বাসা, সাগরভরা ঢেউ,
জীবনটাও তেমনি ঠাসা কেবল বিনা কাজে-
যেদিক দিয়ে খরচ করি সেই খরচই বাজে!”
আমি অর্থাৎ শ্রীগোবিন্দ চলতে ফিরতে শুতে
জীবনটাকে হাঁকাই নেকো মনের রথে জুতে।

হাইড্রোজেনের দুই বাবাজি অক্সিজেনের এক
নৃত্য কবেন গলাগলি কান্ডখানা দেখ্,
আহাদেতে এক্‌সা হলে গলে হলেন জল
এই সুযোগে সুবোধ শিশু “শ্রীগোবিন্দ” বল্।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #114

 

– সুকুমার রায়

পড় বিজ্ঞান হবে দিকজ্ঞান ঘুচিবে পথের ধাঁধা
দেখিবে গুণিয়া এ দিন দুনিয়া নিয়ম নিগড়ে বাঁধা।
কহে পন্ডিতে জড়সন্ধিতে বস্তুপিন্ড ফাঁকে
অনু অবকাশে রন্ধ্রে- রন্ধ্রে আকাশ লুকায়ে থাকে।
হেথা হেথা সেথা জড়ের পিন্ড আকাশ প্রলেপে ঢাকা
নয়কো কেবল নিরেট গাঁথন, নয়কো কেবলি ফাঁকা।
জড়ের বাঁধন বদ্ধ আকাশে, আকাশে বাঁধন জড়ে-
পৃথিবী জুড়িয়া সাগর যেমন, প্রাণটি যেমন ধড়ে।;
‘ইথার’ পাথারে তড়িত বিকারে জড়ের জীবন দোলে,
বিশ্ব – মোহের সুপ্তি ভাঙিছে সৃষ্টির কলরোলে।।

শুন শুন বার্তা নুতন, কে যেন স্বপন দিলা
ভাষা প্রাঙ্গণে স্বরে ব্যাঞ্জনে ছন্দ করেন লীলা ।
সৃষ্টি যেথায় জাগে নিরুপায় প্রলয় পয়োধি তীরে
তারি আশেপাশে অন্ধ হুতাশে আকাশ কাঁদিয়া ফিরে।
তাই ক্ষণে ক্ষণে জড়ো ব্যঞ্জনে স্বরের পরশ লাগে
তাই বারেবার মৃদু হাহাকার কলসংগীতে জাগে
স্বরব্যঞ্জন যেন দেহমনে জড়েতে চেতন বাণী
একে বিনা আর থাকিতে না পারে, প্রাণ লয়ে টানাটানি।
দোঁহি ছাড়ি দোঁহে, মূক রহে মোহে, ব্যঞ্জনে নাহি বুলি
স্বরের নিশাসে ‘আহা’ ‘উহু’ ভাষে ভাষার বারতা ভুলি।
ছিল অচেতন জগৎ যখন মগন আদিম ধুমে,
অরূপ তিমির স্তব্ধ বধির স্বপ্ন মদির ঘুমে:
আকুল গন্ধে আকাশ কুসুম উদাসে সকল দিশি,
অন্ধ জড়ের বিজন আড়ালে কে যেন রয়েছে মিশি!
স্তিমিত-স্বপ্ন স্বরের বর্ণ জড়ের বাধন ছিড়ি
ফিরে দিশাহারা কোথা ধ্রুবতারা কোথা র্স্বগের সিঁড়ি!
অ আ ই ঈ উ ঊ, হা হি হি হু হু হাল্কা শীতের হাওয়া
অলখচরণ প্রেতের চলন, নিঃশ্বাসে আসা যাওয়া ।
লেখে কি না খেলে ছায়ার আঙুলে বাতাসে বাজায় বীণা
আবেশ বিভোর আফিঙের ঘোর বস্তুত মন্ত্রহীনা।
ভাবে কুল নাই একা আসি যাই যুগে যুগে চিরদিন,
কাল হতে কালে আপনার তালে অনাহত বাধাহীন।।

অকুল অতলে অন্ধ অচলে অস্ফুট অমানিশি,
অরূপ আধারে আখি অগোচরে অনুতে অনুতে মিশি।

আসে যায় আসে অবশ আয়াশে আবেশ আকুল প্রাণে,
অতি আনমানা করে আনাগোনা অচেনা অজানা টানে,
আধো আধো ভাষা আলেয়ার আসা , আপনি আপনহারা
আদিম আলোতে আবছায়া পথে আকাশগঙ্গা- ধারা।

ইচ্ছা বিকল ইন্দ্রিয়দল, জড়িত ইন্দ্রজালে,
ঈশারা আভাসে ঈঙ্গিতে ভাষে রহ-রহ ইহকালে।

উড়ে ইতিউতি উতালা আকুতি উসখুস উকিঝুঁকি
উড়ে উচাটন, উড়ু উড়ু মন , উদাসে উধ্বমুখি।

এমন একেলা একা একা খেলা একুলে ওকুলে ফের
এপার ওপার এ যে একাকার একেরি একেলা হের।
হেরে একবার সবি একাকার একেরি এলাকা মাঝে
ঐ ওঠে শুনি, ওঙ্কার-ধ্বনি, একুলে ওকুলে বাজে।

ওরে মিথ্যা এ আকাশ-চারণ মিথ্যা তোদের খোঁজা,
স্বর্গ তোদের বস্তু সাধনে বহিতে জড়ের বোঝা।
আকাশ বিহানে বস্তু অচল, চলে না জড়ের চাকা,
আদুল আকাশে ফোকলা বাতাস কেবলি আওয়াজ ফাঁকা।

সৃষ্টিতত্ত্ব বিচার করনি শাস্ত্র পড়নি দাদা-
জড়ের পিন্ড আকাশে গুলিয়া ঠাসিবে ভাষার কাদা।
শাস্ত্রবিধান কর প্রণিধান ওরে উদাসীন অন্ধ,
ব্যঞ্জনস্বরে যেন হরিহরে কোথাও রবে না দ্বন্দ্ব।
মরমে মরমে সরম পরশে বাতাস লাগিয়ে হাড়ে,
ভাষার প্রবাহে পুলক- কম্পে জড়ের জতো ছাড়ে।
(তবে)আয় নেমে আয়, জড়ের সভায় , জীবন মরণ দোলে,
আয় নেমে আয়, ধরণীধুলায় কীর্তন কলরোলে।
আয় নেমে আয় রূপের মায়ায় অরূপ ইন্দ্রজালে
উল্কা ঝলকে থনল পুলকে আয় রে অশনিতালে।
আয় নেমে আয় কণ্ঠ্য বর্ণে কাকুতি করিছে সবে
আয় নেমে আয় র্ককশ ডাকে প্রভাতে কাকের রবে।

নামো নামো নমঃ সৃষ্টি প্রথম কারণ জলধি জলে
স্তব্দ তিমিরে প্রথম কাকলী প্রথম কৌতুহলে।
আদিম তমসে প্রথম বর্ণ কনক কিরণ মালা
প্রথম ক্ষুধিত বিশ্ব জঠরে প্রথম প্রশ্ন জ্বালা।

অকূল আঁধারে কুহকপাথারে কে আমি একেলা কবি
হেরি একাকার সকল আকার সকলি আপন ছবি ।
কহে,কই কে গো, কোথায় কবে গো ,কেন বা কাহারে ডাকি?
কহে কহ-কহ , কেন অহরহ ,কালের কবলে থাকি?
কহে কানে কানে করুণ কুজনে কলকল কত ভাষে,
কহে কোলাহলে কলহ কুহরে কাষ্ঠ কঠোর হাসে।
কহে কটঁমট কথা কাটা কাটা -কেওকেটাঁ কহ কারে ?
কাহার কদর কোকিল কণ্ঠে,কুন্দু কুসুম হারে?
কবি কল্পনে কাব্যে কলায় কাহারে করিছ সেবা
কুবের কতন কুঞ্জকাননে, কাঙালি কুটিরে কেবা।
কায়দা কানুনে ,কার্য কারণে কীর্তিকলাপ মুলে ,
কেতাবে কোরানে কাগজে কলমে কাঁদায়ে কেরানীকুলে ।
কথা কাড়ি -কাড়ি কত কানাকড়ি কাজে কচু কাচকলা
কভু কাছাকোছা কোর্তা কলার কভু কৌপীন ঝোলা ।
কুৎসা -কথনে কুটিলে কৃপণে কুলীন কন্যাদায়ে
কর্মকান্ত কুলিম কান্ত,ক্লিষ্ট কাতর কায়ে ।
কলে কৌশলে ,কপট কোদলে ,কঠিনে কোমলে মিঠে
কেদ কুৎসিত ,কুষ্ঠ কলুষ কিলবিল কৃমি কীটে।
কহ সে কাহার কুহক পাথারু “কে আমি একেলা কবি ?
কেন একাকার সকল আকার সকলি আপন ছবি !”
‘ক’-এর কাঁদনে ,কাংস্য-ক্বণনে বর্ণ লভিল কায়া
গহন শুন্যে জড়ের ধাক্কা কালের করাল ছায়া।
সুপ্ত গগনেকরুণ বেদনে বস্তুচেতন জাগে
অকাল ক্ষুধিত খাই খাই রবে বিশ্বে তরাস লাগে
আকাশ অবধি ঠেকিল জলধি,খেয়াল জেগেছে খ্যাপা
কারে খেতে চায় খুজে নাহি পায় দেখ কি বিষম হ্যাপা!
(খালি)কর্তালে কভু কীর্তন খোলে? খোলে দাও চাটিপেটা !
নামাও আসরে ‘ক’এর দোসরে, খেঁদেলো খেদেলো খেঁটা।”
কহ মহামুনি কহ খুর শুনি ‘খ’য়ের খবর খাঁটি
খামারে খোয়ারে খানায় খন্দে খুজিনু খয়ের ঘাঁটি।
কহেন বচন খুড়ে খন্‌খন্ পাখালি আঁখির দিঠি
খালি খ্যাঁচাখ্যাঁচি খামচাখামচি খুঁৎখূঁতি খিটিমিটি ।
এখনো খুলেনি মুখের খোলস? এখনো খোলেনি আখি?
নিক খেয়ালে পেখম ধরিয়া, কি খেলা খেলিল পাখি!
এখনও রাখনা ক্ষুধার খবর এখনও শেখনি ভাষা
পঞ্চকোষের মুখের খোসাতে অন্ন দেখনি ঠাসা?
খোল খরতালে খোলসা খেয়ালে ‘খোল খোল খোল ‘বলে ,
শখের খাঁচার খিড়কী খুলিয়া খঞ্জ খেয়াল চলে।
সে ক্ষুধায় পাখি পেখম খুলিয়া খাঁছায় খেমটা নাচে
আখেরী ক্ষুধায় সখের ভিখারী খাস্তা খাবার যাচে-
প্রখর-ক্ষুধিত তোখড় -খেয়াল -খেপিয়া রুখিল ত্বরা,
চাখিয়া দেখিল, খাসা এ অখিল খেয়ালে-রচিত ধারা ।
খুঁজে সুখে দুখে খেয়ালের ভুলে খেয়ালে নিরখি সবি ,
খেলার খেয়ালে নিখিল -খেয়াল লিখিল খেয়াল ছবি ।
খেলার লীলা খদ্যোৎ-শিখা খেয়াল খধুপ -ধুপে’
শিখী পাখা পরে নিখুত আখরে খচিত খেয়াল রূপে ।
খোদার উপরে খোদকারী করে ওরে ও ক্ষিপ্ত মতি
কীলিয়ে অকালে কাঁঠাল পাকালে আখেরে কি হবে গতি ?
খেয়ে খুরো চাঁটি খোল কহে খাঁটি, ‘খাবি খাব ক্ষতি নাই,’
খেয়ালের বাণী করে কানাকানি – ‘গতি নাই, গতি নাই।’
নিখিল খেয়াল খসড়া খাতায় লিখিল খেয়াল ছবি
ক্ষণিকের সাথে খেয়ালের মুখে খতিয়া রাখিল সবি।

গতি কিসে হবে, চিন্তিয়া তবে বচন শুনিনু খাসা,
পঞ্চ কোষের প্রথম খোসাতে অন্ন রয়েছে ঠাসা!
আত্মার মুখে আদিম -অন্ন তাহে ব্যঞ্জনগুলি
অনুরাগে লাগি,করে ভাগাভাগি মুখে-মুখে দাও তুলি।
এত বলি ঠেলি আত্মারে তুলি তত্ত্বের লগি ধরি,
খেয়ালের প্রাণী রহে চুপ মানি বিস্ময়ে পেট ভারি ।
কবে কেবা জানে গতির গড়ানে গোপন গোমুখী হতে
কোন ভগীরথে গলাল জগতে গতির গঙ্গা স্রোতে।
দেখ আগাগোড়া গণিতের গড়া নিগূঢ় গুণ সবি
গতির আবেগে আগুয়ান বেগে অগণিত গ্রহরবি।
গগনে গগনে গোধুলি লগনে মগন গভীর গানে,
করে গমগম আগম নিগম গুরু গম্ভীর ধ্যানে।
গিরি গহ্বরে অসাধ সাগরে গঞ্জে নগরে-গ্রামে,
গাঁজার গাজনে গোষ্ঠে গহনে গোকুলে গোলকধামে।

শুনি সাবধানে কহি কানে কানে শাস্ত্রবচন ধরি
কৌশলে ঋষি কহে কখগঘ কাহারে স্মরণ করে
কয়ে দেখ জল খয়ে শুন্যতল গ’য়ে গতি অহরহ
কভূ জলে ভাসে কভূ সে আকাশে হংস যাহারে কহ ।
আঘাতে যে মারে ‘ঘ’কহি তারে হন ধাতু ‘ড’ করি
তেঁই কখগঘ কৃষ্ণে জানহ হংস-অসুর -অরি।
ব্যঙ্গে রঙ্গে ভ্রুকুটি -ভঙ্গে সঙ্গীত কলরবে
রণহুংকারে ধনুঠংকারে শংকিত কর সবে ।
বিকল অঙ্গে ভগ্নজঙঘ এ কোন পঙ্গু মুনি ?
কেন ভাঙ্গা ঠ্যাংঙে ডাঙায় নামিল বাঙালা মুলুকে শুনি।
রাঙা আঁখি জলে চাঙ্গা হয়ে বলে ডিঙাব সাগর গিরি ,
কেন ঢঙ ধরি ব্যাঙাচির মতো লাঙুল জুড়িয়া ফিরি ?

টলিল দুয়ার চিত্তগুহার চকিতে চিচিংফাক
শুনি কলকল ছুটে কোলাহল শুনি চল চল ডাক ।
চলে চঁটপট চকিত চরণ ,চোঁচা চম্পট নৃত্যে
চল চিত্রিত চিরচিন্তন চলে চঞ্চল চিত্তে।
চলে চঞ্চলা চপল চমকে,চারু চৌচির বক্রে।
চলে চন্দ্রমা চলে চরাচর চড়ি চড়কের বক্রে
চলে চকমকি চোখের চাহনে চঞ্চরী চল ছন্দ ,
চলে চিৎকার চাবুক চালনে চপট চাপড়ে চন্ড
চলে চুপি চুপি চতুর চৌর চৌদিকে চাহে ত্রস্ত
চলে চুড়ামণি চর্বে চোষ্যে চটি চৈতনে চোস্ত
চিকন চাদর চিকুর চাঁচর চোখা চালিয়াৎ চ্যাংড়া ,
চলে চ্যাংব্যাং চিতল কাতল চলে চুনোপুটি ট্যাংরা।।

ছোটে ছঁটফটি ছায়ার ছমক ছমলীলার ছলে
ছায়ারঙে মিশি ছোটে ছয় দিশি ছায়ার ছাঊনী তলে
ছোটে ছায়াবাহু পিছে পিছে পিছে ছন্দে ছুটেছে রবি
ছয় ঋতু ছোটে ছায়ার ছন্দে ছবির পিছনে ছবি
ছায়াপথ – ছায়ে জ্যোছনা বিছায়ে…

Bangla Kobita of Sukumar Ray #115

 

– সুকুমার রায়

বিদ্যে বোঝাই বাবুমশাই চড়ি সখের বোটে,
মাঝিরে কন, ”বলতে পারিস সূর্যি কেন ওঠে?
চাঁদটা কেন বাড়ে কমে? জোয়ার কেন আসে?”
বৃদ্ধ মাঝি অবাক হয়ে ফ্যালফ্যালিয়ে হাসে।
বাবু বলেন, ”সারা জীবন মরলিরে তুই খাটি,
জ্ঞান বিনা তোর জীবনটা যে চারি আনাই মাটি।”

খানিক বাদে কহেন বাবু, ”বলতো দেখি ভেবে
নদীর ধারা কেমনে আসে পাহাড় থেকে নেবে?
বলতো কেন লবণ পোরা সাগর ভরা পানি?”
মাঝি সে কয়, ”আরে মশাই অত কি আর জানি?”
বাবু বলেন, ”এই বয়সে জানিসনেও তা কি
জীবনটা তোর নেহাৎ খেলো, অষ্ট আনাই ফাঁকি!”

আবার ভেবে কহেন বাবু, ” বলতো ওরে বুড়ো,
কেন এমন নীল দেখা যায় আকাশের ঐ চুড়ো?
বলতো দেখি সূর্য চাঁদে গ্রহণ লাগে কেন?”
বৃদ্ধ বলে, ”আমায় কেন লজ্জা দেছেন হেন?”
বাবু বলেন, ”বলব কি আর বলব তোরে কি তা,-
দেখছি এখন জীবনটা তোর বারো আনাই বৃথা।”

খানিক বাদে ঝড় উঠেছে, ঢেউ উঠেছে ফুলে,
বাবু দেখেন, নৌকাখানি ডুবলো বুঝি দুলে!
মাঝিরে কন, ” একি আপদ! ওরে ও ভাই মাঝি,
ডুবলো নাকি নৌকা এবার? মরব নাকি আজি?”
মাঝি শুধায়, ”সাঁতার জানো?”- মাথা নাড়েন বাবু,
মূর্খ মাঝি বলে, ”মশাই, এখন কেন কাবু?
বাঁচলে শেষে আমার কথা হিসেব করো পিছে,
তোমার দেখি জীবন খানা ষোল আনাই মিছে!”

Bangla Kobita of Sukumar Ray #116

 

– সুকুমার রায়

সবাই নাচে ফূর্তি করে সবাই করে গান,
একলা বসে হাঁড়িচাঁচার মুখটি কেন ম্লান ?
দেখ্‌ছ নাকি আমার সাথে সবাই করে আড়ি-
তাইত আমার মেজাজ খ্যাপা মুখটি এমন হাঁড়ি ।
তাও কি হয় ! ঐ যে মাঠে শালিখ পাখি ডাকে
তার কাছে কৈ যাওনিকো ভাই শুধাওনিতো তাকে !
শালিখ পাখি বেজায় ঠ্যাঁটা চেঁচায় মিছিমিছি,
হল্লা শুনে হাড় জ্বলে যায় কেবল কিচিমিচি ।
মিষ্টি সুরে দোয়েল পাখি জুড়িয়ে দিল প্রাণ
তার কাছে কৈ বস্‌লে নাতো শুনলে না তার গান ।
দোয়েল পাখির ঘ্যান্‌ঘ্যানানি আর কি লাগে ভালো ?
যেমন রূপে তেমন গুণে তেমনি আবার কালো ।
রূপ যদি চাও যাও না কেন মাছরাঙার কাছে,
অমন খাসা রঙের বাহার আর কি কারো আছে ?
মাছরাঙা ? তারেও কি আর পাখির মধ্যে ধরি
রকম সকম সঙের মতন, দেমাক দেখে মরি ।
পায়রা ঘুঘু কোকিল চড়াই চন্দনা টুনটুনি
কারে তোমার পছন্দ হয়, সেই কথাটি শুনি !
এই গুলো সব ছ্যাবলা পাখি নেহাৎ ছোট জাত-
দেখলে আমি তফাৎ হাটি অমনি পঁচিশ হাত ।
এতক্ষণে বুঝতে পারি ব্যাপারখানা কি যে-
সবার তুমি খুঁৎ পেয়েছ নিখুঁৎ কেবল নিজে !
মনের মতন সঙ্গী তোমার কপালে নাই লেখা
তাইতে তোমায় কেউ পোঁছে না তাইতে থাক একা ।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #117

 

– সুকুমার রায়

শুনতে পেলাম পোস্তা গিয়ে—
তোমার নাকি মেয়ের বিয়ে ?
গঙ্গারামকে পাত্র পেলে ?
জানতে চাও সে কেমন ছেলে ?
মন্দ নয় সে পাত্র ভালো
রঙ যদিও বেজায় কালো ;
তার উপরে মুখের গঠন
অনেকটা ঠিক পেঁচার মতন ;
বিদ্যে বুদ্ধি ? বলছি মশাই—
ধন্যি ছেলের অধ্যবসায় !
উনিশটিবার ম্যাট্রিকে সে
ঘায়েল হয়ে থামল শেষে ।
বিষয় আশয় ? গরীব বেজায়—
কষ্টে–সৃষ্টে দিন চলে যায় ।

মানুষ তো নয় ভাইগুলো তার—
একটা পাগল একটা গোঁয়ার ;
আরেকটি সে তৈরী ছেলে,
জাল করে নোট গেছেন জেলে ।
কনিষ্ঠটি তবলা বাজায়
যাত্রাদলে পাঁচ টাকা পায় ।
গঙ্গারাম তো কেবল ভোগে
পিলের জ্বর আর পাণ্ডু রোগে ।
কিন্তু তারা উচ্চ ঘর,
কংসরাজের বংশধর !
শ্যাম লাহিড়ী বনগ্রামের
কি যেন হয় গঙ্গারামের ।—
যহোক, এবার পাত্র পেলে,
এমন কি আর মন্দ ছেলে ?

Bangla Kobita of Sukumar Ray #118

 

– সুকুমার রায়

সন্দেশের গন্ধে বুঝি দৌড়ে এল মাছি?
কেন ভন্ ভন্ হাড় জ্বালাতন ছেড়ে দেওনা বাঁচি!
নাকের গোড়ায় সুড়সুড়ি দাও শেষটা দিবে ফাঁকি?
সুযোগ বুঝে সুড়–ৎ করে হুল ফোটাবে নাকি?

Bangla Kobita of Sukumar Ray #119

 

– সুকুমার রায়

সম্পাদকীয়-
একদা নিশীথে এক সম্পাদক গোবেচারা ।
পোঁটলা পুঁটলি বাঁধি হইলেন দেশছাড়া ।।
অনাহারী সম্পাদকী হাড়ভাঙা খাটুনি সে ।
জানে তাহা ভুক্তভোগী অপরে বুঝিবে কিসে ?
লেখক পাঠক আদি সকলেরে দিয়া ফাঁকি ।
বেচারী ভাবিল মনে- বিদেশে লুকায়ে থাকি ।।
এদিকে ত ক্রমে ক্রমে বৎসরেক হল শেষ ।
‘নোটিশ’ পড়িল কত ‘সম্পাদক নিরুদ্দেশ’ ।।
লেখক পাঠকদল রুষিয়া কহিল তবে ।
জ্যান্ত হোক মৃত হোক ব্যাটারে ধরিতে হবে ।।
বাহির হইল সবে শব্দ করি ‘মার মার’ ।
-দৈবের লিখন, হায়, খণ্ডাইতে সাধ্য কার ।।
একদা কেমনি জানি সম্পাদক মহাশয় ।
পড়িলেন ধরা- আহা দুরদৃষ্ট অতিশয় ।।
তারপরে কি ঘটিল কি করিল সম্পাদক ।
সে সকল বিবরণে নাহি তত আবশ্যক ।।
মোট কথা হতভাগ্য সম্পাদক অবশেষে ।
বসিলেন আপনার প্রাচীন গদিতে এসে ।।
(অর্থাৎ লেখকদল লাঠৌষধি শাসনেতে ।
বসায়েছে তারে পুনঃ সম্পাদকী আসনেতে ।।)
ঘুচে গেছে বেচারীর ক্ষণিক সে শান্তি সুখ ।
লেখকের তাড়া খেয়ে সদা তার শুষ্কমুখ ।।
দিস্তা দিস্তা পদ্য গদ্য দর্শন সাহিত্য প’ড়ে ।
পুনরায় বেচারির নিত্যি নিত্যি মাথা ধরে ।।
লোলচর্ম অস্থি সার জীর্ণ বেশ রুক্ষ্ণ কেশ ।
মুহূর্ত সোয়াস্তি নাই- লাঞ্ছনার নাহি শেষ ।।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #120

 

– সুকুমার রায়

বললে গাধা মনের দুঃখে অনেকখানি ভেবে-
“বয়েস গেল খাটেতে খাটতে, বৃদ্ধ হলাম এবে,
কেউ করে না তোয়াজ তবু, সংসারের কি রীতি!
ইচ্ছে করে এক্ষুনি দিই কাজে কর্মে ইতি।
কোথাকার ঐ নোংরা কুকুর ,আদর যে তার কত –
যখন তখন ঘুমোচ্ছে সে লাটসাহেবের মত!
ল্যাজ নেড়ে যেই ঘেউ ঘেউ ঘেউ, লাফিয়ে দাঁড়ায় কোলে,
মনিব আমার বোক্‌চন্দর্, আহ্লাদে যান গলে।
আমিও যদি সেয়ানা হতুম, আরামে চোখ মুদে
রোজ মনিবের মন ভোলাতুম অমনি নেচে কুঁদে।
ঠ্যাং নাচাতুম , ল্যাজ দোলাতুম, গান শোনাতুম সাধা –
এ বুদ্ধিটা হয়নি আমার – সাধে কি বলে গাধা!

বুদ্ধি এঁটে বসল গাধা আহ্লাদে ল্যাজ নেড়ে,
নাচল কত, গাইল কত, প্রাণের মায়া ছেড়ে।
তারপরেতে শেষটা ক্রমে স্ফূর্তি এল প্রাণে
চলল গাধা খোদ্ মনিবের ড্রয়িংরুমের পানে।
মনিবসাহেব ঝিমুচ্ছিলেন চেয়ারখানি জুড়ে,
গাধার গলার শব্দে হঠাৎ তন্দ্রা গেল উড়ে।
চম্‌কে উঠে গাধার নাচন যেমনি দেখেন চেয়ে,
হাসির চোটে সাহেব বুঝি মরেন বিষম খেয়ে।

ভাব্‌লে গাধা – এই তো মনিব জল হয়েছেন হেসে
এইবারে যাই আদর নিতে কোলের কাছে ঘেঁষে।
এই না ভেবে এক্কেবারে আহ্লাদেতে ক্ষেপে
চড়্ল সে তার হাঁটুর উপর দুই পা তুলে চেপে।
সাহেব ডাকেন ‘ত্রাহি ত্রাহি’ গাধাও ডাকে ‘ঘ্যাঁকো’,
(অর্থাৎ কিনা কোলে চড়েছি, এখন আমায় দ্যাখো!)

ডাক শুনে সব দৌড়ে এল ব্যস্ত হয়ে ছুটে ,
দৌড়ে এল চাকর বাকর মিস্ত্রী মজুর মুটে,
দৌড়ে এল পাড়ার লোকে ,দৌড়ে এল মালী –
কারুর হাতে ডান্ডা লাঠি কারু বা হাত খালী।
ব্যাপার দেখে অবাক সবাই ,চক্ষু ছানা বড়া –
সাহেব বললে, “উচিত মতন শাসনটি চাই কড়া।”
হাঁ হাঁ বলে ভীষণ রকম উঠল সবাই চটে,
দে দমাদম্ মারের চোটে গাধার চমক্ ছোটে।

ছুটল গাধা প্রাণের ভয়ে গানের তালিম ছেড়ে,
ছুটল পিছে একশো লোকে হুড়মুড়িয়ে তেড়ে।
তিন পা যেতে দশ ঘা পড়ে, রক্ত ওঠে মুখে –
কষ্টে শেষে রক্ষা পেলে কাঁটার ঝোপে ঢুকে।
কাঁটার ঘায়ে চামড়া গেল সার হল তার কাঁদা;
ব্যাপার শুনে বললে সবাই, “সাধে কি বলে গাধা”।

Bangla Kobita of Sukumar Ray #121

 

– সুকুমার রায়

আরে আরে, ওকি কর প্যালারাম বিশ্বাস?
ফোঁস্ ফোঁস্ অত জোরে ফেলোনাকো নিশ্বাস।
জানোনা কি সে বছর ওপাড়ার ভূতোনাথ,
নিশ্বাস নিতে গিয়ে হয়েছিল কুপোকাৎ?
হাঁপ ছাড় হ্যাঁস্‌ফ্যাঁস্ ও রকম হাঁ করে-
মুখে যদি ঢুকে বসে পোকা মাছি মাকড়ে?
বিপিনের খুড়ো হয় বুড়ো সেই হল’ রায়,
মাছি খেয়ে পাঁচ মাস ভুগেছিল কলেরায়।
তাই বলি- সাবধান! ক’রোনাকো ধুপ্ধা)প্,
টিপি টিপি পায় পায় চলে যাও চুপ্ চাপ্।
চেয়োনাকো আগে পিছে, যেয়োনাকো ডাইনে
সাবধানে বাঁচে লোকে,- এই লেখে আইনে।
পড়েছ ত কথা মালা? কে যেন সে কি করে
পথে যেতে পড়ে গেল পাতকো’র ভিতরে ?
ভালো কথা- আর যেন সকালে কি দুপুরে ,
নেয়োনাকো কোনো দিন ঘোষেদের পুকুরে,
এরকম মোটা দেহে কি যে হবে কোন্ দিন,
কথাটাকে ভেবে দেখ কি রকম সঙ্গিন!
চটো কেন? হয় নয় কে বা জানে পষ্ট,
যদি কিছু হ’য়ে পড়ে পাবে শেষে কষ্ট।
মিছিমিছি ঘ্যান্ ঘ্যান্ কেন কর তক্ক?
শিখেছ জ্যাঠামো খালি, ইঁচরেতে পক্ক ,
মানবে না কোন কথা চলা ফেরা আহারে ,
একদিন টের পাবে ঠেলা কয় কাহারে ।
রমেশের মেঝ মামা সেও ছিল সেয়না,
যত বলি ভালো কথা কানে কিছু নেয়না
শেষকালে একদিন চান্নির বাজারে
প’ড়ে গেল গাড়ি চাপা রাস্তার মাঝারে!

Bangla Kobita of Sukumar Ray #122

 

– সুকুমার রায়

পুলিশ দেখে ডরাইনে আর, পালাইনে আর ভয়ে,
আরশুলা কি ফড়িং এলে থাকতে পারি সয়ে।
আধাঁর ঘরে ঢুকতে পারি এই সাহসের গুণে,
আর করে না বুক দুর্ দুর্ জুজুর নামটি শুনে।
রাত্তিরেতে একলা শুয়ে তাও ত থাকি কত,
মেঘ ডাকলে চেঁচাইনেকো আহাম্মুকের মত।
মামার বাড়ির কুকুর দুটোর বাঘের মত চোখ,
তাদের আমি খাবার খাওয়াই এমনি আমার রোখ্!
এম্‌নি আরো নানান দিকে সাহস আমার খেলে
সবাই বলে “খুব বাহাদুর” কিংবা “সাবাস ছেলে”।
কিন্তু তবু শীতকালেতে সকালবেলায় হেন
ঠান্ডা জলে নাইতে হ’লে কান্না আসে কেন?
সাহস টাহস সব যে তখন কোনখানে যায় উড়ে-
ষাড়ের মতন কন্ঠ ছেড়ে চেঁচাই বিকট সুরে!

Bangla Kobita of Sukumar Ray #123

 

– সুকুমার রায়

দেখছে খোকা পঞ্জিকাতে এই বছরে কখন কবে
ছুটির কত খবর লেখে, কিসের ছুটি কঁদিন হবে।
ঈদ্ মহরম দোল্ দেওয়ালি বড়দিন আর বর্ষাশেষে-
ভাবছে যত, ফুল্লমুখে ফুর্তিভরে ফেলছে হেসে
এমন কালে নীল আকাশে হঠাৎ -খ্যাপা মেঘের মত,
উথলে ছোটে কান্নাধারা ডুবিয়ে তাহার হর্য যত।
‘কি হল তোর?’ সবাই বলে, ‘কলমটা কি বিঁধল হাতে?
জিবে কি তোর দাঁত বসালি? কামড়াল কি ছারপোকাতে?’
প্রশ্ন শুনে কান্না চড়ে অশ্র“ ঝরে দ্বিগুন বেগে,
‘পঞ্জিকাটি আছড়ে ফেলে বললে কেঁদে আগুন রেগে;
ঈদ্ পড়েছে জষ্ঠি মাসে গ্রীষ্মে যখন থাকেই ছুটি,
বর্ষাশেষে আর দোল্ ত দেখি রোব্‌বারেতেই পড়ল দুটি।
দিনগুলোকে করলে মাটি মিথ্যে পাজি পঞ্জিকাতে-
মুখ ধোব না ভাত খাব না ঘুম যাব না আজকে রাতে।’

Bangla Kobita of Sukumar Ray #124

 

– সুকুমার রায়

ও পাড়ার নন্দগোঁসাই, আমাদের নন্দ খুড়ো,
স্বভাবেতে সরল সোজা অমায়িক শান্ত বুড়ো৷
ছিল না তাঁর অসুখবিসুখ, ছিল সে যে মনের সুখে,
দেখা যেত সদাই তারে হুঁকো হাতে হাস্যমুখে৷
হঠাৎ কি তার খেয়াল হল, চল্‌ল সে তার হাত দেখাতে
ফিরে এল শুকনো সরু, ঠকাঠক্‌ কাঁপছে দাঁতে!
শুধালে সে কয় না কথা, আকাশেতে রয় সে চেয়ে,
মাঝে মাঝে শিউরে ওঠে, পড়ে জল চক্ষু বেয়ে৷
শুনে লোকে দৌড়ে এল, ছুটে এলেন বদ্যিমশাই,
সবাই বলে, ‘কাঁদছ কেন ? কি হয়েছে নন্দগোঁসাই?’

খুড়ো বলে, ‘বলব কি আর, হাতে আমার পষ্ট লেখা
আমার ঘাড়ে আছেন শনি, ফাঁড়ায় ভরা আয়ুর রেখা৷
এতদিন যায়নি জানা ফিরছি কত গ্রহের ফেরে—
হঠাৎ আমার প্রাণটা গেলে তখন আমায় রাখবে কে রে?
ষাটটা বছর পার হয়েছি বাপদাদাদের পুণ্যফলে—
ওরা তোদের নন্দ খুড়ো এবার বুঝি পটোল তোলে৷
কবে যে কি ঘটবে বিপদ কিছু হায় যায় না বলা—’
এই ব’লে সে উঠল কেঁদে ছেড়ে ভীষণ উচ্চ গলা৷
দেখে এলাম আজ সকালে গিয়ে ওদের পাড়ার মুখো,
বুড়ো আছে নেই কো হাসি, হাতে তার নেই কো হুঁকো৷

Bangla Kobita of Sukumar Ray #125

 

– সুকুমার রায়

একবার দেখে যাও ডাক্তারি কেরামৎ-
কাটা ছেঁড়া ভাঙা চেরা চট্পট মেরামৎ
কয়েছেন গুরু মোর, “শোন শোন বৎস,
কাগজের রোগী কেটে আগে কর মক্স”
উৎসাহে কি না হয়? কি না হয় চেষ্টায়?
অভ্যাসে চটপট্ হাত পাকে শেষটায়।
খেটে খুটে জল হ’ল শরীরের রক্ত-
শিখে দেখি বিদ্যেটা নয় কিছু শক্ত।
কাটা ছেঁড়া ঠুক্ ঠাক। কত দেখ যন্ত্র,
ভেঙে চুরে জুড়ে দেই তারও জানি মন্ত্র
চোখ বুজে চটপট বড় বড় মুর্তি,
যত কাটি ঘ্যাঁস্ ঘ্যাঁস্ তত বাড়ে ফুর্তি।
ঠ্যাং কাটা গলা কাটা কত কাটা হস্ত,
শিরিষের আঠা দিয়ে জুড়ে দেয় চোস্ত।
এইবারে বলি তাই, রোগী চাই জ্যান্ত-
ওরে ভোলা, গোটাছয় রোগী ধরে আন্ত!

গেঁটেবাতে ভুগে মরে ও পাড়ার নন্দী,
কিছুতেই সারাবে না এই তার ফন্দি-
একদিন এনে তারে এইখানে ভুলিয়ে,
গেটেঁবাত ঘেঁটে- ঘুঁটে সব দেব ঘুলিয়ে।
কার কানে কট্ কট্ কার নাকে সর্দি,
এস, এস, ভয় কিসে? আমি আছি বদ্যি।
শুয়ে কে রে? ঠ্যাং ভাঙা? ধরে আন্ এখেনে-
স্ক্রুপ্ দিয়ে এঁটে দিব কি রকম দেখে নে।
গলা ফোলা কাঁদ কেন? দাঁতে বুঝি বেদনা?
এস এস ঠুকে দেই আর মিছে কেঁদ না,
এই পাশে গোটা দুই, ওই পাশে তিনটে-
দাঁতগুলো টেনে দেখি কোথা গেল চিমটে?
ছেলে হও, বুড়ো হও, অন্ধ কি পঙ্গু,
মোর কাছে ভেদ নাই, কলেরা কি ডেঙ্গু-
কালাজ্বর, পালাজ্বর, পুরানো কি টাটকা,
হাতুড়ির একঘায়ে একেবারে আট্কা!